উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সূচকে মিল থাকছে না

দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা বা কৌশল ঠিক করতে পারছে না সরকার। এ পর্যন্ত ঠিক করা লক্ষ্যমাত্রার একটির সঙ্গে আরেকটির কোনো মিল নেই। একেক মন্ত্রণালয় একেক রকম উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে, যাতে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে।
মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামোতে (এমটিএমএফ) একরকম উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা প্রক্ষেপণ করা হলেও ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় করা হচ্ছে আরেক রকম। আবার এ দুইয়ের সঙ্গে ফারাক রয়েছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষিত রূপকল্প ২০২১-এর।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অনুমানের ওপর ভিত্তি করে এবং সনাতন ও দায়সারা পদ্ধতিতে উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করায় এ সমস্যা তৈরি হয়েছে।
চলতি ২০১০-১১ থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবছর, অর্থাৎ আগামী পাঁচ বছরে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ কতদূর এগোতে চায়, এমটিএমএফের মাধ্যমে তার একটি প্রক্ষেপণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে একই সময়ের জন্য প্রণীতব্য ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও একই বিষয়ের ওপর প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। এটি করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। আবার কিছু প্রক্ষেপণ করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। এটি করা হয়েছে রূপকল্প-২০২১-এর ওপর ভিত্তি করে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অবশ্য রূপকল্পের নাম দিয়েছেন অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের রূপরেখা।
একই সরকারের সময়কালে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের এই বিভিন্ন প্রক্ষেপণের নেতিবাচক সমালোচনা করেছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা। উন্নয়ন সহযোগী ও দাতা সংস্থাগুলোর শীর্ষস্থানীয় পর্যায়ের কর্মকর্তারাও এ বিষয়ে দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় ঘটানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
এমটিএমএফের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেছেন, প্রথাগত পদ্ধতিতে অর্থনীতির সূচক নির্ণয়ের কারণে অঙ্কের হেরফের হচ্ছে, প্রকৃত চিত্রও উঠে আসছে না। প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো কম্পিউটেশনাল জেনারেল ইক্যুইলিব্রিয়াম (সিজিই মডেল) পদ্ধতি অনুসরণ করলে এ সমস্যা কেটে যাবে।
উদাহরণ দিয়ে অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, প্রথাগত পদ্ধতি অনুযায়ী হিসাব করলে দেখা যায়, প্রবাসী-আয় (রেমিট্যান্স) বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও ভোগব্যয় বাড়ে। কিন্তু সিজিই পদ্ধতিতে হিসাব করলে ওই রেমিট্যান্সের কারণে প্রকৃত আয় কত বাড়ল, আমদানি-ব্যয় বাড়ল কি না, বা কৃষি খাতের ওপরই বা কী প্রভাব তৈরি হলো, তার চিত্রটা উঠে আসে।
যেসব নীতি চলকের ওপর ভিত্তি করে পাঁচ বছরের জন্য এমটিএমএফ প্রণীত হয়েছে এবং পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার, মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক অর্থায়ন, মোট রাজস্ব, মুদ্রাবিনিময় হার, মোট ব্যয়, প্রবাসী-আয় (রেমিটেন্স), বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ব্যয় ইত্যাদি।
জিডিপির প্রবৃদ্ধি: পাঁচ বছর মেয়াদি এমটিএমএফে চলতি ২০১০-১১ অর্থবছরের জন্য জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বর্তমান বাজেটে এই হারই বহাল রেখেছেন। ২০১১-১২ অর্থবছরের জন্য প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২ শতাংশ এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরের জন্য ৭ দশমিক ৬ শতাংশ প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরেই প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশে উন্নীত হবে এবং পরের বারও বজায় থাকবে এই হার।
এমটিএমএফের মতো পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৭ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জন্য ৮ শতাংশ প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। বাকি তিনবারের প্রক্ষেপণে এমটিএমএফের সঙ্গে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কোনো মিল নেই। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০১১-১২ অর্থবছরের প্রক্ষেপণ ৬ দশমিক ৯ এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরের ৭ দশমিক ২ শতাংশ, যা এমটিএমএফের এই দুবারের তুলনায় দশমিক ৩০ শতাংশ কম। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রক্ষেপণ ৭ দশমিক ৬ শতাংশ, যা এমটিএমএফের তুলনায় দশমিক ৫০ শতাংশ কম।
মূল্যস্ফীতি: এমটিএমএফে চলতি অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৫, ২০১১-১২ অর্থবছরের জন্য ৬ দশমিক ৩ এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরের জন্য ৬ দশমিক ১ শতাংশ প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। এমটিএমএফ অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরেই মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নেমে আসবে এবং পরের অর্থবছরেও একই হার, অর্থাৎ ৬ শতাংশই বজায় থাকবে।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, মূল্যস্ফীতি প্রক্ষেপণে এমটিএমএফের সঙ্গে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার চলতি ২০১০-১১ এবং শেষ ২০১৪-১৫, অর্থাৎ দুই অর্থবছরের মিল রয়েছে। উভয়টিতেই চলতি অর্থবছরের জন্য ৬ দশমিক ৫ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জন্য ৬ শতাংশ প্রক্ষেপণ করা হয়েছে।
তবে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০১১-১২ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৪, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৩ এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৬ দশমিক ২ শতাংশ প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। এমটিএমএফের সঙ্গে এ তিন বছরের প্রক্ষেপণে কোনো মিল নেই।
মোট বিনিয়োগ: এমটিএমএফে চলতি অর্থবছরের জন্য মোট বিনিয়োগ (বেসরকারি ও সরকারি মিলিয়ে) প্রক্ষেপণ করা হয়েছে জিডিপির ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছরের জন্য ২৮ দশমিক ৪, ২০১২-১৩ অর্থবছরের জন্য ৩০, ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জন্য ৩১ দশমিক ৬ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জন্য প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ৩২ শতাংশ।
এ বিষয়ে এমটিএমএফ এবং পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় একই রকম ধরা হয়েছে। এমটিএমএফের তুলনায় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বাকি তিন বছরের প্রক্ষেপণেই রয়েছে ব্যাপক অসামঞ্জস্য। যেমন, ২০১২-১৩ অর্থবছরের জন্য ২৯ দশমিক ৬, ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জন্য ৩১ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জন্য তা ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ, যার একটির সঙ্গেও এমটিএমএফের প্রক্ষেপণের কোনো সামঞ্জস্য নেই।
মোট রাজস্ব: মোট রাজস্ব এমটিএমএফে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে চলতি অর্থবছরের জন্য জিডিপির ১১ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০১১-১২ অর্থবছরের জন্য ১২ দশমিক ৫, ২০১২-১৩ অর্থবছরের জন্য ১৩ দশমিক ১, ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জন্য ১৩ দশমিক ৬ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জন্য ১৪ দশমিক ১ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের জন্য মোট রাজস্ব জিডিপির ১১ দশমিক ৯ শতাংশ উভয় প্রক্ষেপণে একই রয়েছে। কিন্তু বাকি চার বছরের একটিরও মিল নেই। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০১১-১২ অর্থবছরের জন্য ১২ দশমিক ৬ এবং পরের তিন অর্থবছরের জন্য যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৫, ১৪ দশমিক ৪ এবং ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ প্রক্ষেপণ করা হয়েছে।
অর্থায়ন: এমটিএমএফে ব্যাংকব্যবস্থা, ব্যাংকবহির্ভূত উৎস ও বৈদেশিক খাত মিলিয়ে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে চলতি অর্থবছরের জন্য জিডিপির ৫ শতাংশ। পরের চার অর্থবছরের জন্য যথাক্রমে ৪ দশমিক ৭, ৪ দশমিক ৩, ৪ দশমিক ২ এবং ৪ শতাংশ। কিন্তু পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় চলতি অর্থবছরের জন্য অর্থায়ন প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। আর পরের চার বছর ধরেই এ হার ৫ শতাংশ থাকবে বলে বলা হয়েছে।
বিনিময় হার: ডলারের বিপরীতে টাকার মান, অর্থাৎ বিনিময় হার এমটিএমএফে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে চলতি অর্থবছরের জন্য ৭০ দশমিক ২ টাকা। পরের চার অর্থবছরের জন্য যথাক্রমে ৭০ দশমিক ৭, ৭১ দশমিক ২, ৭১ দশমিক ৫ ও ৭১ দশমিক ৯ টাকা।
সব চলকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অসামঞ্জস্য এই বিনিময় হারের প্রক্ষেপণে। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিনিময় হার চলতি অর্থবছরের জন্য ৭১ দশমিক ৬ এবং পরের চার বছরের জন্য যথাক্রমে ৭৪ দশমিক ২, ৭৬ দশমিক ৯, ৭৯ দশমিক ৭ এবং ৮২ দশমিক ৪ টাকা প্রক্ষেপণ করা হয়েছে।
এমটিএমএফ এবং পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে রূপকল্পের প্রক্ষেপণেও কোনো মিল নেই। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে প্রায়ই বলা হয়, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে রূপকল্পকে মাথায় রেখে। গত ফেব্রুয়ারিতে রূপকল্প বাস্তবায়নের একটি খণ্ডচিত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী। ‘রূপকল্প বাস্তবায়ন: কোন পথে?’ শীর্ষক অধ্যায়ে মোট রাজস্বের ক্ষেত্রে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জন্য ১২ দশমিক ২, ২০১১-১২ অর্থবছরে ১২ দশমিক ৭, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৩ দশমিক ১ এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। এখানেও দুই অর্থবছরের প্রক্ষেপণে অন্যগুলোর সঙ্গে কোনো মিল নেই।
সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম এই প্রক্ষেপণগুলো একই রকম হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে মনে করেন। অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মধ্যে এ ব্যাপারে একটি বৈঠক অনুষ্ঠানের পরামর্শ দেন তিনি।
মির্জ্জা আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন চলকের ওপর প্রক্ষেপণ নিয়ে দুই মন্ত্রণালয়ের দুই রকম মতামত অনাকাঙ্ক্ষিত। এ রকম হলে প্রক্ষেপণের ওপরই অনাস্থা তৈরি হবে। ফলে দীর্ঘমেয়াদি কোনো উন্নয়ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে না।
এ বিষয়ে জিইডির সদস্য এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এমটিএমএফ ও পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রক্ষেপণে পার্থক্য থাকার কোনো সুযোগ নেই; যদি থাকেও, তা সংশোধনযোগ্য।

No comments

Powered by Blogger.