ইতিহাস- 'চারশ' বছরের ঢাকা লোক ঐতিহ্যের দশ-দিগন্ত' by আনিস আহামেদ

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ডিসি সরকার বলেছেন, কলহনের রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থে 'ঢাক্কা' শব্দটি পাওয়া গেছে যার অর্থ পর্যবেক্ষণ ফাঁড়ি। বিক্রমপুর বা সোনারগাঁওয়ের পর্যবেক্ষণ ঘাঁটি হিসেবে প্রাচীনকালে এক সময় উঁচু ভূমিতে অবস্থিত এ অঞ্চলটিকেই বলা হতো 'ঢাক্কা'।

সেই থেকে ঢাকা নামের উৎপত্তি। তিনি আরো বলেছেন, প্রাকৃত একটি উপভাষার নাম 'ঢাকা ভাষা'। অর্থাৎ ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চলে ব্যবহূত ভাষা। ঐতিহাসিক যতীন্দ্র মোহনও অনুরূপ মত প্রকাশ করেছেন। ১২২৯ সালে আফগান সেনাপতি মালিক সাইফুদ্দিন আইবেক যখন সূর্যসেনকে যুদ্ধে পরাজিত করে এই অঞ্চল দখল করেন তখন ঢাকা 'ঢাবাকা' নামে পরিচিত ছিল।
ইসলাম খাঁ চিশতি ১৬০৮ সালের জুলাই মাসে ঢাকা পদার্পণের পূর্বে, ঢাকা শহরের একটি ক্ষয়িষ্ণু কাঠামো হয়তো ছিল কিন্তু তার কোনো বৈভব ছিল না। বাবুবাজারের ধোলাইখালের পূর্ব প্রান্ত থেকে পূর্বে ফরিদাবাদ পর্যন্ত শহরভিত্তিক জনবসতি বিদ্যমান ছিল। এ অঞ্চলের মানুষ স্থানীয় 'ঢাকা ভাষা'য় কথা বলত। তাদের কথ্য ভাষার সাথে বুড়িগঙ্গার দক্ষিণপাড় জিঞ্জিরা-কেরানীগঞ্জ, পূর্বে ডেমরা-মাতুয়াইল, পশ্চিমে নবাবগঞ্জ-হাজারীবাগ, রায়েরবাজার, বশিলা, মিরপুর, আমিনবাজার ও উত্তরে মগবাজার-তেজগাঁও অঞ্চলের আদি বাংলা ভাষী ঢাকাইয়াদের ভাষার সাদৃশ্য ছিল। অর্ধ সহস্রাব্দের পরিক্রমায় এর প্রমাণাদি এখনো লুপ্ত হয়ে যায়নি। স্বভাবতই ভাষাভিত্তিক এই জনগোষ্ঠীর ছিল নিজস্ব সংস্কৃতি ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান।
ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই বহিরাগত মোগলদের কাছে তৎকালীন বাংলা ভাষী ঢাকাইয়ারা নিচু জাত-পাতের মানুষ হিসেবে বিবেচিত হয়ে কুট্টি (ছোট লোক) পরিচিতি লাভ করে এবং তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি কুট্টিদের নামে নামকরণ হয়। বহিরাগত পশ্চিম ভারতীয় ও পশ্চিমা অভারতীয়রা (ইরান-আফগান) নিজেদের সোববাস বা অভিজাত শ্রেণী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। সোববাসদের কাছে ঢাকার পরিচিতিটা এমনভাবে পাওয়া যায় তখনকার একটি প্রচলিত ছড়ায়। "ঢাকা আজিব শাহার। নাম জাহাঙ্গীর নাগার, দো চার শারিফ হ্যায়। বাকী কুট্টি তামাম।"
বহিরাগত (হিন্দুস্তানি) ঢাকাইয়াদের (সোববাস)
ভাষা ও সংস্কৃতি
১৬০৮ (মতান্তরে ১৬১০) সালে ইসলাম খাঁর ঢাকা আগমনের পর ১৬১০ সালে ঢাকা সূবা বাংলার রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে। ঢাকার দাফতরিক নামকরণ হয় জাহাঙ্গীরনগর। ১৭০৪-০৫ সালে রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হয়। এই প্রায় শত বছর ঢাকা বহিরাগত পশ্চিমা মুসলমানদের (কিছু পেশাদার হিন্দুও ছিল। তারা কামার, কুমার ও ধোপা। কামররা প্রধানত অস্ত্রপাতি ও কুমাররা প্রধানত জাফরি ইট তৈরি করত) নিরাপদ ও সৌভাগ্য নগরীতে পরিণত হয় ঢাকা শহর। লাখ লাখ বহিরাগত মানুষের পদভারে ঢাকা তখন বিশ্বের অন্যতম নগরীতে পরিণত হয়। ভাগ্যান্বেষণে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ ছুটে আসে এখানে। বিশ্বের সেরা শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার মান ছিল ১৬৫০ সালে ২৮তম, যা ১৭০০ সালে ১২তম স্থানে উন্নীত হয়। ১৭০৫ সালে ঢাকা তার শৌর্য-বীর্য হারাতে শুরু করলে ১৭৫০ সালে ঢাকার মান ২৯তম স্থানে অবনমিত হয়।
বহিরাগত মুসলমান-হিন্দু ও অভারতীয়দের নিয়ে গঠিত সোববাস ঢাকাইয়াদের জাত-পাতের বর্ণনা করতে গিয়ে মুনসী রহমান আলী তায়েশ ১৯১০ সালে তার রচিত গ্রন্থে উলেস্নখ করেছেন এভাবে- "প্রায় একশ' বছর ঢাকা ছিল বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা- এই তিন প্রদেশের রাজধানী। এ সময় যত সুবেদার দিলিস্ন থেকে এখানে এসেছেন, সকলেই সব শ্রেণীর লোকজন নিজেদের সাথে নিয়ে এসেছেন। বিদ্বান, কেরাণি, যোদ্ধা, কারিগর, শিল্পী, ব্যবসায়ী, দর্জি, স্বর্ণকার, শালকর, আমুদে, রুটি প্রস্তুতকারী, ময়রা সকলেই দিলিস্ন থেকে এসেছে। এ শহর বিস্তৃতি, জনবসতি, জ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যায় তখন দিলিস্নর অনুরূপ ছিল। বড় বড় ধনী ও সম্পদশালী লোকরা এ শহরে ছিলেন। যদিও পরবতর্ীকালে মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ায় এ শহরে জনবসতি হ্রাস পেতে থাকে। তবুও যত লোক এখানে থেকে যান তারা সবাই দিলিস্ন থেকে আগত লোকদেরই বংশধর। ব্যবসা উপলক্ষে বিদেশিরা দিনে দিনে ঢাকায় এসে ব্যবসা করে লাখ লাখ টাকা আয় করে বিশাল জমিদারি ও ভূ-সম্পত্তি করে ফেলেছেন। মোগল, গ্রিক, আর্মেনীয়, ইংরেজ, ফরাসি, পতর্ুগিজ, দিনেমার প্রভৃতি জাতি ঢাকায় বসবাস করে প্রচুর সম্পদের অধিকারী হন।"
প্রায় ১০০ বছরে প্রধানত দিলিস্ন অঞ্চল থেকে আগত ভারতীয়দের ভাষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি ঢাকাইয়া সোববাস মানুষের, দিলিস্ন অঞ্চলের মানুষের অনুরূপ ছিল। এর সাথে সংমিশ্রণ ঘটে অভারতীয় বিদেশি বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর শিক্ষা ও সংস্কৃতির। ঢাকা অঞ্চলের প্রাচীনকাল থেকে বহমান শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ভাষা এবং সামাজিক রীতি-নীতি প্রথম ১০০ বছর ধীরালয়ে এবং পরবতর্ী ৩০০ বছরে দ্রুতলয়ে সোববাস ভাষা ও সংস্কৃতিতে সংমিশ্রণ ঘটে। তবুও ঢাকাইয়া সোববাসরা দিলিস্ন অঞ্চলের ভাষা ও সংস্কৃতিকে বংশ পরম্পরায় ধারণ ও লালন করেছে। তারা প্রায় সাড়ে ৩০০ বছর আন্তঃপরিবার ও আন্তঃসমাজে বিয়ে-সাদী প্রচলিত রেখে রক্ষণশীলভাবে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকার আধুনিক সমাজ যখন গড়ে উঠতে শুরু করল তখনই মোগল আমলের ক্ষয়িষ্ণু ইমারতরাজির মতো ভাঙতে শুরু করল ঢাকাইয়া সোববাসদের ভাষা, সামাজিক রীতি-নীতি ও সংস্কৃতি। সোববাসদের ভাষা-সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও চর্চা আজ এমনই এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, আগামী সিকি শতাব্দীর মধ্যে এর কোনো অস্তিত্বই বিদ্যমান থাকবে না।
আদি ঢাকাইয়াদের সংস্কৃতি চর্চা
মোগলপূর্ব যুগে আদিবাসী ঢাকাইয়ারা পুঁথি ও কিচ্ছা পাঠ, বিয়ের গান, মুশর্ীদি গান, কির্তন, বন্দনা সঙ্গীত, শোক ও বিচ্ছেদের গান, ধমর্ীয়-সামাজিক উৎসবে পালাগান ও জারিগান পরিবেশনের মাধ্যমে তাদের সংস্কৃতি চর্চা অব্যাহত রাখত, যা ছিল বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতিরই অনুরূপ। নগর সভ্যতার হাওয়ার দোলায় এর সাথে সংযুক্ত হলো যাত্রাপালা, বাঈজী ও হিজড়াদের নৃত্যগীত, ছাদ পিটানি গান এবং থিয়েটার।
যাত্রাপালা : বিশ শতকের শুরুতে ঢাকার স্থানীয় যাত্রাপালার কিছুটা বর্ণনা করেছেন প্রয়াত স্বাধীনতা সংগ্রামী ও কমিউনিস্ট নেতা বঙ্গেশ্বর রায়। তখন নবাবপুর যাত্রাদল ও শাখারীবাজার অপেরা পার্টি একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। এসব যাত্রাপালায় অভিনেতা-অভিনেত্রী দুই ভূমিকায় ছেলেরাই অংশ নিত। যাত্রা শুরু হওয়ার পূর্বে সখিদের নাচ ও গান পরিবেশিত হতো। সখিদের গানের কয়েকটি চরণ এরূপ-
১. "- যাও হে চলিয়া প্রাণভোমরা,
বাসি ফুলে মধু মিলবে না-"
২. "আমার ভরা কলসি বধূ
খালি করো না,
খা-লি করো না।
আহা খা-লি করো না।
ওপারে তুফান চলে
সাঁ-সাঁ-সাঁ
এপারে বধূয়া চলে
ঢেউ দিও না
ঢে-উ দিও না
আহা ঢে-উ দিও না"
৩. "যারে তারে মন সঁপিলে কি হয়
যো তোমকো চাহে তোম উস্কো চাহো।"
একটি যাত্রাপালার নায়ক ও নায়িকার সংলাপ পালাবইতে তখনকার শুদ্ধ বাংলায় এভাবে রচিত ছিল। (যাত্রাপালার নায়কের নাম সূর্য সিংহ ও নায়িকা সংযুক্তা)
"সংযুক্তা-
সূর্য সিংহ! সূর্য সিংহ!
কি হেতু প্রেরিয়াছ
সাক্ষাতের গোপন বারতা?
নহে এবে মোরা বালক-বালিকা,
নহে শোভে নির্জন নিভৃতে
এহেন গোপন আলাপন?
সূর্য সিংহ-
একি কথা কহ তুমি
সংযুক্তা সুন্দরী!
মানি আমি নহ তুমি
নাবালিকা এবে;
ষোড়শী যুবতী তুমি,
জানি তাহা জানি
তবু এই লাজলজ্জা
শোভে কি তোমায়?
কেমনে ভুলিলে তুমি
শৈশবে অনাবৃত দেহে
দোহে সাথে দোহে
হেথা হোথা কত বিচরণ?
নির্দয়! নিষ্ঠুর।
অতীতের মধু স্মৃতি
দিয়াছ কি বিসর্জন
খরতর তটিনীর স্রোতে?"
তখনকার ঢাকাইয়া যাত্রাপালায় পাত্র-মিত্ররা এ ধরনের সংলাপগুলো আঞ্চলিক ভাষায় রূপান্তর করে নিত, রূপান্তরিত সংলাপ নিম্নরূপ :
"সংযুক্তা-
সূর্য্য সিং! সূর্য্য সিং!
ক্যালাইগা বোলাইছচ?
আমরা তো আর
ছ্যাড়া ছ্যাড়ি নাই
মাঠে ময়দানে ঘোপে ঘাপে
বাৎচিৎ করুম?
সূর্য সিংহ-
ক্যালাইগা সংযুক্তা
জুয়ানকি মাগী
অইছচ দেইখা বুঝি
সরমাইতাছচ!
হায় হায় হায় হায়
পাষাণী! কি কমু তরে
ন্যাংটা কালে
কত পেম-মহব্বত করছি
দুইজনে,
সব হালায় ঝাইড়া ঝুইড়া
সূত্রাপুরের খাল দিয়া
ভাসাইয়া দিলি?"
ছাদ পিটানি গান : মোগল আমল থেকে ঢাকায় ব্যাপকভাবে ইমারত-দালানকোঠা, দেউড়ি, কাটারা, মসজিদ, মন্দির, খানকা, মাজার, গির্জা, বাজার, ঈদগাহ্ গড়ে উঠতে থাকে। জাফরি ইট, চুন, সুরকির সংমিশ্রণে গাঁথুনি ও দেয়াল এবং কাঠ ও লোহার সাতিরের ওপর জাফরি ইট বিছিয়ে ওর ওপর সুরকির গুঁড়া ও চুনের মিশেল দিয়ে যে আস্তরণ তৈরি করা হতো সেটা ছাদের ওপর ঢালাই দেওয়া হতো। একে বলা হতো জলছাদ। সারিবদ্ধভাবে বালকরা কাঠের মুগুর (কোপা) দিয়ে সারাদিন সেই জলছাদ পিটিয়ে শক্ত করত। কাজের মনোযোগ যাতে রক্ষিত হয় এবং বালকদের যাতে অলসতা না আসে সেজন্য সর্দার গায়ক থুতনিতে বেহালা ঠেকিয়ে নানান কিসিমের গান জুড়ত। আর ছাদ পিটানি বালক দল কোরাস গলায় সেই গানের সুরে, তালে তালে ছাদ পিটাত। যাকে ছাদ পিটানি গান নামে অভিহিত করা হয়। সিমেন্টের ব্যবহার শুরু হওয়ার পর ঢাকা শহর থেকে জলছাদের প্রচলন বিলুপ্ত হতে শুরু করে। আরসিসি পিলার ও ছাদ তৈরি হতে শুরু করলে জলছাদের প্রচলন ও প্রয়োজন সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়। ফলে ছাদ পিটানির গান এখন বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে গেছে।
বিশ শতকের শুরুতে ঢাকার ছাদ পিটানি গানের কয়েকটি নিম্নরূপ-
১. "আর হোতায় না সজনি-
কালা কাউয়া কা-কা করে
ফাল দিয়া যায় রজনী।
নাসিকাতে ভড়র ভড়র
দাঁতে আওয়াজ কড়র কড়র
কি ঘুম তরে কবজা করছে
হতভাগিনী,
কালা কাউয়া কা-কা করে
ফাল দিয়া যায় রজনী।
টাইনা হ্যাচরাইয়া ক্লান্ত অইছি
কি করমু না ঠাওর পাইছি
তে, নাকের ভিতরে হান্দাইয়া দিমু
বিসল্য করণী,
কালা কাউয়া কা-কা করে
ফাল দিয়া যায় রজনী।"
২. "কালা তোর তরে কদম তলায়
বইসা থাকি, বইসা থাকি,
নাম রাইখেছি, চিকন কালা
বাঁশি বাজায় অতি ভালা
সেই বাঁশিতে দিল উতলা,
কেম্বে বাইন্দা রাখি,
বইসা থাকি, বইসা থাকি।"
৩. "যে জন আমারে ভালোবাইসাছে-
কলকাত্তায় নিয়া আমায় হাইকোট দেখাইছে;
যে জন আমারে ভালোবাইসাছে-
গোয়ালন্দ নিয়া আমায় হিল্শা খাওয়াইছে;
যে জন আমারে ভালোবাইসাছে-
চাঁটগাঁয় নিয়া আমায় হুটকি খাওয়াইছে;
যে জন আমারে ভালোবাইসাছে-
ময়মনসিং নিয়া আমায় বাইগন খাওয়াইছে;
যে জন আমারে ভালোবাইসাছে-
ড্যামরায় নিয়া আমায় সারী পিন্দাইছে;
যে জন আমারে ভালোবাইসাছে-
লাঙ্গলবন্দ নিয়া আমায় দফা সারাইছে।"
৪. "বিয়া না দিলে দাদা দেশে যামু না
কসম খাই তর জরুরে নজর দিমু না,
দাদায় শোয় টিনের ঘরে
আমি শুই সনের ঘরে
দাদার ঘরে খচ্মচ্ করে
মন তো মানে না;
বিয়া না দিলে দাদা দেশে যামু না।"
মেলা : তখনকার সমাজে মেলা ছিল সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম অনুষঙ্গ। চৈত্র সংক্রান্তিতে চরমোগলানিতে (লালবাগ চর অধুনা শহিদনগর) চৈত মেলা বসত। হিন্দু মুসলমানরা সম্মিলিতভাবে এতে অংশগ্রহণ করত। ঢাকার বাংলাভাষী ও সোববাস গায়করা প্রতিযোগী হয়ে গান-বাজনায় নিজেদের দক্ষতা প্রদর্শন করত। মহলস্না-মহলস্না থেকে সঙ সাজিয়ে নিয়ে আসা হতো। গান-বাজনায় প্রতিটি দল আলাদা সামিয়ানা স্থাপন করত। পহেলা বৈশাখ চিলপূজা নামে ফরিদাবাদ ও শ্যামপুরে মেলা বসত। চড়ক পূজার প্রচলনও ঢাকায় বিদ্যমান ছিল। ঢাকঢোল পিটিয়ে চৈত্রের শেষে কালী-শিব-গৌরীর সঙনৃত্য বের করা হতো। উনিশ শতকের শুরু পর্যন্ত লাল চাঁন গোয়ালার সঙ মিছিল প্রসিদ্ধতা লাভ করেছিল।
জন্মাষ্টমীর মিছিল : ইসলাম খাঁর আমল থেকে ঢাকায় ক্ষুদ্রাকারে জন্মাষ্টমীর মিছিলের প্রচলন হলেও কালক্রমে কোম্পানি ও ব্রিটিশ যুগে এটা বিশালত্ব লাভ করে। এ সময় ঢাকা কেন্দি ক ধনাঢ্য হিন্দুদের আধিক্যের কারণে এবং তাদের পৃষ্ঠপোষণে জন্মাষ্টমীর মিছিল বিশালত্ব লাভ করেছিল। সে সময় ঢাকা ও এর আশপাশের দুই লক্ষাধিক হিন্দু-মুসলমান দর্শনাথর্ী জন্মাষ্টমীর মিছিলে শামিল হতো। ঢাকার নবাবপুর ও ইসলামপুর থেকে দুটি মিছিল বের হয়ে ঢাকার পূর্বাংশের প্রধান সড়কসমূহ প্রদক্ষিণ করত। পরস্পরের প্রতিযোগী মনোভাব একসময় প্রতিহিংসায় রূপান্তরিত হয়েছিল বিধায় ব্রিটিশ সরকার দুই মহলস্নার মিছিল দুইদিন প্রদক্ষিণের ব্যবস্থা করে। উৎসব আমেজের বিশালত্ব ও নয়নাভিরাম প্রদর্শনীর বৈচিত্র্যের আকর্ষণে এটা সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছিল। এই মিছিলের অন্যতম আকর্ষণ ছিল সঙ। সঙ-এর দল নানান কিসিমের মুখরোচক সঙ্গীত রচনা করে পরস্পরকে আক্রমণ ও সমসাময়িক বিষয়াদি নিয়ে ব্যঙ্গ এবং বক্রোক্তি করত।
জন্মাষ্টমীর সঙের গান নিম্নরূপ :
১. আগে জানলে বৈরাগী হতো কোন শালায়
ও মালা জপতে হবে,
ও মালা ঠেলতে হবে তিন বেলা
আগে জানলে বৈরাগী হতো কোন শালা
হায়রে বৈরাগী হওয়া
উঠে গেছে ভিক্ষা দেওয়া
বোষ্টুমি পানের সঙ্গে খাইয়া ফেলায়
সবসুপারি তিন ছালা
আগে জানলে বৈরাগী হতো কোন শালা।
২. হরি হে কত কষ্ট দিলে জীবকে,
যুগেরই শেষেতে, এই সকল তোমার খেলা
তোমার লীলা বুঝেছে সব লোকেতে,
কত কষ্ট দিলে জীবকে যুগেরই শেষেতে।
হরি হে কি করিলে কন্ট্রোল, (রেশন দোকান)
ভারতে উঠলো মহারোল,
পায়না চিনি পায়না লবণ,
কি সে বলবে হরি বোল।
আবার পায়নি চিনি অভাবেতে
চায়ে চিটে খেয়েছে
হরি হে কত কষ্ট দিলে জীবকে
যুগেরই শেষেতে।
লেটোগান ও কিস্সা : বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের মতো ঢাকায়ও লেটো ও কিস্সা পরিবেশনের চল ছিল। হাকিম হাবিবুর রহমান তার স্মৃতিকথায় বলেছেন, "প্রথম একটি ছেলেকে কোনো স্বাস্থ্যবান ব্যক্তি নিজের কাঁধে বসাত সঙ্গে অনেক লোক থাকত যারা ঝাঁজা বাজাত। আর দু'-একজন ঢুলিও থাকত। ছেলেটিকে মহিলাদের পরিচ্ছদ ও অলঙ্কার পরানো হতো। সে গাইত আর গানের সাথে সাথে সংলাপ বলত। এটাই ছিল সূচনা। প্রতিদ্বন্দ্বী দলের ছেলেটিও একইভাবে তার প্রতু্যত্তর দিত। তারপর ছেলে দুটোকে মাটিতে নামিয়ে দেয়া হতো। তখন নাচও আরম্ভ হয়ে যেত।" এ ধরনের নাচ ও গানের পালা উনিশ শতকের মাঝ বরাবর পর্যন্ত চালু ছিল। যেটা ঢাকার আদিবাসী (কুট্টি) মহলস্না ও সমাজে প্রদর্শিত হতো। ঢাকার সত্তুরোধর্্ব প্রবীণা সাকিয়া বানু তার শৈশব স্মৃতি থেকে বলেছেন, "চৌকিতে স্টেজ সাজিয়ে বালকরা অভিনয় অনুযায়ী সাজসজ্জা করে নায়ক-নায়িকা-সখি সেজে গান ও নাচ করত।" তিনি গুনাই বিবি-তোতা মিয়ার পালা অবলোকন করেছেন। ঢাকার বিয়ে-সাদী উৎসব আয়োজনে গাজীর কিস্সা পরিবেশিত হতো। এখানে-সেখানে বাড়ির আঙিনা ও খোলা ময়দানে চৌকি স্থাপন করে পালাগান পরিবেশনের চল সে যুগে ছিল।
বাংলা থিয়েটার : ঢাকা গবেষক হাসেম সুফির মতে, ঢাকায় প্রথম বাংলা নাটক মঞ্চস্থ হয় ১৮৬১ সালে। পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি হলে মঞ্চস্থ নাটকটি হলো 'নীল দর্পণ'। হাকিম হাবিবুর রহমানের ভাষ্যমতে, বাংলা নাটকের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ফরাসগঞ্জ মহলস্নার বিখ্যাত সাবান ব্যবসায়ী আকমল খান ও ইউসুফ খান। প্রয়াত সত্যেন সেন লিখেছেন, জুবিলি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা কিশোরী লাল রায় চৌধুরী ১৮৮৭ সালে ঢাকায় প্রথম নাট্য প্রদর্শনীর জন্য জুবিলি থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন। পরবতর্ীতে এই থিয়েটার হলটি ঢাকার বিখ্যাত কাদের সর্দারের হাতে চলে যায়। কাদের সরদার পরবতর্ীকালে একে লায়ন থিয়েটারে নামকরণ করেন। যুগের বিবর্তনে এটা লায়ন সিনেমা হলে রূপান্তরিত হয়। উলেস্নখ্য, কাদের সর্দারের পিতা শেখ মোহাম্মদ হায়াত একজন নামকরা নাট্য অভিনেতা ছিলেন। তিনি মহিলার সাজে অভিনয় করতেন। জুবিলি থিয়েটার প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর ইসলামপুরেই তাঁতীবাজারের রাখাল বসাক ক্রাউন থিয়েটার চালু করেন। সবদিক বিবেচনায় তখনকার ঢাকায় ইসলামপুর ও জিন্দাবাহার নগরীর প্রধান বিনোদন কেন্দে পরিণত হয়েছিল। এই পেশাদার থিয়েটার দুটিতে ৪টি শ্রেণীতে টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা ছিল। ১. প্রথম শ্রেণী : গদি-দুই টাকা, ২. দ্বিতীয় শ্রেণী : চেয়ার-এক টাকা, ৩. তৃতীয় শ্রেণী : টুল-আটআনা, ৪. চতুর্থ শ্রেণী : গ্যালারি-চারআনা।
বাংলা থিয়েটারে অভিনয়ের জন্য কলকাতা থেকে অধিকাংশ আর্টিস্ট ভাড়া করে আনা হতো। স্থানীয় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য ছিল_ গৌরচন্দ দাস, বর্ধমানের রানী, কনক সরোজনী ও সরোলা। এর মধ্যে কনক সরোজনী ছিল ক্রাউন থিয়েটারের মালিক রাখাল বসাকের রক্ষিতা। এই দুটি পেশাদার থিয়েটারে যেসব নাটক অভিনীত হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে_ চন্দ শেখর, পাস্নবগৌরব, মৃণালিনী, দেবলা-দেবী, মোগল-পাঠান, সীতারাম, অযোধ্যার বেগম, শাজাহান, কিন্নরী, মিশরকুমারী, মেবার পতন, হরিশচন্দ , সিংহল বিজয়, প্রফুলস্ন কুবজদবজী, য্যায়সা কা ত্যায়সা, আবু হোসেন, আলীবাবা, রাতকানা, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ, মেঘনাদ বধ এবং চিড়িয়াখানা ও লাঞ্ছনা। শেষ দুটি নাটকের রচয়িতা স্থানীয় ঢাকাবাসী। এর মধ্যে একজন হচ্ছেন বিক্রমপুরের যোগেন গুপ্ত।
লাঞ্ছনা নাটকের গানের অংশ নিম্নরূপ_
"বাবুর আমার টাকার জোগার
আর হল না;
মুগর্ী খাওয়া কি মজা,
টের পাওয়াবে রমজান চাচা,
বাবুর আমার ছুচোর কেত্তন
আর গেল না।"
পেশাদার থিয়েটারের পাশাপাশি ঢাকার পাড়ায় পাড়ায় বহু সখের থিয়েটারের দল গড়ে ওঠে। এসব দলগুলোর উলেস্নখযোগ্য ছিল- ১. লালমোহন সাহা ঠাকুর বাড়ীর সখের দল, ২. সব্জিমহল ড্রামেটিক ক্লাব, ৩. উয়ারি ড্রামেটিক ক্লাব, ৪. টিকাটুলি ড্রামেটিক ক্লাব, ৫. আরমানিটোলা ড্রামেটিক ক্লাব, ৬. গ্যাণ্ডারিয়া ড্রামেটিক ক্লাব, ৭. সংগততোলা ড্রামেটিক ক্লাব, ৮. ফরাসগঞ্জ ড্রামেটিক ক্লাব, ৯. পোস্টাল ড্রামেটিক ক্লাব। এসব সখের দলের কয়েকজন খ্যাতিমান অভিনেতা হচ্ছেন_ গৌরচন্দ দাস, কৃপানাথ দে, অথেন্দু মুখাজর্ী, বিলস্নু বাবু, টোনা বাবু, নকুলেশ্বর দাসগুপ্ত, অমিও গুহ, প্রবোধ বসু, পথিন সেন, বীরেন ঘোসলা, বোচা বাবু, নৃপেন সেন, ননীনি কবিরাজ, সুপতি নাথ।
ঢাকার এই বাংলা নাট্যচর্চার দোলা লাগে তখনকার বিদ্যাপিঠগুলোতে। ফরাসগঞ্জের ইম্পেরিয়া সেমিনারি ছাত্ররা ঢাকায় প্রথম নাট্যচর্চা শুরু করল। তারা বাংলা ভাষায় হরিশচন্দ , সংস্কৃত ভাষায় প্রহ্লাদ চরিত্রম এবং ইংরেজিতে শেক্সপীয়ারের মার্চেন্ট অব ভেনিসের সফল মঞ্চায়ন করেছিল। এই নাটক তিনটি প্রদর্শিত হয়েছিল ১৯১২ সালে। ঢাকায় পেশাদার থিয়েটার সব শেষে প্রদর্শিত হয় ১৯২৬ সালে। পেশাদার থিয়েটার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এই পেশাসংশিস্নষ্ট সবাই বেকার হয়ে যায়। এই সময় খেয়ালের বশবতর্ী হয়ে বলধার জমিদার একটি থিয়েটার দল গঠন করে এসব পেশাদার নাট্যকমর্ীদের বেতন দিয়ে পুষতে শুরু করলেন। তার বাড়ির ভেতর স্টেজ তৈরি করে বিনে পয়সায় থিয়েটার প্রদর্শনী শুরু করলেন জমিদার বাবু। এজন্য সে আমলে তার মাসে ২৫০-৩০০ টাকা খরচ হতো। বলধার জমিদার নরেন্দ নারায়ণ নিজে নাটকও রচনা করতে শুরু করলেন। তার একাধিক নাটক মঞ্চস্থ ও মুদ্রিত হয়েছিল। সখের নাটকের দলে ডাক বিভাগের চাকুরে চুন্নু মিয়া গান গেয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ১৯২৭ সালে ফরাসগঞ্জের মুসলমানরা বাংলা নাটকের প্রথম সফল মঞ্চায়ন করল। মহলস্নার পঞ্চায়েতী ঘরে বিজয় বসন্ত নামে বাংলা নাটক প্রদর্শিত হলো। এর আগে তারা উদর্ু নাটক মঞ্চস্থ করত ঢাকার অন্যান্য মুসলমান মহলস্নার মতো। ফরাসগঞ্জ মহলস্নার নাট্যচর্চার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন মরহুম মাওলা বখস সর্দারের পিতা পিয়ার বখস সরদার। তিনি একজন অভিনেতাও ছিলেন। ঢাকার পূর্বাংশে সখের দলগুলোর বাংলা থিয়েটার চর্চা ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
হিন্দুস্তানি ঢাকাইয়াদের (সোববাস) সংস্কৃতি চর্চা
তাওয়ায়েফদের নৃত্যগীত : ইবনে বতুতা যখন বাংলা সফর করেন সেটা ছিল পাঠান যুগ। সোনারগাঁ ছিল সে আমলের সমৃদ্ধ নগরী। ঢাকা ছিল এর পাশর্্ববতর্ী নগরী। তিনি বর্ণনা করেছেন, "বাংলায় এত সুলভে পরিচারিকা পাওয়া যায়, যারা ভালো ফারসি গজল গাইতে জানে।" স্বভাবতই সাধারণ বাঙালি ললনাদের পক্ষে তো বাংলায় সঙ্গীত চর্চা করার কথা। সেখানে যারা ইবনে বতুতাকে ফারসি গজল শুনিয়েছেন, নিঃসন্দেহে সেসব ললনা ছিল রাজাশ্রিত পেশাদার শিল্পী। কারণ তখনকার রাজভাষাও ছিল ফারসি। আর ঢাকার প্রথম সুবেদার ইসলাম খাঁ-এর মাত্র পাঁচ বছর বয়সি শাসনামলে দরবারে মনোরঞ্জনের জন্য নাচনে-গানেওয়ালী কাঞ্চনী বা সেবিকার সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২০০। এই সেবাদাসীদের পেছনে সুবেদার মহাশয় শুধু রাজকোষ থেকেই খরচ করেছিলেন ৮০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায় মোগল ঢাকার জৌলুস বাড়ার সাথে সাথে এসব তাওয়ায়েফ তথা নর্তকিদের আধিপত্যও বাড়তে থাকে।
মোগল ঘরানার ঢাকাইয়া সোববাস সমাজ ব্যবস্থায় তাওয়ায়েফদের নৃত্যগীত স্থানীয় সংস্কৃতির অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। এ সংস্কৃতি একাধারে ৩০০ বছরের অধিককাল ঢাকায় দাপটের সাথে বিদ্যমান ছিল। সুরের মূর্ছনা, নূপুরের ঝংকার আর তবলার বোলতালে তখনকার সোববাস ঢাকাইয়ারা আকণ্ঠ ডুবে ছিল। নৃত্য ও গীত চর্চায় ঢাকা এক সময় দিলিস্ন, লাখনো, লাহোর, হায়দ্রাবাদকেও ছাড়িয়ে যায়।
ঢাকার নবাব আব্দুল গণির সকালের চায়ের আসরে ঢাকার অভিজাতরা জমা হতেন। রাইসরা বড় টেবিলের চারদিকে গোল হয়ে বসত, টেবিলের উপর নামকরা তাওয়ায়েফরা হাজির হতো। তারা শ্রোতামণ্ডলীর মনোরঞ্জন করত। এসব তাওয়ায়েফদের নবাববাড়ি থেকে মাসিক ভাতা পাঠানো হতো। নবাব আব্দুল গণির আমলে তাওয়ায়েফদের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য ছিল- আন্নু, গান্নু ও নোয়াবিন নামের তিন বোন। এলাহিজান, পেয়ারী বেগম, আচ্ছি বেগম, ওয়াসু, বাতানি, জামারবাত, হীরা, ইমামী, অতুল বাঈ, লক্ষ্মী বাঈ, রাজলক্ষ্মী- এসব প্রসিদ্ধ তাওয়ায়েফরা ঢাকায় বেশ ধন-সম্পদের মালিক হয়েছিল। এছাড়া স্থানীয় বাঈজিরা খেমটা নাচে পারদশর্ী ছিল। নবাব আব্দুল গণির নবাবী খেতাব পাওয়া উপলক্ষে ১৮৭৫ সালের পর প্রতি বছর ১ জানুয়ারি শাহবাগে ঢাকাইয়া সোববাসদের সার্বজনীন উৎসব হতো। নয়নাভিরাম শাহবাগের চত্বরসমূহে ভিন্ন ভিন্ন সামিয়ানার নিচে তাওয়ায়েফরা আসর জমাত। দর্শকরা তাদের নাচ দেখে ও গান শুনে মনোরঞ্জন করত। এমনই এক উৎসবে শাহবাগের গোলতালাবের (পুকুর) ওপর স্থাপিত লোহার সাঁকো ভেঙে তাওয়ায়েফদের নৃত্য দর্শনকারী অনেকে আহত হয়েছিল।
সঙ্গীত : হাকিম হাবিবুর রহমান বলেন, "এটা বাস্তব সত্য যে, ঢাকাইয়ারা অনেক সঙ্গীত রসিক। বলা হয়ে থাকে, যেভাবে লাখনো-এর সাধারণ লোকরা লয় ও সুরের পার্থক্য বুঝে, সে রকম ঢাকাইয়ারাও কি হিন্দু কি মুসলমান সকলেই বিশেষভাবে তাল নির্ণয় করতে পারে। এ রকম অনেক লোক এখানে পাওয়া যাবে যাদের মৌলবিআনা (ধার্মিক) জীবনযাপন দেখে কেউ চিন্তাও করতে পারবে না যে হযরতের (জনাব) গান-বাজনার দিকে দখল আছে। জনসাধারণের মধ্যেও এই বোধশক্তি দেখা যায়, তারা যে কোনো পরিস্থিতিতে রাগ-রাগিনী সম্পর্কে দ্বিধাহীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারে এবং তাদের সামনে কোনো রাগ যদি অসময়ে গাওয়া আরম্ভ করে তাহলে তারা তাতে বাধা দেয়।"
হোলির গান : হাকিম হাবিবুর রহমান উলেস্নখ করেন, "(ঢাকায়) গান-বাজনার রুচি সর্বজনে প্রচলিত হবার একটি কারণ হলো এখানে আদিকাল থেকেই হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক শীর ও শাক্কার (মালাই-চিনি)-এর মতো ছিল। একে-অপরের বিয়ে-শোকে (উৎসব-বেদনায়) শুধু যোগদানই করত না; বরং উৎসবেও অংশগ্রহণ করত। তাই ঢাকার একটি সম্মিলিত তেহার (পর্ব) ছিল হোলি। পর্যায়ক্রমে এক বছর ঢাকার পূর্বাংশের ভিকান ঠাকুরের বাজারে (লক্ষ্মীবাজার এলাকা) রাজার ময়দানে, অপর বছর ঢাকার পশ্চিমাংশের চাঁদনি ঘাটের হোলির মাঠে সমগ্র ঢাকা শহরের হিন্দু-মুসলমানরা সমবেত হতো। পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের অধিবাসীরা দুই দলে ভাগ হয়ে শিবির স্থাপন করে হোলি গানের প্রতিযোগিতা আরম্ভ করত। একেক শিবিরে হাজার হাজার মানুষ মূল গায়কদের সাথে কোরাস কণ্ঠে সুর-তাল ঠিক রেখে আকাশ-বাতাস মাতোয়ারা করে দিত। রাগ-রাগিনী ও তালের ভিন্ন ভিন্ন স্তর অনুসরণ করে একদল একাধারে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত সঙ্গীত পরিবেশন করত। ঝাঁজ, খোল, ঢোল সহযোগে একদলের গান শেষ হলে অন্যদল গান ধরত। এ উৎসবে বাংলাভাষী ঢাকাইয়ারাও হিন্দুস্তানি ভাষায় (হিন্দির প্রাধান্যযুক্ত উদর্ু) হোলি সঙ্গীত পরিবেশন করত।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীত : ঢাকার সোববাসরা তবলা বাদনে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছিল। উনিশ শতকের শুরুতে হোসেন বখস, আতা হোসেন, খায়রাতি জমাদার, সোপান খান, খাজা আহমদ বখস, বাহাদুর খান, কাজী আলাউদ্দিন, সোপান খানের স্ত্রী নামিদামি তবলা বাদক ছিলেন। দিলিস্ন-লাখনোর বড় ওস্তাদদের সাথে তারা সুনামের সাথে বাদন করতেন। হিন্দুস্থানের বিখ্যাত গায়কদের ঢাকায় আসা-যাওয়া ছিল। ঢাকার প্রেমে দিলিস্নর ওস্তাদ মিঠ্ঠুন খান ঢাকায় থেকে যান। কাশেম আলী খান বেশ নামকরা রুবাইয়ে ছিলেন। তার দক্ষতার জন্য আগরতলা রাজ্য থেকে মাসে ৫০০ টাকা ভাতা পেতেন। কাশ্মিরি ওস্তাদ ফয়জুদ্দিন খান, পাঞ্জাবি ওস্তাদ রওশন খান সারঙ্গী বাদন আর বেহাগ রাগের গানে পারদর্শিতা রেখেছিলেন। টম্পা গানের প্রথা রওশন খান থেকে প্রচলিত হয়। পাঞ্জাবি মোহাম্মদ খান ও তার ভাই কালস্নু খান ধ্রুপদি গানে সুরের কারুকার্যে পারদর্শিতা দেখাতেন। চৌধুরী বাজারের হাকিম রমজান চৌধুরী ভালো ঠুমরি বাজাতেন। ঢাকার বাসিন্দা মির আলী মেহেদী খেয়াল গাইতেন। আরেকজন খেয়াল বাদক ছিলেন মির গোলাম মোস্তফা। ঢাকার নবাব বাড়ির খাজা আব্দুর রহিম আমিম গান-বাজনা-নৃত্যে পারদশর্ী ছিলেন। খাজা শাহাজাদা উঁচুদরের কলাবিদ ছিলেন। নবাব আহসান উলস্নাহ খুব ভালো হারমোনিয়াম বাজাতে পারতেন। জয়দেবপুরের জমিদার রাজা রাজেন্দ নারায়ণ রায়, কাশিমপুরের জমিদার সারদা বাবু ভালো তবলা বাজাতেন। নবাবপুরের কিশোরী মোহন বসাক, আনন্দ বসাক, প্রসন্ন কুমার বসাক, তবলা ও পাখোয়াজ বাদনে প্রসিদ্ধতা লাভ করেছিলেন।
সাধারণ মানুষের সঙ্গীত চর্চা : উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ঢাকার প্রতি মহলস্নায় একাধিক বৈঠকখানা থাকত। কর্মব্যস্ত সাধারণ মানুষ দিন শেষে এসব বৈঠকখানায় একত্রিত হয়ে তাস, পঁচিশি, সাতরঞ্চ (দাবা), গাঞ্জেফা ও চৌসার নামে খেলায় অংশগ্রহণ করত। বৈঠকখানাগুলোয় ঢোল, তবলা, মাজেরা, সেতার, তাম্বুরা, বাঁশি, বেহালা ও হারমোনিয়াম মজুদ থাকত। সঙ্গীত চর্চাকারিরা সমবেত হয়ে সঙ্গীত চর্চা করত। কোনো নামিদামি গায়ক ঢাকায় এলে এসব বৈঠকখানায় হাজির হয়ে ফরমাইশি গান, গজল, কাওয়ালি পরিবেশন করত। এভাবে ঢাকাইয়া সোববাসরা সামাজিকভাবেও সঙ্গীত চর্চায় অভ্যস্ত ছিল।
সঙ, লাউনি, মিরাসিন : চৈত্র সংক্রান্তি, মেলা ও জন্মাষ্টমীতে ঢাকার হিন্দুরা যেমন সঙ সাজিয়ে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে স্থানীয় বাংলায় গান পরিবেশন করত। ঢাকার সোববাস মুসলমান-হিন্দুরা হিন্দুস্তানি ভাষায় সঙগান পরিবেশন করত। এটা প্রধানত পরিদৃষ্ট হতো ১ জানুয়ারি শাহবাগে ঢাকার নবাবদের বার্ষিক উৎসবে। সুদর্শন বালকরা সঙ সেজে নৃত্য পরিবেশন করত। আর তাদের দল সঙের উপযোগী সঙ্গীত পরিবেশন করত। বাদ্যযন্ত্র সহযোগে পরিবেশিত এসব গানের প্রথমেই ঢাকার নবাবদের প্রশংসা গাইতে হতো।
ঢাকার হিন্দুস্তানি ভাষায় লাউনি পরিবেশিত হতো। একেক মহলস্নার একেকটি দল থাকত। বাদ্যযন্ত্র সহযোগে লাউনি পরিবেশন বাংলা পালাগানের অনুরূপ। লাউনিতে একদল অন্যদলের গানের প্রতি উত্তর দিত। ঢাকার হিন্দুস্তানি ভাষী মুসলমানদের মধ্যে শুধু লাউনির প্রচলন ছিল। লাউনি ১৯০০ সালের পূর্বেই ঢাকা থেকে লুপ্ত হয়ে যায়।
ঢাকায় মোগল আমল থেকেই স্থানীয়ভাবে স্থায়ী মিরাশিনরা (পেশাদার মহিলা গায়িকা) বসবাস করত। বংশ পরম্পরায় মিরাশিনরা তাদের ঘরানা টিকিয়ে রেখেছিল। ১৯৬০ সালের পূর্বেই এ ধারা অবলুপ্ত হয়ে যায়। আমলিগোলা মহলস্নার সত্তুরোধর্্ব প্রবীণা সাকিয়া বানু ও হোসনি দালান মহলস্নার মতিউর রহমানের ভাষ্যমতে, সোববাস মহলস্নার বিয়ে-শাদী, সুন্নতে খাতনা, নাক ও কান ছেদনী, সাতওয়াসায় (গর্ভ উৎসব) মিরাশিনদের ভাড়া করে আনা হতো। মিরাশিন দলের মহিলা ও তরুণীরা হারমোনিয়াম, ঢোল, মন্দিরা সহযোগে গান ও নাচ পরিবেশন করত। দলের কম বয়সী মেয়ের দল গানের কথার ওপর ভিত্তি করে অভিনয়ধমর্ী নৃত্য পরিবেশন করত। এরা সাজ-সজ্জা করত ও পায়ে ঘুঙ্গুর পরত। আর অন্যদল গান পরিবেশন করত। মিরাশিন মহিলারা ধমর্ীয় সঙ্গীত, নাত, গজল ও কাওয়ালিও পরিবেশন করতে পারত। জিনের আসর বা ভাড় নামানোর জন্য মিরাশিনদের মজমায় ডেকে আনা হতো ধমর্ীয় সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য। মিরাশিনদের পরিবেশিত গানের সাথে হিন্দি ছবির প্রচলিত অনেক গানের মিল রয়েছে।
১. রাত ভারে রাইয়ো-সাবেরে চালে যাইয়ো জীঃ।
[সারা রাত থেকে সকালে চলে যেয়ো হে নাগর]
২. মেরে আঙ্গনে মে তোমহারা ক্যায়া কাম হে
জিসকে বিবি মোটি উসকে ভি ভরা নাম হে
বিসতারমে বিছালো গাদ্দীকা কা ক্যায়া কাম হে
জিসকে বিবি গোরি উসকা ভি বাড়া নাম হে
কোঠেপে লাগালো বিজলি কা ক্যায়া কাম হে
জিসকে বিবি লাম্বি উসকাভি বাড়া নাম হে
দেওয়ার পে লাগালো সিঁড়ি কা ক্যায় কাম হে
জিসকে বিবি নাটি উসকা ভি বাড়া নাম হে
গোদপে ব্যাঠালো বাচ্চাকি ক্যায়া কাম হে
[আমার ঘরে তোমার কি প্রয়োজন
যার বৌ মোটাসোটা তার খুব সুনাম রয়েছে
বিছানায় বিছিয়ে দিলে লেপ তোষকের প্রয়োজন পড়ে না।
যার বৌ ফর্সা তারও খুব সুনাম রয়েছে
ঘরে লাগিয়ে দিলে রাতে আলোর প্রয়োজন পড়ে না।
যার বৌ লম্বা তারও খুব সুনাম রয়েছে
দরজায় লাগিয়ে নিলে মইয়ের প্রয়োজন পড়ে না।
যার বৌ খাটো তারও খুব সুনাম রয়েছে
কোলে বসিয়ে নিলে বাচ্চার প্রয়োজন পড়ে না।]
৩. ঝুমকা গেরারে বারেলিকা বাজারমে-ঝুমকা গেরা রে।
শাশ মেরা রোবে, নানাদী মেরা রোবে
সাইয়াযে রোবে মেরা আখোমে রুমাল ডালকে।
ঝুমকা গেরারে বারেলিকা বাজারমে-ঝুমকা গেরা রে
শাশ মেরা পিষে, নানাদী মেরা পিষে
সাইয়া যে পিষে মেরা চাককি মে গেওয়ার ডালকে।
[বেরিলির বাজারে আমার ঝুমকা হারিয়ে গেছে
(এই কারণে) শাশুড়ি বিলাপ করছে, ননদী বিলাপ করছে
স্বামী বিলাপ করছে চোখে রুমাল দিয়ে।
বেরিলির বাজারে আমার ঝুমকা হারিয়ে গেছে
(এই কারণে) শাশুড়ি আমাকে নির্যাতন করছে, ননদী নির্যাতন করছে
স্বামী নির্যাতন করছে যেমন করে যাতায় গম পিষা হয়।]
মেয়েদের গীত ও বিয়ের গান : হাকিম হাবিবুর রহমান উলেস্নখ করেন, "সমগ্র হিন্দুস্তানের মতো ঢাকায়ও বিবিসাহেবগণ উৎসবসমূহে গান গাইতেন। ঘরোয়া গানের আসরে একমাত্র ঢোল বাজানো হতো। পরবতর্ীতে এর সাথে হারমোনিয়ামও সংযুক্ত হয়।" সোববাস মহিলারা বাড়িতে বাড়িতে একমাত্র হিন্দুস্তানি ভাষায় সঙ্গীত পরিবেশন করত। কোনো পরিবারের ছেলে বা মেয়ের বিবাহ পর্ব আসলে এর ১৫ দিন আগ থেকে প্রতিদিন রাতে পরিবারের মহিলারা একত্রিত হয়ে গানের আসর জমাত। এর মধ্য দিয়ে মহলস্নাবাসী বুঝতে পারত ওই বাড়িতে বিয়ের পর্ব আসন্ন। প্রতিদিন বিয়ের গানের সূচনা হতো নাত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। এমনই একটি নাতের প্রথম লাইন, "আজ দুলহা বানেগে হামারা নাবী"। [আজ বর সাজে সাজবে আমার নবী]।
বিয়ের গানের কয়েকটি লাইন-
১. দিল ঘাবরাতা হ্যায় আন্দারসে
যারা উনকো বুলাদো বাহারসে।
[আমার মন আনচান করছে
এ কথা আমার প্রেমিককে জানিয়ে দাও।]
২. দুলহা ইয়া দুলহান
বেলা চামেলী
আরশকা তারা চামাক রাহা হ্যায়।
[বর এবং কনে
বেলি ও চামেলী ফুল সাদৃশ্য
যেমন আকাশের তারা ঝলমল করছে।]
কাসিদা : মোগল সংস্কৃতির অংশ হিসেবে ঢাকায় কাসিদার আবির্ভাব ঘটে। রাজবন্দনা, আলস্না-নবীর বন্দনা, বিভিন্ন ধমর্ীয় পর্বের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব প্রকাশ করা হয় কাসিদার মাধ্যমে। প্রথমে এটা ফারসি ও উদর্ুতে রচিত হলেও পরে ঢাকার স্থানীয় হিন্দুস্তানি ভাষায় কাসিদার প্রচলন হয়। উনিশ শতকের পর ঢাকায় রমজান মাসে সেহরির সময় কাসিদা পাঠ করে রোজাদারদের ঘুম ভাঙানোর প্রথার সূচনা ঘটে। কাসিদা সম্পূর্ণ মুসলিম পর্ব। উনিশ শতকের শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত পুরনো ঢাকায় রমজান ও ঈদকে কেন্দ করে কাসিদার চর্চা অব্যাহত রয়েছে। সামপ্রতিককালে বাংলা ভাষায় কাসিদার চর্চা শুরু হয়েছে।
রমজানের কাসিদা তিন ভাগে বিভক্ত- ১. চান রাতি আমাদ : রমজান মাসকে স্বাগত জানানো হয় এর মাধ্যমে, ২. খোশ আমদিদ : রমজানের মধ্যভাগ পর্যন্ত রমজানের গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়, ৩. আল-বিদা : রমজান মাসকে বিদায় জানানো হয় বিরহমূলক কাসিদার মাধ্যমে। যেহেতু হযরত আলী রমজানের ১৯ তারিখে খঞ্জরবিদ্ধ হন এবং ২১ রমজান ইন্তেকাল করেন তাই আল-বিদা কাসিদায় হযরত আলীর শোকগাঁথা পরিবেশিত হতো। এছাড়া ছিল ঈদের কাসিদা। ঈদ উৎসব ও ঈদ মিছিলে খুশির ফোয়ারা ছুটতো ঈদের কাসিদায়। কাসিদায় একজন লোকমাদার (মূলগায়ক) থাকে। তার কথা শেষ হলে দলবদ্ধভাবে কোরাস গাওয়াই হলো কাসিদার রীতি। ঢাকায় হারিয়ে যাওয়া কাসিদা নামক প্রবন্ধে শায়লা পারভিন যে তথ্য উপস্থাপন করেছেন তাতে কিছু ভুল তথ্য রয়েছে। পাকিস্তান আমলে উদর্ুভাষী মোহাজেররা ঢাকায় এসে শের-শায়রি গজল কাসিদা কাওয়ালিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেও তারা হিন্দুস্তানি ঢাকাবাসীদের সমাজের সাথে মিশতে পারেনি। স্থানীয় ঢাকাইয়ারা তাদের মাউরা বা বিহারি বলে হেয় জ্ঞান করত। মুক্তিযুদ্ধের পরবতর্ী দুই বছর কাসিদা প্রতিযোগিতা বন্ধ ছিল এ তথ্যও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। মুক্তিযুদ্ধ পরবতর্ী দুই বছর ঢাকার ভাট মসজিদ মহলস্না ও আগানওয়াব দেউরির মহলস্নার জুম্মন মিয়া কাসিদা প্রতিযোগিতা করেছিলেন।
কয়েকটি কাসিদা :
১. কাসিদা আল-বিদা : অংশ বিশেষ :
আয় ত্রিশ দিনকে মেহমা
আয় মাহে রমজা আল-বিদা
তুঝে সে থি সারি খুবইয়া
আয় মাহে রমজা আল-বিদা
তু হ্যায় নুযুলে মাগফেরাত
তু হ্যায় নুযুলে মুরতুজা
তু হ্যায় জাহান্নাম কি আসা
মাহে রমজা আল-বিদা।
[হে ত্রিশ দিনের মেহমান
তোমাকে বিদায় সম্ভাষণ
হে রমজান মাস
তোমাকে বিদায় সম্ভাষণ
তোমার ভিতর ছিল সব ধরনের মাহাত্ম্য
হে রমজান মাস তোমাকে বিদায় সম্ভাষণ
তুমি ছিলে ক্ষমার,
তুমি ছিলে মর্যাদার,
তুমি ছিলে জাহান্নাম থেকে মুক্তির
হে রমজান মাস তোমাকে বিদায় সম্ভাষণ।]
২. কাসিদা আল-বিদা : অংশ বিশেষ
যা ফের আনা বাহারোকো লেকার
আল-বিদা আয়, নিশাতে মানোয়ার
তেরে দামসে হ্যায় রুহে আফজাল
আয় নিশাতে মানোয়ার।
কাত্লে হো কার ভি শাহ্ ক্যা
ক্যায়া সাকাওয়াত।
কাতেলো কো ভেজা হাযরাত নে সারবাত।
আয় নিশাতে মানোয়ার
[(হে রমজান মাস) আবার ফিরে এসো বসন্ত সাথে নিয়ে
বিদায় সম্ভাষণ হে সুন্দরের প্রতীক
তোর মধ্যে রয়েছে পরিপূর্ণ আলোকচ্ছটা
বিদায় সম্ভাষণ হে সুন্দরের প্রতীক
আঘাতপ্রাপ্ত হয়েও বাদশাহ্-এর (হযরত আলী) কি মহানুভবতা
খুনিকে পাঠাল হযরত (ইফতারের জন্য) শরবত
বিদায় সম্ভাষণ হে সুন্দরের প্রতীক]
৩. কাসিদা ঈদ : অংশ বিশেষ
ঈদ আয়ি হারতারাফ
এশরাতকা সামা হোগিয়া
কিয়া গালে মিলমিলকে খোশ
হার মুসলমা এক হোগিয়া।
হো গায়্যি হ্যায় রোজায়ে
এলাহি মে কাবুল
আতি হ্যায় হার সেনতেসে
আলস্নাহ্ আকবর কি সাদা
ঈদ আয়ি হারতারাফ।
[ঈদ এসেছে চারিদিক উজ্জ্বল করে
ঐক্যের সময় হয়ে গেছে
খুশিতে গলায় গলা মিলিয়ে
সকল মুসলমান এক হয়ে গেছে
আলস্নার কাছে রোজা কবুল হয়ে গেছে
তাই চতুর্দিক থেকে আলস্নাহু আকবর ধ্বনি শোনা যাচ্ছে
ঈদ এসেছে চারদিক উজ্জ্বল করে।]
কাওয়ালি : কাওয়ালি মূলত সুফি সঙ্গীত এবং ভারতই হলো এই সঙ্গীতের উৎপত্তিস্থল। খাজা মইনুদ্দিন চিশতির অনুসারীরা চিশতিয়ার তরিকায় কাওয়ালির মাধ্যমে আলস্নাহ্, রাসূল, মুর্শিদের প্রেম-বিরহ গাঁথা পরিবেশন করে। ইসলামের ইতিহাসের অনেক বিয়োগান্তক ও ঐতিহাসিক কাহিনী কাওয়ালিতে বিবৃত হয়। এ ভাবসঙ্গীত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত থেকে উৎসরিত। হাকিম হাবিবুর রহমান জনশ্রুত স্মৃতি থেকে বলেছেন, "ওস্তাদ আমির খসরু দীর্ঘদিন ঢাকায় অবস্থান করেছিলেন।" আমির খসরুই কাওয়ালিকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সে সূত্রে ঢাকায় তার শিষ্য-সামন্ত থাকারই কথা। যারা যুগ যুগ ধরে কাওয়ালি চর্চাকে ধরে রেখেছিল। অন্যদিকে সুবেদার ইসলাম খাঁ চিশতি ছিলেন সম্রাট আকবরের পীর সাহেব ফতেপুর সিক্রি নিবাসী হযরত সেলিম চিশতির পুত্র। সে ঘরানার রেশ ধরেও ঢাকায় কাওয়ালি প্রথিত হওয়ার কথা। চিশতিয়ার তরিকায় প্রায় ৮০০ বছরের ধারাবাহিকতা হিন্দুস্তানি ভাষাভাষী সমৃদ্ধ ঢাকায় সহস্রাধিক পীর-দরবেশের আগমন ঘটেছে। তাদের দরগা খানকায় দিবারাত্রী কাওয়ালি চর্চার সুবাদে ঢাকাবাসীরাও কাওয়ালির ভালো সমঝদার হয়ে উঠেছিল। খাজা বাবার ওরস ও বিয়ে-শাদি উৎসবে কাওয়ালি প্রতাপের সাথে টিকে ছিল ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত। আরবি, ফারসি, উদর্ু ও হিন্দিতে কাওয়ালি পরিবেশিত হতো। এখন কাওয়ালির বাংলা রূপান্তর ঘটেছে, তবে সুর তাল বোলে আগের ধারা ধরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।
একটি কাওয়ালির বর্ণনা নিম্নরূপ :
কাওয়ালি-নাত :
ইয়া মোহাম্মদ! ইয়া মোহাম্মদ! ইয়া মোহাম্মদ!
তুম দূর হো নাজারো সে
ক্যায়া লুতফো হ্যায় জিনেমে
পার ওয়ানা ইহা তারপে,
জ্বালে সাম্মে মাদিনে মে।
তাইবা মুসাফির কা শাবান সাফার এ হ্যায়
মাইসুস হ্যায় কুদওয়াকা উম্মতকা সাফিনে মে।
তুম দূর হো নাজারো সে ঃ।
হাম ডুব নাহি সাকতে, এই আখ্ কি সামান্দার মে
আখমে হ্যায় সাকালে নাবী, কোরআন সিনে মে।
তুম দূর হো নাজারো সে ঃ।
মেশ্ক, গোলাপ, আম্বার, জুহি বেলা সান্দাল
হার ফুলো কি খাশবু হ্যায় তেরে পাসিনে মে
[হে মোহাম্মদ, তুমি দৃষ্টিসীমার অনেক দূরে রয়েছ
তাই আমার বেঁচে থাকা মূল্যহীন।
(যেমন)- পতঙ্গ এখানে ছটফট করছে
(অথচ) প্রদীপ জ্বলছে মদিনায়।
এই মুসাফিরের এই খুশির সফরের (জিয়ারতের) এটাই উদ্দেশ্য
যাতে উম্মত হিসেবে তিনি (মোহাম্মদ) আমাকে শাফায়াত করেন।
আমি এই (প্রেমের) অগি্ন সমুদ্রে ডুবতে পারছি না।
আমার চোখে হে নবী তোমার রূপ প্রতিভাত হচ্ছে।
আর হূদয়ে রয়েছে আল কোরআন।
মেশ্কে আম্বার (কস্তুরি), গোলাপ, জুঁই, বেলি, চন্দন
সব সুগন্ধই তোমার শরীরে ঘামের সুগন্ধে রয়েছে।]
গজল : হিন্দুস্তানি হিন্দি ও উদর্ু ভাষায় রচিত শায়েরসমূহকে সুরারোপ করার মাধ্যমে গজলের উৎপত্তি হয়েছে। ক্ল্যাসিক কবিতা বুঝতে যেমন পাঠককে বোদ্ধা হতে হয়, তেমনি গজল বুঝতে হলে শ্রোতাকে সমঝদার হতে হয়। শায়ের ও গজল হূদয়াঙ্গম করার মধ্যেই এর রচনা, পরিবেশন, শ্রবণের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়। শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফর একজন উচ্চস্তরের শায়েরি ছিলেন। মোগল ঘরানায় ও ভারতীয় অভিজাতদের মধ্যে শায়ের ও গজল চর্চা ধারাবাহিকভাবে প্রচলিত ছিল। ঢাকায় উনিশ শতকের শেষ দিকে আবাদ আজিমাবাদী, ইয়াজদানি লাহোরি, মির্জা গাওহর আলী, মীর্জা ফিরোজ আলী, হাকিম হাসান মীর্জা হারাক ও আহামদ হোসেন ওয়াফের নাম করা গজল রচয়িতা ছিলেন। ঢাকায় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ঘরানার শিল্পীরা গজল পরিবেশন করতেন। সে সময় তাওয়ায়েফদের মধ্যে হিরার কন্যা পান্না গজল গেয়ে অনেক নাম করেছিলেন।
তখনকার ঢাকায় পরিবেশিত একটি জনপ্রিয় গজলের কয়েকটি লাইন।
"বেতাবী কাহ রাহিহে
চালো কুয়ে ইয়ার মে,
সীমাব কি তারাপ হ্যায়
দেলে বেকারার মে।"
[অস্থির হূদয় বলছে চলো প্রেয়সীর গলিতে
পারদের অস্থিরতা আমার ব্যাকুল হূদয়ে বিদ্যমান।]
ঢাকার মহররমের মিছিল : মহররম পবিত্র আশুরা। এ দিনটি মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা পবিত্র এ দিনে সংঘটিত হয়েছে বলে হাদিসে বর্ণনা করা হয়েছে। ইসলামপূর্ব যুগেও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা এ দিনকে পবিত্র দিন হিসেবে পালন করত।
মহানবী (সাঃ)-এর প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ) ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে পবিত্র আশুরার দিন বর্তমান ইরাকের কুফা নগরীর সনি্নকটে কারবালায় অগণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত স্বঘোষিত খলিফা ইয়াজিদের সৈন্যবাহিনী কতর্ৃক নির্মমভাবে শাহাদাৎবরণ করেন। সেই দিন এবং তৎপূর্ব কয়েক দিনে অসম যুদ্ধে ইয়াজিদের সৈন্যবাহিনী কতর্ৃক হোসাইন (রাঃ)-এর অনুগত অসংখ্য অনুসারী ও পরিবার সদস্যবর্গ অনুরূপ শাহাদাৎবরণ করেন। এ মর্মান্তিক ঘটনা মুসলমানদের জীবনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। ফলে, সিয়াতে আলী বা শিয়া নামে মুসলমানদের মধ্যে ভিন্ন মতের জন্ম নেয়। এছাড়া সুন্নী মুসলমানরাও এ দিনটিকে যথাযথ মর্যাদায় পালন করে। কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনার পর পূর্বাপর ঘটনাগুলো ছাপিয়ে সমগ্র মুসলমানদের কাছে এ দিনটি শোকের দিনে পরিণত হয়।
মোগল আমলে ঢাকায় স্থাপিত হয়েছে অনেক শোকগৃহ যা ইমামবাড়া বা মোকবরা নামে পরিচিত। মোগল আমলে সুবেদার শাহ্ সুজার আমলে নিজামতের দারোগা মীর মুরাদ ১৬৪২ সালে ঢাকায় স্থাপন করেন হোসেনী দালান (স্বপ্ন দ্রষ্ট হয়ে)। যা বর্তমানে হোসেনী দালান মহলস্নায় অবস্থিত এবং এর পূর্বেই ১৬০০ সালে সূত্রাপুর এলাকার বিবিকা রওজা হযরত মা ফাতেমা (রাঃ) স্মৃতিগৃহ স্থাপিত হয়েছিল।
মোগল আমল থেকে ১০ মহররম ধমর্ীয় শোক মিছিল (জুলুছ) বের হওয়ার রেওয়াজ চালু হয়েছে ঢাকা শহরে। যাকে বলা হয় মঞ্জিলের (শেষ) মিছিল। এর আগে দুটি মিছিল বের হয়, তাহলো মহররমের ৮ তারিখে সামরাত কি মিছিল (সন্ধ্যার মিছিল)। ৯ তারিখে ভোররাত কি মিছিল (ভোর রাতের মিছিল)। মহররমের ১০ তারিখ সকালে প্রধান মিছিলটি বের হয় হোসেনী দালান ইমামবাড়া থেকে।
হোসেনী দালান ইমামবাড়া থেকে যে মিছিলগুলো বের হয় তার নিয়ন্ত্রণভার ঢাকাইয়া শিয়া ও সুন্নীদের কাছে আর ফরাশগঞ্জের মিছিল সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করে সুন্নী মুসলমানরা। বর্তমানে ইরান থেকে আগত একজন শিয়া ইমাম হোসেনী দালানে সারা বছর মসলিশ ও আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ঢাকাইয়া শিয়াদের পরিচালিত করেন। ঢাকাইয়া শিয়াদের অধিকাংশ বর্তমানে হোসেনী দালান মহলস্না ও সাতরওজা মহলস্নায় অবস্থান করে। ঢাকার আদি পশ্চিমা (হিন্দুস্তানি ভাষী) হিন্দুরাও পবিত্র মহররমের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালন করে। ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর শোক পালন করতে গিয়ে ঢাকার শিয়া ও সুন্নীরা যে সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান পালন করে তার কিছু বর্ণনা নিম্নে উলেস্নখ করা হলো :
আখড়া : পুরনো ঢাকার নবাবগঞ্জ, গোরে শহীদ, মির্জ্জা মান্নার দেউড়ি, রহমতগঞ্জ, উদর্ু রোড, জিন্দাবাহার, নিমতলী, বংশাল এলাকার লোকজন (যাদের সংখ্যা এখন অনেক কমে গেছে) মহররম মাস শুরু হলে আখড়া (ক্যাম্প) স্থাপন করত। তারপর লাঠি, ঢোল, তরবারি, বর্শা, অগি্নগোলকের চরকি বানিয়ে নিজ নিজ মহলস্নার অলিগলি প্রদক্ষিণ করে, তাজিয়া তৈরি ও ১০ মহররমের সিনি্নর পয়সা সংগ্রহ করত। এ সময় তাদের রূপকযুদ্ধের মহড়া চলতে থাকে। ৮, ৯ ও ১০ তারিখের ইমামবাড়ার মিছিলের সম্মুখভাগে ঢোলের শব্দে তারা রূপকযুদ্ধের মহড়া দেয়। লাঠির লড়াই, তলোয়ার ও বর্শার লড়াই অগি্নগোলকের চাকতি ঘোরানোর কসরৎ দেখে মুগ্ধ হতে হয়। বিভিন্ন লড়াইয়ে অনেকে বিশেষভাবে পারদশর্ী হয়ে ওঠে। তারা মিছিলে অংশগ্রহণের সময় সবুজ গেঞ্জি পরিধান করে। তারা ১ থেকে ১০ মহররম পর্যন্ত মাছ ও পান খাবে না। মাথায় তেল দেবে না এবং দাড়ি ও নখ কামাবে না। সিনি্নর পয়সা দিয়ে খিচুড়ি তৈরি করবে এবং সবুজ ও লাল বর্ণের কাগজ দিয়ে তাজিয়া তৈরি করে মিছিলে বহন করবে। বংশানুক্রমে ও মানতের মাধ্যমে তারা আখড়ার অন্তর্ভুক্ত হয়।
হোসেন কা বদ্দি : নিঃসন্তান দম্পতিরা সন্তানের আশায় হোসেনী দালানে গিয়ে মানত করে তাদের সন্তান হলে তাকে বদ্দি বানাবে। শিশু বয়সী ছেলে-মেয়েদের কঠিন অসুখ হলেও বাবা-মায়েরা রোগ মুক্তির জন্য বদ্দি বানাবার নিয়ত করে থাকে। এসব 'হোসেনের ভিক্ষুকরা' মহররমের প্রথম ১০ দিন গলায় সবুজ রঙের ফিতা ও সবুজ কাপড় ধারণ করে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবুজ কাপড়ে ঢাকা পাত্রে ভিক্ষা করে বেড়ায়। সংগৃহীত পয়সা ও চাল দিয়ে ১০ মহররমের খিচুড়ি রান্না করে বিতরণ করে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তারা আখড়াকারিদের নিয়ম পালন করে।
বেহেশতা বা আলমে বারদার : তারা মহররমের মিছিলসমূহে সবুজ ও লাল পতাকা বহন করে এবং ধর্মযুদ্ধের সৈনিকদের বেশ ধারণ করে। মানত ও বংশানুক্রমে বেহেশতার সংখ্যা নির্ধারিত হয়। বেহেশতারা চারটি দলে বিভক্ত হয়ে থাকে, প্রত্যেক দলে একজন সর্দার (নেতা) নির্ধারিত হয়। এই সর্দাররা আমৃতু্য এ পদে বহাল থাকেন। মহররমের ৬ তারিখে তারা হোসেনী দালান ইমামবাড়ায় খিমা (তাঁবু) স্থাপন করে। প্রত্যেক গোত্রের সদস্যরা তাঁবুতে সমবেত হয় এবং সিনি্ন হিসেবে লাড্ডু নিয়ে যায়। একে বলে কায়েসকা লাড্ডু। এই লাড্ডু যে কোনো মনোবাঞ্ছা পূরণের লক্ষ্যে খেতে হয় এবং নিয়ত পূর্ণ হলে পরের কায়েসের দিন খিমায় লাড্ডু দিতে হয়। এই বেহেশতারা মিছিলে অংশগ্রহণের সময় বাদক দল নিয়ে যায়, তারা যুদ্ধ সঙ্গীত বাজায়। তারা মিছিলে নারা (শেস্নাগান) দেয়। নারাগুলো এরূপ- "এক নারা হায়দারিয়া-বোলো ইমাম কি লাস্কার-ইয়া হোসেন। দো-নারা আব্বাসীয়া-বোলো ইমাম কি লাস্কার ইয়া হোসেন। এক-নারা দো-নারা, নারা-নারা বেহেশতা-ইয়া হোসেন।"
সন্তান ভূমিষ্ঠের পূর্বে সন্তানের সুস্থতা ও মঙ্গলের আশায় পিতা-মাতা হাত বান্ধার নিয়ত করে হোসেনী দালানে গিয়ে। সন্তানের বয়স এক বা দুই বছর পূর্ণ হওয়ার পর মহররমের ৬ তারিখ সকালে ইমামবাড়ায় গিয়ে ইমামের মাধ্যমে সন্তানের হাতে জরির [ইমাম হোসাইন (রাঃ) ও ইমাম হাসান (রাঃ) এর জোড়া কবরের নকশা] সাথে বাঁধা সুতলি বেঁধে দেয়। তারপর বেহেশতা ও বাদক দল সমবিহারে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শরবত বিতরণ করে এবং সিনি্নর টাকা সংগ্রহ করে।
কাসেদ : তারা ইমাম হোসেনের বার্তা বাহকের নামে পরিচিত, সারাগায়ে মোটা সাদা/কালো ও সাদা/সবুজ সুতলির মধ্যে অসংখ্য ঘণ্টা লাগিয়ে শরীরে পঁ্যাচ দিয়ে রাখে। তাদের বেহেশতাদের অনুরূপ নিয়ম পালন করতে হয়। তবে তাদের দ্রুতগতিতে দলবদ্ধভাবে মিছিলে হাঁটতে হয়।
মোগবরা : নিজ নিজ বাড়িতে মোগবরা স্থাপন করে, মহররম মাসের প্রথম ১০ দিন এসব বাড়িতে সন্ধ্যার পর মোগবরায় মোমবাতি, আগরবাতি জ্বালানো হয়। ইমাম হোসেনের ভক্ত বধূ, মাতা, কন্যারা এই মোগবরার চতুর্দিক ঘুরে জারি পিটাত (সুর করে শোকগাঁথা গায়) এবং ১০ মহররম খিচুড়ি বিতরণ করে।
মার্সিয়া : পুরনো ঢাকার প্রতিটি মহলস্নায় মার্সিয়া দল গঠন করা হতো। তারা নিজ ভাষায় (হিন্দুস্তানি) মার্সিয়া রচনা করত এবং পালাক্রমে হোসেনী দালানে গিয়ে দলবদ্ধভাবে মার্সিয়া গাইত। বর্তমানে এই ধারা লুপ্ত হয়ে গেছে। এছাড়া ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম অনুযায়ী মঞ্জিলের মিছিলে কেউ জরি (ইমামদের কবর) কেউ গাঞ্জে শাহিদান (শহীদদের গণকবর), কেউ বিবিকা ডোলা (ইমামের পরিবারে মহিলাদের পালকি), কেউ ধমর্ীয় পতাকা, কেউ পাঞ্জা (ইমামের হাতের নকশাধারী পতাকা) বহন করে। তাছাড়া অনেকে নিয়ম অনুযায়ী দুলদুল ঘোড়া (যে ঘোড়ায় ইমাম যুদ্ধ করেছিলেন) ও খুনি ঘোড়া (যে ঘোড়ায় ইমামের পবিত্র মস্তক বহন করা হয়েছিল) তার দড়ি ধরে থাকে। কেউ মিছিল দেখার মানত করে। আশুরার দিন বিকেলে ফরাশগঞ্জ থেকে বোলদা গৌড়াকি মিছিল বের হয়। এই মিছিলে তাজিয়া ও একটি বিবিকা ডোলা (মা ফাতেমার পালকি) থাকে। মিছিলকারিরা শুধু গেঞ্জি পরে তাজিয়া নিয়ে দৌড়ায়। অনেকে সকাল-বিকেলের মিছিলে তাজিয়াগুলোয় মানত অনুযায়ী মুরগি ও কবুতর নিক্ষেপ করে এবং শেরাসিনি্ন (শলা দিয়ে তৈরি) নিক্ষেপ করে।
আশুরা উপলক্ষে হোসেনী দালান এলাকায় ও আজিমপুরে বিরাট মেলা বসতো। আজিমপুরে মহররমের মেলা ঢাকা অঞ্চলের সর্ববৃহৎ মেলা। ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত ভিস্তিরা মিছিলকারিদের মধ্যে পানি ও শরবত বিতরণ করত। পাকিস্তান আমলে বিভিন্ন পাড়া-মহলস্না থেকে শরবত বহনকারী গাড়ি মূল মিছিলকে অনুসরণ করে মিছিলকারী জনসাধারণের মধ্যে শরবত বিতরণ করত এবং এ নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা হতো।
আগে মহররমের সকল মিছিল আজিমপুরে (একটি মাঠের নাম ছিল কারবালার) গিয়ে শেষ হতো এবং মাঠ সংলগ্ন পুকুরে অস্থায়ীভাবে নির্মিত কাঠামোগুলো বিসর্জন দেয়া হতো। ঢাকার মুসলমানরা মহররম মাসে বিয়ে-শাদি ও আনন্দ উৎসবাদি বর্জন করে চলত। প্রায় সব বাড়িতে কোরআনখানি, মিলাদ মাহফিল, সিনি্ন, পোলাও-খিচুড়ি, মিষ্টি বিতরণ হতো। পেস্তা দিয়ে সুস্বাদু শরবত তৈরি করা হতো। কুরবানির মাংস বিশেষভাবে রান্না করে সংরক্ষণ করা হতো। আশুরার দিন এই মাংস দিয়ে খিচুড়ি রান্না হতো। পুরান ঢাকার বনেদী পরিবারগুলোয় এ ধারা এখনো বিদ্যমান আছে।
আশুরার দিন কোনো বাড়িতে নাস্তা তৈরি করা হতো না। আজিমপুরের মেলা থেকে খৈ, উখরা, বাতাসা ও পাতা খিরসা কিনে এনে সবাই নাস্তা করত। মহররমের মেলা থেকে কেনাকাটা করে শ্বশুরবাড়িতে ডালা পাঠানো অনেকটা নিয়ম হয়ে গিয়েছিল নতুন জামাইদের জন্য।
নাওয়া : মহররমের মিছিলে মাতম চলাকালে শিয়া সমপ্রদায় যে মার্সিয়া পাঠ করে তাকে নাওয়া বলা হয়।
প্রচলিত নাওয়ার একটি বিবরণ :
হায় হোসেন জান, হায় হোসেন জান, হায় হোসেন জান।
কারবালা কার্ব কা মাঞ্জিল এ সাদা আতি হ্যায়
কোয়ি মা রোকে হামে সায়কা গাম শুনাতি হ্যায়
কিসি বেওয়াও ইয়াতিম কি ফুর্গা আতি হ্যায়,
হায় হোসেন জান, হায় হোসেন জান, হায় হোসেন জান।
দিল সাকিসতা হ্যায় মেরা
আউর ম্যায় হু খাসতাতান
তেগ্ খাঞ্জার সে মেরে
বেটে কা জাখমি হ্যায় বাদান
রেত জাখমোমে লাগে
তো ফির হার রায়ে বাদান
হায় হোসেন জান, হায় হোসেন জান, হায় হোসেন জান।
বাপকে সিনেপে বাচ্চি জো শোয়া কারতিথি
কায়েদ খানামে বহুত হ্যায় রোইয়া কারতিথি
বাপকে শারকো লিয়ে
হিচকিয়া লেকে কাহা
হায় হোসেন জান, হায় হোসেন জান, হায় হোসেন জান।
গোদ উজাড়া হ্যায় মেরা
মাঙ্গ ভি উজাড়া লোগো
শের চাদার ভি ন্যাহি
হাত বান্ধা হায় লোগো
বানু কি হায় এ সাদা
তুঝপে রোতি হ্যায় কাজা
হায় হোসেন জান, হায় হোসেন জান, হায় হোসেন জান।
সিনে পে খায় সিনা হ্যায়
জোয়া শোয়া হ্যায়
জিসপে কারবালা কি জামি
আউর ফালাক রোইয়া হ্যায়
উসকি যাখমোনে কাহা
ছালনি হ্যায় সিনা তেরা
হায় হোসেন জান, হায় হোসেন জান, হায় হোসেন জান।
বে-খাতা, বে-হিূদা মুঝকো
কিয়া হ্যায় কিউ তুমনে
দারবাদার নানা ফিরায়া হ্যায়
মুঝে উম্মাত নে
রোকে জায়নাব নে কাহা
বে-কাফান ভাই মেরা
হায় হোসেন জান, হায় হোসেন জান, হায় হোসেন জান।
লিখো আজাম পারো পারভেজ
সাদা হায় হোসেন
আউর পুরসাদো উনে
শায় পে জো কারতে হ্যায় বায়েন
যাহা হো ফারসে আজা
উহা আতি হ্যায় সাদা
হায় হোসেন জান, হায় হোসেন জান, হায় হোসেন জান।
[বেদনা বিধূর কারবালার স্মৃতি বারবার ফিরে আসলেই,
কোনো মা (বিবি ফাতেমা) আমাকে ইমাম হোসেনের
শোকগাঁথার বিলাপ শোনায়
একাধিক বিধবা ও একাধিক এতিমের ক্রন্দন ধ্বনি
কানে শোনা যায়
প্রাণপ্রিয় ইয়া হোসেন! প্রাণপ্রিয় ইয়া হোসেন! প্রাণপ্রিয় ইয়া হোসেন।
আমার হূদয় বেদনা বিধূর এবং আমি শোকে আপস্নুত
তেগ ও খঞ্জরের আঘাতে আমার পুত্রের শরীর ক্ষত-বিক্ষত
তপ্ত বালি কণিকা ক্ষতস্থানে লাগলে সে শরীর ছটফটিয়ে ওঠে
প্রাণপ্রিয় ইয়া হোসেন! প্রাণপ্রিয় ইয়া হোসেন! প্রাণপ্রিয় ইয়া হোসেন।
যে পিতার (ইমাম হোসেন) বুকে শিশু ঘুমাত
সে শিশু (ইয়াজিদের) বন্দিশালায়
বাবার জন্য অনেক কান্নাকাটি করত
তখন পিতার মস্তক এনে দেখালে
সে শিশুর কান্নায় হেচকি উঠলো
প্রাণপ্রিয় ইয়া হোসেন! প্রাণপ্রিয় ইয়া হোসেন! প্রাণপ্রিয় ইয়া হোসেন।
হে লোক সকল শোনো, আমার কোল উজাড় হয়েছে
আমার মাথার সিঁদুর মুছে গেছে
আমার মাথার চাদর খুলে ফেলেছে
এবং আমার হাত বেঁধে রেখেছে
বানু (শায়ের বানু ইমাম হোসেনের স্ত্রী)-এর একি করুণ অবস্থা
যা দেখে মৃতু্যরও কাঁদতে ইচ্ছে করে
প্রাণপ্রিয় ইয়া হোসেন! প্রাণপ্রিয় ইয়া হোসেন! প্রাণপ্রিয় ইয়া হোসেন।
বুকে নেজার আঘাত খেয়ে হায়
যুবক (ইমাম হোসেন) শুয়ে আছে
এতে কারবালার জমিন ও আকাশ কাঁদছে
তার (ইমাম হোসেন) শরীরের আঘাতসমূহ বলছে
আপনার বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেছে
প্রাণপ্রিয় ইয়া হোসেন! প্রাণপ্রিয় ইয়া হোসেন! প্রাণপ্রিয় ইয়া হোসেন।
বিনা দোষে কেন আমাকে বেইজ্জত করলে তোমরা
শহরের দ্বারে দ্বারে ঘুরিয়েছে
হে নানা (হয়রত মোহাম্মদ দঃ) তোমার উম্মতেরা
কেঁদে কেঁদে জয়নাব (ইমাম হোসেনের বোন) বলে
আমার ভাইকে কাফনও পরানো হলো না
প্রাণপ্রিয় ইয়া হোসেন! প্রাণপ্রিয় ইয়া হোসেন! প্রাণপ্রিয় ইয়া হোসেন।
আজম লিখো এ কথা আর পারভেজ পাঠ করে শোনাও
আর তাদের প্রতি সমবেদনা জানাও
যারা ইমাম হোসেনের জন্য মাতম করে
যেখানে শোকের চাদর বিছিয়ে শোকার্ত মানুষের মুখে
সব সময় আওয়াজ আসে
প্রাণপ্রিয় ইয়া হোসেন! প্রাণপ্রিয় ইয়া হোসেন! প্রাণপ্রিয় ইয়া হোসেন।]
ঢাকায় সোববাসদের থিয়েটার চর্চা
থিয়েটার চর্চায় হিন্দুস্তানি ভাষী ঢাকাইয়ারা বিপুল সফলতা লাভ করেছিল। হিন্দুস্তানি ও উদর্ু ভাষায় নাটক রচনা, পরিচালনা ও অভিনয় কলায় যতটা তারা উৎকর্ষতা লাভ করেছিল এ ধারা অব্যাহত থাকলে শুধু থিয়েটারের কল্যাণেই সোববাস ঢাকাইয়াদের ভাষা ও সংস্কৃতি বেঁচে থাকতে পারত। এক্ষেত্রে ঢাকার নবাববাড়ীর খাজা সাহেবরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। ঢাকার মুসলমান অভিজাতরাও এর পৃষ্ঠপোষক ছিল। এই থিয়েটারের দোলা জয়দেবপুরের জমিদার বাড়ির আঙিনা পর্যন্ত পেঁৗছেছিল। সোববাসদের থিয়েটার চর্চাকাল ছিল উনিশ শতকের শেষ ভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত। মুসলমান জমিদার নবাব ও ঢাকার নবাব নাজেমদের পরিবারে ও দাফতরিক ভাষা হিসেবে উদর্ু ও ফার্সি ভাষার চর্চা বিদ্যমান ছিল। হাকিম হাবিবুর রহমান সোববাসদের থিয়েটার চর্চার কথা বিশদভাবে উলেস্নখ করে বলেছেন, "কানপুরের বাসিন্দা শেখ ফয়েজ বখস যিনি ঢাকায় এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন তিনি ফরহাত আফযা কোম্পানি নামে একটি থিয়েটার কোম্পানি স্থাপন করলে ওই সময় (ঢাকায়) হিন্দুস্তানি তাওয়ায়েফগণ এবং স্থানীয় নর্তকিরা বেশি পরিমাণে ছিল। শেখ জী শুধু নর্তকিদের নিয়ে একটি থিয়েটার দল তৈরি করলেন। তারা মহিলা পুরুষের অভিনয় করত। কানপুরের বাসিন্দা নওয়াব আলী নাফিস নাটক লেখা আরম্ভ করলেন। তিনি প্রায় ৪০টি নাটক রচনা করলেন। যার মধ্যে প্রায় ৩০টি নাটক মঞ্চস্থ হলো। দুটি নাটকের পুস্তকও মুদ্রিত হয়েছিল। কানপুরের শেখ পীর বখস রচিত ও পরিচালিত 'নাগর সভা' মঞ্চস্থ হলো। এ সময় ইমামগঞ্জ মহলস্নাবাসী 'হোসেন আফরোজ' নামে একটি জনপ্রিয় নাটক মঞ্চস্থ করল। এই নাটকে সঙ্গীতের আধিক্য ছিল। ফুলবাড়ীয়া মহলস্নাবাসী 'গুলশানে জাফিয়া' মঞ্চস্থ করল। এর রচয়িতা ও পরিচালক ছিলেন হাকিম হাসান মির্জা হারাক। মাহুতটুলি মহলস্নাবাসীরা মাস্টার আহমদ হোসেন ওয়াফের 'বুলবুল-ই-বিমার' মঞ্চস্থ করেছিল। এরপর মহলস্না মহলস্নায় নাট্যদল গঠন ও নাটক মঞ্চস্থ হতে থাকল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মঞ্চস্থ হয়েছিল 'ইন্দ সভা'। যার রচয়িতা ছিলেন আমানত। নবাব খাজা আহসানউলস্নাহ রচিত কয়েকটি নাট্যাংশ ঢাকার নবাববাড়ীর নিজস্ব মঞ্চে পরিবেশিত হয়েছিল। নবাববাড়ীর খাজাদের মধ্যে মির্জা ওয়ালীজান কামার অনেক নাটক রচনা ও মঞ্চস্থ করেছিলেন। আরেকটি জনপ্রিয় নাটকের নাম ছিল 'লাল গাওয়াহার'। ঢাকা শহর থেকে ৩০ মাইল দূরে জয়দেবপুরেও ইন্দ সভা মঞ্চস্থ হয়েছিল। হিন্দু, মুসলমান, আর্মেনীয়, রাইস, সৈয়দ, মোগল, পাঠান এক বাক্যে ঢাকার সমগ্র শহরবাসী বিনোদনের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছিল এ থিয়েটার। হাশেম সুফীর মতে, কলকাতার পূর্বে ঢাকার মানুষ টিকিট দিয়ে নাটক উপভোগ করা শিখেছিল।
ঢাকাইয়া সংস্কৃতি : হারিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে
১. পাঠান যুগ ও মোগল আমলে ঢাকা ছিল হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলনের শহর। ধর্মাচার ভিন্নভাবে পালন করলেও ধমর্ীয় সংস্কৃতিকে উভয়েই সমভাবে ধারণ করেছিল। হোলি উৎসব, জন্মাষ্টমী, মহররম পর্ব, চৈত্র সংক্রান্তিতে উভয় সমপ্রদায়ের সম্মিলিত অংশগ্রহণ এক মহান ঐতিহ্য হয়ে উঠেছিল। ধমর্ীয় পর্বের বাইরে ঢাকার নিজস্ব সত্তায় গড়ে ওঠা এই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে ঢাকাইয়া সংস্কৃতি নামে অভিহিত করা যেতেই পারে। ব্রিটিশ শাসনের শেষভাগে শাসকবর্গের উস্কানি ও পৃষ্ঠপোষণে সামপ্রদায়িক দাঙ্গা তথা রায়টের প্রভাবে ঢাকাইয়ারা পরস্পরের ধর্মকে অবজ্ঞা ও ঘৃণা করতে শিখল। সৃষ্টি হলো ধমর্ীয় বিভাজনের পাশাপাশি সংস্কৃতির বিভাজন। ফলে সংস্কৃতির ঐক্যে ফাটল ধরল।
২. সামপ্রদায়িক অনৈক্য সৃষ্টির পর বিত্তশালী, শিক্ষিত ও প্রভাবশালী হিন্দুরা ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় বসতি গড়তে শুরু করল। ফলে ঢাকার পূর্বাংশের মহলস্না কেন্দি ক সমাজ ভেঙে গেল। সেই স্থান পূরণ করল ঢাকার বাইরের হিন্দু-মুসলমানরা।
৩. ঢাকার বিলাসবহুল, জাঁকজমকপূর্ণ ও ব্যয়বহুল সামাজিক-সাংস্কৃতিক চর্চার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল- ঢাকায় অবস্থানকারী হিন্দু-মুসলমান জমিদার ও নবাব সাহেবরা। জমিদার প্রথা উচ্ছেদ হওয়ার ফলে পৃষ্ঠপোষণ ও পরিচর্যার অভাবে ঢাকাইয়া সংস্কৃতির মেরুদণ্ড ভেঙে যায়।
৪. হাজী শরিয়তুলস্নাহর ফরায়জী আন্দোলনের ঢেউ ঢাকাকেও আচ্ছন্ন করল। ঢাকার মুসলমানদের উলেস্নখযোগ্য অংশ ফরায়জীর ভাবাদর্শে দীক্ষিত হয়। পারিবারিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে হিন্দুদের সংস্কৃতি ও ইসলামবিরোধী ফতোয়া দেয়ার কারণে ঢাকার মুসলমানরা সংস্কৃতি চর্চাবিমুখ হতে শুরু করল।
৫. দেওবন্দভিত্তিক মওলানারা দলে দলে ঢাকায় এসে মাদ্রাসা স্থাপন, মসজিদসমূহে ইমামের চাকরি নিয়ে ব্যাপক ওয়াজ নসিহতের মাধ্যমে ঢাকাইয়া মুসলমানদের সংস্কৃতি বিদ্বেষী করে তুলল। সবশেষে তাবলিগ জামাতের মসজিদ, মহলস্না ও গৃহভিত্তিক ধমর্ীয় চর্চা প্রতিনিয়ত ঢাকাইয়া সংস্কৃতিকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। যে ধারা এখনো বিদ্যমান রয়েছে।
৬. ঢাকার মহলস্নাভিত্তিক সমাজ তথা পঞ্চায়েত প্রথা উচ্ছেদের কারণে সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বিলুপ্ত হয়ে গেল।
৭. মহান মুক্তিযুদ্ধের পর রাজধানী ঢাকায় বহিরাগত অধিবাসীদের ব্যাপক বসতি স্থাপনের প্রভাবে ও সামাজিক সংমিশ্রণে ঢাকাইয়া ভাষা ও সংস্কৃতি আগ্রাসনের শিকার হয়েছে।
৮. ঢাকার হিন্দুস্তানি ভাষী ঢাকাইয়ারা নিজেদের আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য সম্বন্ধে অজ্ঞানতার কারণে ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা বন্ধ করে দিয়ে নিজেরাই আত্মহননের পথে ধাবিত হলো। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষাকেন্দি ক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে পুরোপুরি সম্পৃক্ত হতে গিয়ে ঢাকাইয়ারা রাষ্ট্রভাষার বেদিমূলে নিজেদের ঐতিহ্যবাহী ভাষা ও সংস্কৃতিকে উৎসর্গ করে দিলো।
স্কেচ: স্যার চার্লস ডয়লি
সহায়ক গ্রন্থ :
১. এই ঢাকায়, প্রবন্ধ-মুনতাসীর মামুন, দৈনিক যুগান্তর, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০০৮, ২. কিংবদন্তীর ঢাকা, নাজির হোসেন, ৩. ঢাকা আমার ঢাকা, বঙ্গেশ্বর রায়, ৪. ঢাকার জন্মাষ্টমীর উৎসবের ইতিহাস, মুনতাসীর মামুন, ৫. শহরের ইতিকথা, সত্যেন সেন, ৬. তাওয়ারিখে ঢাকা, মুনশী রহমান আলী তায়েশ, ৭. ঢাকা পাঁচাশ বারাস পাহেলে, হাকিম হাবিবুর রহমান, অনুবাদ : হাশেম সুফি, ৮. ঢাকার হারিয়ে যাওয়া কাসিদা, প্রবন্ধ : শায়লা পারভীন, দৈনিক যুগান্তর, ৩ মে, ২০০৮, ৯. সাক্ষাৎকার : সাকিয়া বানু, বয়স ৭৫, পতি-মৃত দীন মোহাম্মদ, ৫০ জগন্নাথ সাহা রোড, লালবাগ, ঢাকা, ১০. প্রয়াত মতিউর রহমান, পিতা-মৃত আকবর আলী, ৭৭/২, হোসেনী দালান রোড, চকবাজার, ঢাকা-১২১০, ১১. পারভেজ রেজা, বয়স ৩৫, পিতা-শামশার্ক হোসেন, মাতা- রাশিদা বেগম, ৮০, হোসেনী দালান রোড চকবাজার, ঢাকা।
===========================
গল্পালোচনা- 'মৃত্যুর মুশায়রা' by সেলিনা হোসেন  গল্প- 'বৃষ্টি নেমেছিল' by ইমদাদুল হক মিলন  গল্প- 'সড়ক নভেল' by হাসনাত আবদুল হাই  গল্প- 'জানালার বাইরে' by অরহ্যান পামুক  স্মৃতি ও গল্প- 'কবির অভিষেক' by মহাদেব সাহা  ইতিহাস- 'ভাওয়ালগড়ের ষড়যন্ত্র' by তারিক হাসান  আলোচনা- 'বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা' by বেলাল চৌধুরী  আলোচনা- 'শিল্প সৃষ্টি ও নান্দনিকতা' by আহমদ রফিক  আলোচনা- ''স্বর্ণকণা শোভে শত শত' মদির গন্ধভরা কণ্টকফল by মুহম্মদ সবুর  বিশেষ রচনা :ওমর খৈয়াম by ড. শামসুল আলম সাঈদ  নাটক- 'বিম্বিত স্বপ্নের বুদ্বুদ' by মোজাম্মেল হক নিয়োগী  গল্প- 'জয়া তোমাকে একটি কথা বলবো' by জাহিদুল হক  গল্প- 'নতুন বন্ধু' by আশরাফুল আলম পিনটু  গল্প- 'টপকে গেল টাপ্পু' by ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ  গল্প- 'নাচে বানু নাচায়রে' by আতা সরকার  গল্প- 'রূপকথার মতো' by নাসির আহমেদ  গল্প- 'বিয়ে' by আর্নল্ড বেনেট  গল্প- 'মাদকাসক্ত' by আলী ইদ্রিস  গল্প- 'বেঁটে খাটো ভালোবাসা' by রেজানুর রহমান  কবর by জসীম উদ্দীন (পল্লীকবি)  গল্প- 'নদীর নাম চিলমারী' by নীলু দাস  গল্প- 'লাউয়ের ডগা' by নূর কামরুন নাহার  গল্প- 'অপূর্ব সৃষ্টি' by পারভীন সুলতানা গল্প- 'ঊনচলিস্নশ বছর আগে' by জামাল উদ্দীন


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ  আনিস আহামেদ


এই ইতিহাস'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.