ইভটিজং আলোচনা- নারী উৎপীড়ক সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া

গুরুত্বর অপরাধ করলেও কোনো শাস্তি হয় না – এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার কারণে দেশে সব ধরনের অপরাধই বাড়ছে। আর এ কারণেই নারী উৎপীড়ক সন্ত্রাসীরাও অদম্য হয়ে উঠেছে।

আইনের ফাঁকফোকর আর সরকারের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে অবহেলায় তারা একের পর এক ঘটনা ঘটিয়েই চলেছে। আগের চেয়ে আরো মারমুখী হয়ে উঠেছে। আগে অতিষ্ঠ মেয়েটি জীবন দিয়ে এ থেকে নিস্তার পেতে চাইত। কিন্তু বর্তমানে তার আত্মীয়স্বজন, অভিভাবক, শিক্ষক-কারোরই রেহাই নেই। নারী উৎপীড়নের বাধা হয়ে দাঁড়ালে জীবন দিয়ে মাশুল দিতে হচ্ছে।
এ কথা ঠিক যে এটি সামাজিক ব্যাধি। সরকারের একার পক্ষে এর ত্বরিত সমাধান এবং মোকাবিলাও সম্ভব নয়। সামাজিকভাবে এর প্রতিরোধ দরকার। কিন্তু সন্ত্রাসীরা যখন বিভিন্ন ঘটনায় দেখতে পায় অপরাধীরা ভয়াবহ অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে, তখন তারা এ ধরনের অপরাধকে থোরাই পরোয়া করে। এ মুহূর্তে সারা দেশে নারী উৎপীড়ক সন্ত্রাসীদের কর্মকান্ড সবার মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই ধরনের ঘটনায় ফরিদপুরে চাঁপা রানী ভৌমিক নামের একজন মা ও নাটোরের কলেজশিক্ষক মিজানুর রহমানকে একই কায়দায় খুন করেছে নারী উৎপীড়ক সন্ত্রাসীরা। দেশের বিভিন্ন স্থানে এদের কারণে অনেক স্কুল-কলেজছাত্রী ঘর থেকে বাইরে যেতে পারছে না। তবে বেশির ভাগ ঘটনায়ই মেয়ের অভিভাবকরা মামলা করতে চান না। কারণ মামলার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এমনও ঘটনা আছে, ঘটনার ১০ বছর পরও নিস্তার পায়নি একটি পরিবার। সন্ত্রাসীরা তাদের জীবনকে অতিষ্ঠ করে রেখেছে। এর পরও কয়েক দিনে কয়েকটি স্থানে মামলা হয়েছে।
২০০১ সালে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের চারুকলার ছাত্রী সিমি বানু আত্মহত্যা করেছিলেন। এ জন্য দোষীদের এক বছরের সাজা হয়েছিল। ১০ বছর পার হয়ে গেলেও সিমির পরিবারকে এখনো থাকতে হচ্ছে পুলিশি পাহারায়। সন্ত্রাসীরা এতটাই প্রভাবশালী যে, পুলিশ তাদের ঠেকিয়ে রাখতে পুরো পরিবারটিকেই ১০ বছর ধরে পাহারা দিচ্ছে। একটি পরিবার গণমাধ্যমের কল্যাণে নিরাপত্তা পাহারা পেলেও দেশের অগণিত পরিবার মামলা করার পর আরো নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বর্তমানে এ অপরাধের জন্য যে শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে তা খুব অপ্রতুল। আর এ আইনের আওতায় অপরাধ প্রমাণও করা কঠিন।
পুলিশ সদর দফতর থেকে পাওয়া হিসাবে দেখা গেছে, আগস্ট পর্যন্ত এক বছরে নারী উৎপীড়নের ঘটনায় সারা দেশে ১৫০টি মামলা হয়েছে। আর সাধারণ ডায়রি (জিডি) হয়েছে ৩৭৭টি। এক হাজার ২৬৯ জনের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। পুলিশ গ্রেফতার করেছে মাত্র ৫২০ জনকে।
অন্যদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের হিসাবে, এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মহানগর পুলিশ উৎপীড়নের ঘটনায় এক হাজার ২৭ জনকে গ্রেফতার করে। এ সময়ে ২৫টি মামলা হয়। ৮৩৪ জন বখাটের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ আসে। এদের মধ্যে মুচলেকার মাধ্যমে ৪১৮ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়।
তবে পত্র-পত্রিকায় ছাপা হওয়া সংবাদের ভিত্তিতে মহিলা পরিষদের সংগৃহীত হিসাবে, ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ১০ মাসে ৩৫৪ জন উৎপীড়নের শিকার হয়েছেন। আর এ ঘটনায় আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ২০ জন নারী। এভাবে মামলা হলেও উৎপীড়কদের গ্রেফতারের হার খুবই কম। ফলে নারী উৎপীড়ক সন্ত্রাসীরাও কোনো কিছুর পরোয়া করছে না।
উৎপীড়নের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি : কয়েক সপ্তাহেই নারী উৎপীড়কদের হাতে এক কলেজশিক্ষক ও একজন মা নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন একটি পরিবারের সদস্যরা। এ ছাড়াও বেশকিছু স্কুল-কলেজের ছাত্রী বাড়ি থেকে বের হতে পারছে না। অথচ কলেজশিক্ষক মিজানুর রহমান নিহত হওয়ার পর ২৪ অক্টোবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এর বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে উৎপীড়ন থামেনি। পরে ২৭ অক্টোবর জীবন দেন ফরিদপুরের একজন মা চাঁপা রানী ভৌমিক। এরপর প্রধানমন্ত্রী ২৭ অক্টোবর উৎপীড়নের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দেন। কিন্তু এরপরও ১ নভেম্বর সিরাজগঞ্জে রূপালী আত্মহননে বাধ্য হয়েছে।
১২ অক্টোবর নাটোরের বাগাতিপাড়ার লোকমানপুরে ছাত্রীদের উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় লোকমানপুর কলেজের রসায়নের শিক্ষক মিজানুর রহমানের গায়ে মোটরসাইকেল তুলে দেয় সন্ত্রাসীরা। পরে তাকে অচেতন অবস্থায় রাজধানীতে পাঠানো হয়। কয়েক দিন জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে থেকে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ২৪ অক্টোবর তিনি মারা যান।
ওইদিন ধামরাইয়ের কালামপুর আমাতননেছা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেন, হামলাকারীদের গ্রেফতার করা হবে। ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা বন্ধ এবং বখাটেদের চিহ্নিত করতে গোয়েন্দা নজরদারির নির্দেশও দেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের একদিন পর ২১ অক্টোবর সহকর্মীদের উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ জানিয়ে উৎপীড়কদের নির্যাতনের শিকার হন মাগুরায় প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে (পিটিআই) প্রশিক্ষণরত শিক্ষক শরিফুজ্জামান। ভাইজির উত্ত্যক্তকারীকে বাধা দেওয়ায় মঙ্গলবার চাঁদপুরের কচুয়ায় বখাটেদের হামলায় গুরুতর আহত হন দুই সহোদর।
২৭ অক্টোবর উৎপীড়নের প্রতিবাদ করায় শিক্ষক মিজানুর রহমানের পর উৎপীড়ক সন্ত্রাসীদের মোটরসাইকেলের ধাক্কায় প্রাণ দিলেন এক মা। ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলা সদরে উৎপীড়ক দেবাশীষ সাহা রনির (২৪) মোটরসাইকেলের ধাক্কায় মারা যান চাঁপা রানী ভৌমিক (৪৮)।
তিনি ফরিদপুর চিনিকলের বাণিজ্যিক বিভাগের কর্মী ছিলেন।
এদিন এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নারী উৎপীড়নের জন্য দায়ী কাউকেই রেহাই দেওয়া হবে না। এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের হাতে কলেজশিক্ষক মিজানুর রহমান নিহত হওয়ার ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এ জন্য দায়ী একজনকে ইতোমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদেরও অবিলম্বে গ্রেফতার করা হবে।’
প্রধানমন্ত্রীর এ হুমকির পরও সারা দেশে নারী উৎপীড়নের সংবাদ এসেছে। ১ নভেম্বর সিরাজগঞ্জে সুনীল চন্দ্র বয়াতির মেয়ে রূপালী রানী আত্মহননে বাধ্য হয়েছে। সে সীমাবাড়ি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী।
৩১ অক্টোবর নওগাঁ সদর উপজেলায় নারী উৎপীড়নের প্রতিবাদ করলে সন্ত্রাসীদের হামলায় বাবা-ছেলেসহ একই পরিবারের তিনজন আহত হন। গুরুতর অবস্থায় আবদুল হান্নান (৪২), তার ছেলে ফসিউর রহমান (১৪) ও আবদুল হান্নানের মামা আকরাম হোসেনকে (৪০) রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
সন্ত্রাসীদের ভয়ে বাড়ি থেকে বের হতে পারছেন না রাজবাড়ী সদরের রামকান্তপুর ইউনিয়নের রাজেন্দ্রপুর হারবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা ও ডা. আবুল হোসেন কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্রী সেলিনা খাতুন। এ ঘটনায়ও থানায় লিখিত কোনো অভিযোগ দিতে সাহস করেনি সেলিনার পরিবার।
একজন সিমির পরিবার : ২০০১ সালে সিমি আত্মহত্যা করার পর তার পরিবারকে এখনো পুলিশি নিরাপত্তা নিতে হচ্ছে। গত জুলাইয়েও তাদের বাড়ির ছাদে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। এ নিয়ে সিমির একজন স্বজন সাপ্তাহিক বুধবারের সঙ্গে তাদের পরিবারের ওপর ওই সন্ত্রাসীদের নির্যাতনের বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি ভয়ে নাম প্রকাশও করতে চাননি। তিনি বলেন, এখনো পরিবারের লোকজন বাইরে বেরুতে ভয় পান। ওই সন্ত্রাসীরা এখন এলাকাবাসীদেরও তাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে চেষ্টা করছে। ফলে সিমি আত্মহনন করে বেঁচে গেলেও পরিবারের সদস্যরা রয়েছেন একই পরিস্থিতিতে। সিমির আত্মহননের ঘটনায় নিম্ন আদালত অভিযুক্ত ছয়জনের পাঁচজনকে এক বছর করে কারাদন্ড ও এক হাজার টাকা করে জরিমানার আদেশ দেন। এর বিরুদ্ধে সিমির বাবা জজ আদালতে আপিল করেন। আসামিপক্ষ সিমির বাবার আপিলকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে আবেদন করে এই বলে যে, সিমির বাবা রায় হওয়া মামলার বাদী ছিলেন না বলে তার আপিল খারিজযোগ্য। হাইকোর্টে আসামিপক্ষের আবেদন খারিজ হলে তারা আপিল বিভাগে যায়। আপিল বিভাগ শুনানির জন্য এটি তালিকাভুক্ত করেন এবং বিষয়টি এখন শুনানির অপেক্ষায় আছে। উল্লেখ্য, এ পর্যন্ত নারী উৎপীড়নের কোনো মামলার চূড়ান্ত রায়ে কারো সাজা হয়নি।
আত্মহননের আগে সাহস করে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন রাজধানীর ২৪৮/৬ ভূঁইয়াপাড়ার আলী ইমদাদ আলীর মেয়ে সিমি বানু। বিচার চেয়ে খিলগাঁও থানায় গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এসআই বাশারসহ পুলিশের হাতে উল্টো উৎপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। ‘বিচার পাই না, তাই বিচার চাই না’ বলে অনেকে অপরাধ এড়িয়ে গেলেও সিমির অপরাধ ছিল তিনি বিচার চেয়েছিলেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। ২০০১ সালের ২৩ ডিসেম্বর ওই দারোগাকে নিয়ে এলাকার মুরুবিবদের সালিসি বসে। সালিসে সন্ত্রাসীদের বিচার না করে সন্ধ্যার পর সিমিকে ঘর থেকে বের না হওয়ার ফয়সালা দেওয়া হয়। এই হাস্যকর বিচার মানতে পারেননি সিমি। তাই লজ্জায়, ক্ষোভে ও অপমানে ওই সময়ই সিমি পাশের ঘরে বিষপানে আত্মহত্যা করেন।
শিক্ষামন্ত্রীর দৌড়ঝাঁপ : ৯ জুন সচিবালয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ছাত্রী কিংবা মহিলাদের উত্ত্যক্তকারী উৎপীড়ক যে দলেরই হোক না কেন, তাদের আইনের আওতায় আনতে সরকার বদ্ধপরিকর। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও সেভাবে নির্দেশনা দেওয়া আছে বলে তিনি জানান। ১০ আগস্ট মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার বাড়ৈখালী উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী হাসনা রহমান সিনথিয়া আত্মহত্যা করে। এর কিছুদিন আগে নারী উৎপীড়নের বিরুদ্ধে স্কুল থেকে বের করা র‌্যালিতে ব্যানার নিয়ে শামিল হয়েছিল সে। কিন্তু নিজেকেই এ কারণে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হলো। এ ঘটনার পর ১৪ আগস্ট শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ মুন্সীগঞ্জে যান। তিনি নারী উৎপীড়ন বন্ধে কঠোর শাস্তি দিতে প্রয়োজনে নতুন আইন করা হবে বলেও জানান।
তিন মাস পর ৩০ অক্টোবর তিনি আবার ফরিদপুরে চাঁপা রানীর বাড়িতে যান। সেখানে গিয়েও উৎপীড়ন রোধে কঠোর আইন তৈরি করা হচ্ছে বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী। তিনি শিক্ষক মিজানুর রহমানের বাড়িতেও গিয়েছিলেন। শিক্ষামন্ত্রী ভুক্তভোগী পরিবারকে সান্ত্বনাই দিয়েছেন। কিন্তু একদিকে তিনি সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছেন, অন্যদিকে ঘটনার মিছিল ক্রমশ লম্বা হচ্ছে।
আইনের খসড়ায় যা আছে : প্রচলিত আইনের অপ্রতুলতা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত বিভিন্ন যৌন হয়রানিমূলক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ২০০৯ সালের ১৫ মে রিট পিটিশন নম্বর ৫৯১৬/২০০৮ এর রায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কতকগুলো দিকনির্দেশনা প্রদান করেন এবং যথাযথ আইন প্রণয়ন না হওয়া পর্যন্ত এ দিকনির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। পরে আইন কমিশনের নিয়মিত গবেষণা কাজের অংশ হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বন্ধের জন্য একটি খসড়া আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রতিনিধিদের সঙ্গে আইন কমিশনের একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। রিট পিটিশনের নির্দেশনা ও পার্শ্ববর্তী দেশ অর্থাৎ ভারত ও পাকিস্তানের এ বিষয়ে প্রণীত বিল এবং আইনের আলোকে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধসংক্রান্ত একটি আইনের খসড়া নমুনা কমিশনের গবেষণা শাখা থেকে ইংরেজিতে প্রস্ত্তত করা হয়। ওই নমুনার ভিত্তিতে এবং পাশের দেশের আইন পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইনের একটি বাংলা খসড়া তৈরি করে আইন কমিশনে হস্তান্তর করে। পরে প্রস্তাবিত আইনটির চূড়ান্ত খসড়া প্রস্ত্তত করা হয়। খসড়া আইনে যৌন হয়রানির সংজ্ঞা সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। তা ছাড়া কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ আইনে উল্লিখিত অন্যান্য প্রয়োজনীয় শব্দের সংজ্ঞাও প্রদান করা হয়েছে।
খসড়ার (ট) ধারায় ‘যৌন হয়রানি’ অর্থ-(১) সরাসরি বা ইঙ্গিতে অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন আবেদনমূলক আচরণ, যেমন শারীরিক স্পর্শ বা এ ধরনের প্রচেষ্টা; (২) প্রাতিষ্ঠানিক বা পেশাগত ক্ষমতা ব্যবহার করিয়া কাহারো সহিত যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করা; (৩) যৌন ইঙ্গিতবাহী কোনো কিছু উপস্থাপন বা উক্তি বা মন্তব্য বা প্রদর্শন করা; (৪) যৌন আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত বা গ্রহণযোগ্য নয় এমন আবেদন বা অনুরোধ করা; (৫) পর্নোগ্রাফি দেখানো; (৬) যৌন ইঙ্গিতমূলক মন্তব্য বা ইশারা করা; (৭) অশালীন অঙ্গভঙ্গি, অশালীন ভাষা বা মন্তব্যের দ্বারা উত্ত্যক্ত করা বা অশালীন উদ্দেশ্য পূরণে কোনো ব্যক্তির অলক্ষ্যে নিকটবর্তী হওয়া বা অনুসরণ করা বা যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ ঠাট্টা বা উপহাস করা; (৮) চিঠি, টেলিফোন, মোবাইল, এসএমএস, ই-মেইল, নোটিশ, কার্টুনের মাধ্যমে বা বেঞ্চ, চেয়ার, টেবিল, নোটিশ বোর্ড, অফিস, কারখানা, ক্লাসরুম, ওয়াশরুম, বাথরুম বা যে কোনো স্থানে বা দেওয়ালে যৌন ইঙ্গিতমূলক কোনো কিছু লেখা বা অঙ্কন করা বা চিহ্নকরণ বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোনো অশ্লীল বা যৌনতাসংশ্লিষ্ট কোনো বস্ত্ত রাখা বা দেখানো ইত্যাদি; (৯) যৌন আকাঙ্ক্ষা পূরণে কমনরুম, ওয়াশরুম, বাথরুম বা এ ধরনের কোনো স্থানে উঁকি দেওয়া; (১০) ব্লাকমেইল বা চরিত্রহননের উদ্দেশ্যে কারো স্থির বা ভিডিওচিত্র ধারণ ও সংরক্ষণ, প্রদর্শন, বিতরণ, বিপণন ও প্রচার বা প্রকাশ করা; (১১) লিঙ্গগত কারণে বা যৌন হয়রানির উদ্দেশ্যে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, প্রাতিষ্ঠানিক এবং শিক্ষাগত কার্যক্রমে অংশগ্রহণ বা বিরত থাকিতে বাধ্য করা; (১২) প্রেমনিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়ে হুমকি দেওয়া বা চাপ প্রয়োগ করা; (১৩) প্রতারণার মাধ্যমে, ভয় দেখিয়ে বা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করা; (১৪) যৌন আকাঙ্ক্ষা পূরণসংশ্লিষ্ট কোনো কাজ করিতে অস্বীকার করার কারণে কোনো ব্যক্তির পদোন্নতি বা পরীক্ষার যথাযথ ফলাফল বা অন্যান্য যে কোনো সুবিধাদি বাধাগ্রস্ত করা; (১৫) যৌন প্রকৃতির যে কোনো প্রকার অনাকাঙ্ক্ষিত শারীরিক, বাচনিক বা ইঙ্গিতমূলক অভিব্যক্তি।
খসড়া আইনের ১৩ ধারায় যৌন হয়রানির দন্ডের কথা বলা হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রমাণিত হলে লঘুদন্ড যেমন, তিরস্কার, পদাবনতি, ছাত্রত্ব স্থগিতকরণ এবং গুরুদন্ড যেমন বাধ্যতামূলক অবসর, চাকরিচ্যুতি ও ছাত্রত্বের অবসানসহ বিভিন্ন শাস্তি দেওয়ার সুপারিশ করে থানা, আদালত বা ট্রাইব্যুনালে পাঠানো যেতে পারে। এ ছাড়াও ১৮৬০ সালের দন্ডবিধির ৫০৯ সংশোধন ও ৫০৯এ ধারা যুক্ত করারও খসড়া বিল তৈরি করেছে কমিশন। ৫০৯ ধারায় বর্তমানে এক বছরের কারাদন্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু যৌন হয়রানির সংজ্ঞা এমন হালকা করে দেওয়া হয়েছে যে তা দিয়ে কাউকে নারী উৎপীড়ক হিসাবে প্রমাণ করা যায় না। এ ক্ষেত্রে বর্তমান খসড়ায় এর সংজ্ঞা বাড়িয়ে যুগোপযোগী করা হয়েছে। ৫০৯এ ধারা যুক্ত করে শাস্তির বিধানের কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছর কারাদন্ড যা তিন বছরের কম হবে না। মহিলা আইনজীবী সমিতির কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট চঞ্চল মুখার্জি বুধবারকে বলেন, এ আইনের খসড়াটি আইন মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আইনটি আলোর মুখ দেখেনি।
শেষ কথা : দেখা যাচ্ছে নারী উৎপীড়ক সন্ত্রাসীদের দ্বারা হত্যাকান্ড সংঘটিত হয় কিংবা তাদের যন্ত্রণায় আত্মহননের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে কিছুদিন শোরগোল হয়। পত্রিকার পাতায় স্থান নেয় হত্যার শিকার মেয়েটি বা তার অভিভাবকের ছবি। সরকারের পক্ষ থেকে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। কয়েক দিন পর আরেকজন সে স্থান দখল করে নেন। শুধু ব্যক্তি আর স্থান ভিন্ন হলেও ঘটনা একই থাকে। এর আর প্রতিকার হয় না। সরকার যেন এ ক্ষেত্রে পুরোপুরিই ব্যর্থ।
=========================
রাজনৈতিক আলোচনা- 'ছাত্ররাজনীতি তার হারানো গৌরব ফিরে পাক by ফরহাদ মাহমুদ  আলোচনা- 'দেশ কাঁপানো নূরজাহান' by আবদুল হামিদ মাহবুব  ইতিহাস- 'বাংলা ভাষার স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ' by রফিকুল ইসলাম  গল্পালোচনা- 'অরণ্যে যুদ্ধ' by অরুন্ধতী রায়  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা আর ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ  নিবন্ধ- 'আইলা, কৃষি এবং কোপেনহেগেন প্রাপ্তি'  গল্পিতিহাস- 'এত যে সফলতা, তবুও বিফলতা' by সনৎ কুমার সাহা  আলোচনা- 'মুনাফার মালা গলায় ঝুলিয়ে পুঁজিবাদীরা মানবজাতি ধবংসের ব্যবস্থা করছে by বদরুদ্দীন উমর  গল্পালোচনা- 'স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি' by লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান  আলোচনা- 'টেলিভিশন কি পত্রিকার প্রতিদ্বন্দ্বী' 


সাপ্তাহিক বুধবার এর সৌজন্যে

এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.