শিক্ষার কেন্দ্রে যোগ্য শিক্ষকদের বসান

১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর প্যারিসে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে শিক্ষকদের মৌলিক অধিকার ও কর্তব্যবিষয়ক ১৪৬টি ধারাবিশিষ্ট ‘স্ট্যাটাস অব টিচার্স’ নামের এক ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরদাতারা হলেন তখনকার ইউনেসকোর মহাপরিচালক জিন থোমাস ও লিগ্যাল অ্যাডভাইজর রেনে ম্যাথিউ।
সদস্যরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশে এই সুপারিশমালা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে ১৯৯৪ সালে জেনেভায় আন্তর্জাতিক এক শিক্ষা সেমিনারে সহস্রাধিক প্রতিনিধির উপস্থিতিতে শিক্ষকদের মৌলিক অধিকার ও কর্তব্যের ওপর নতুন করে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ইউনেসকোর তৎকালীন মহাপরিচালক ফেডারিকো মেয়র ৫ অক্টোবরকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস ঘোষণার মাধ্যমে এদিন শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সরকারের করণীয় কী এবং শিক্ষকেরা কোন নীতিমালার মাধ্যমে পেশাগত দায়িত্ব পালন করবেন, তা আন্তর্জাতিকভাবে নির্ধারিত হলো। বিভিন্ন দেশ প্রতিবছর ৫ অক্টোবর বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে দিবসটি পালন করে।
পেশা হিসেবে শিক্ষকতা বাংলাদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত নয়। দেশের জনগোষ্ঠীকে যাঁরা মানবসম্পদে পরিণত করেন, তাঁদের উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে দিবসটির প্রতি সরকার ও জনগণকে আরও গুরুত্ব দেওয়া উচিত। প্যারিস সম্মেলনে গৃহীত ‘স্ট্যাটাস অব টিচার্স’ ঘোষণাপত্রের সুপারিশমালা—
শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণে শিক্ষক, কর্মচারী ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা নিতে হবে। মানব অধিকার-সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক ঘোষণার ২৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী নাগরিকদের উপযুক্ত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। চাকরির নিরাপত্তা ও নিয়োগকালের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে হবে। নিয়োগবিধি ও চাকরির শর্তাবলি নির্ধারণে শিক্ষক সংগঠনগুলোর ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে। এতে শিক্ষকদের দায়িত্ব ও অধিকার সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে। মেধা আকর্ষণ ও শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনের জন্য বার্ষিক জাতীয় বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ নির্দিষ্ট রাখতে হবে। শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আগে শিক্ষককে আত্মপক্ষ সমর্থনের যথাযথ সুযোগ দিতে হবে। নতুন কোর্স তৈরি, পাঠ্যপুস্তক রচনা ও পাঠ্যসহায়ক-সামগ্রী প্রস্তুতে শিক্ষক ও শিক্ষক সংগঠনগুলো অংশ নেবে। শিক্ষকেরা একাডেমিক স্বাধীনতা ভোগ করবেন। শিক্ষকেরা সব নাগরিক অধিকার ভোগ করবেন এবং জনপ্রতিনিধিত্বের সব ধরনের পদ তাঁদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। তাঁরা চাকরির শ্রেষ্ঠত্ব ও পেনশনের জন্য বিবেচ্য চাকরির মেয়াদকাল অক্ষুণ্ন রেখে ওই দায়িত্ব পালন করতে এবং মেয়াদান্তে আগের পদে বা সমতুল্য পদে ফিরে আসতে পারবেন। শিক্ষকদের আচরণবিধি স্থিতিকরণে শিক্ষক সংগঠনগুলোর ভূমিকা থাকবে। জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পর্যালোচনা করে শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে হবে। বৃদ্ধ বয়সে সামাজিক নিরাপত্তা, চিকিৎসার সুযোগ ও অবসরভাতা দিয়ে শিক্ষকদের জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিবছর বাংলাদেশে শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে সাত লাখেরও বেশি লোক এ পেশায় নিয়োজিত। অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষক প্রাইমারি স্কুলে। বাকিরা কর্মরত আছেন মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। দেশে সরকারি ও বেসরকারি দুই ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিদ্যমান। প্রায় ৯৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে। সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও অন্য সুযোগ-সুবিধায় রয়েছে আকাশ-পাতাল ব্যবধান।
বিগত জাতীয়তাবাদী সরকারের আমলে বেসরকারি শিক্ষকদের মূল বেতনের শতভাগ পাওয়ার জন্য ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আন্দোলন করতে হয়েছে।
বর্তমান সরকার বেসরকারি শিক্ষকদের নতুন জাতীয় স্কেলে অন্তর্ভুক্ত করেছে। নতুন শিক্ষানীতি হয়েছে। তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়েছে। জাতীয় সংসদের শিক্ষাবিষয়ক স্থায়ী কমিটি শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সংশোধনকল্পে কিছু সুপারিশ প্রণয়ন করেছে। সুপারিশমালা বাস্তবায়নের কোনো পরিকল্পনা সরকারের কাছ থেকে শোনা যাচ্ছে না। প্রচলিত জনবল-কাঠামো শিক্ষকদের পদোন্নতির পথে বড় বাধা এবং সংশোধন এখন সময়ের দাবি। বেসরকারি শিক্ষকেরা সরকারি কোষাগার থেকে মাসিক বাড়িভাড়া পান ১০০ টাকা, উৎসব-ভাতা পূর্ণাঙ্গের পরিবর্তে পান মূল বেতনের ২৫ শতাংশ। পূর্ণ পেনশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রতিবেশী দেশ ভারতে বেসরকারি ও সরকারি শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধায় কোনো পার্থক্য নেই। বেসরকারি শিক্ষকেরাও পূর্ণ পেনশন পান। এখানে শিক্ষকেরা কখনো কখনো প্রতিকূল পরিবেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তাঁদের অভিযোগ করার উপযুক্ত জায়গা নেই।
শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা অপ্রতুল। জ্ঞানসম্ভার সমৃদ্ধির কারণে প্রতিনিয়ত শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আসছে। জ্ঞাননির্ভর সমাজ তৈরির দিকে পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে এবং প্রতিযোগিতা বাড়ছে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত উত্তম শিক্ষক প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই।
শিক্ষক নিয়োগের জন্য শিক্ষক সার্ভিস কমিশন গঠন করা এখন সময়ের দাবি। কমিশনটি যেন অন্যান্য সার্ভিস কমিশনের মতো দলীয় লোক দ্বারা পরিচালিত না হয়। বাংলাদেশে অনেক প্রতিভাসম্পন্ন শিক্ষক আছেন। প্রাচীনকালে সমতটে (কুমিল্লার চান্দিনা) এক ব্রাহ্মণ রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন অসামান্য বাঙালি শিক্ষক মহাস্থবির শীল ভদ্র (৫২৯—৬৫৪ খ্রি.)। জগদ্বিখ্যাত নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান আচার্য ও সর্বাধ্যক্ষের পদ অলংকৃত করে বাঙালি জাতির মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন। একাদশ শতাব্দীতে বিক্রমপুরের অতীশ দীপঙ্কর একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ছিলেন। বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক মেধাবী শিক্ষক উন্নত বিশ্বে হার্ভার্ড ও বিভিন্ন ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণাকাজে নিয়োজিত আছেন। সীমিত সুযোগ-সুবিধার কারণে ভালো শিক্ষকেরা বিদেশে চলে যাচ্ছেন। জাতির জন্য কোনো অবস্থায়ই এটা কাম্য নয়। ইউনেসকো, আইএলও, ইউএনডিপি ও ইউনিসেফ যৌথভাবে প্রতিবছর বিশ্ব শিক্ষক দিবসে বাণী প্রচার করে থাকে।
২০০৫ সালে যৌথ বাণীতে গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছিল, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যে শিক্ষকেরা জ্ঞানের প্রদীপটি পৌঁছে দেন, যাঁদের অবস্থান শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে, তাঁদের কথা শুনতে হবে। বিশ্বের চলমান অর্থনৈতিক মন্দা অবস্থার পরিবর্তন না আসতেই গত জানুয়ারিতে হাইতিতে যে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়ে গেল, সেখানে ৩৮ হাজার ছাত্র ও এক হাজার ৩০০ শিক্ষকের মৃত্যু ঘটেছে। পাকিস্তানের প্লাবনে ক্ষতিগ্রস্ত দুই কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় অর্ধেক শিশু। যেকোনো দুর্যোগে শিক্ষকেরাই পারেন শিশুদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য পূরণে এবং ২০১৫-এর মধ্যে ‘সবার জন্য শিক্ষা’ নিশ্চিতকরণের জন্য বর্তমানে বিশ্বে এক কোটি ৩০ লাখ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের প্রয়োজন। যেহেতু শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের জন্য শ্রেণীকক্ষ আকর্ষণীয় করে তোলেন, জ্ঞানের উন্মেষ ঘটান এবং ভবিষ্যৎ রচনা করেন, তাই উত্তমদের এ দায়িত্ব দেওয়া প্রয়োজন। উত্তম ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের পরিবেশ দেশে সৃষ্টি হোক, এটাই সবার প্রত্যাশা।
এম এ বারী: বেসরকারি শিক্ষকনেতা ও সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.