ছাত্রলীগ নেতা কি ‘সম্মানিত’ ব্যক্তি নন by এ কে এম জাকারিয়া

এক ট্রাফিক সার্জেন্টকে মারধর করেছিলেন আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদ ইলিয়াস মোল্লাহ। এ নিয়ে থানায় মামলা করেছিলেন নাজেহাল হওয়া সার্জেন্ট। এরপর পুরো পুলিশ বিভাগেরই নাজেহাল হওয়ার দশা। কেন ট্রাফিক সার্জেন্ট মামলা করলেন, থানা কেন মামলা নিল—এসব প্রশ্নে জর্জরিত হলো পুলিশ বিভাগ। সার্জেন্টকে মারধরের ঘটনায় পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন থেকে যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল তার জন্য ক্ষমাও চাইতে হয়েছে অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের। মার খেয়ে যে সার্জেন্ট মামলা করলেন, তিনি উল্টো শাস্তি পাবেন কি না বা যিনি মামলা নিয়েছেন, থানার সেই ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কী হবে—এসব প্রশ্ন এখন সাংসদের হাতে পুলিশ লাঞ্ছিত হওয়ার চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় কমিটির সভায়ও বিষয়টি উত্তাপ ছড়িয়েছে। সভা থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সাংসদদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগবে। ‘পুলিশ কর্মকর্তাদের এ ধরনের নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে, কাজ করতে গেলে যে কারও ভুলত্রুটি হতেই পারে। সাংসদদের ছোটখাটো ভুলের বিষয়ে মামলা করার আগে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অবশ্যই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে, অনুমতি নিতে হবে।’ (প্রথম আলো, ১৪ জুলাই)
সাংসদ কেন ট্রাফিক সার্জেন্টকে মারলেন সে বিষয়ে নয় বরং সাংসদের বিরুদ্ধে ট্রাফিক সার্জেন্ট কেন মামলা করলেন তা তদন্তে কমিটি গঠন করার জন্য সভা থেকে আইজিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী দুজনের বক্তব্য ছিল প্রায় একই। দুজনেই বলেছেন, জনপ্রতিনিধি ও সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে একজন সাংসদের বিরুদ্ধে মামলা করার আগে চিন্তাভাবনা করার দরকার ছিল।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর এসব বক্তব্যের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত; সাংসদদের বিরুদ্ধে মামলা করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগবে। কোনো সাংসদ ‘কাজ’ করতে গিয়ে যদি কোনো ‘ভুলত্রুটি’ করেন, তবে মামলা করা যাবে না। আগে তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানাতে হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে ঘটনাটি ‘ছোটখাটো ভুল’ কি না। যদি ছোটখাটো ভুল হয়ে থাকে, তবে মামলা করা যাবে না। কোনটি ছোটখাটো ভুল তার অন্তত একটি উদাহরণ আমরা পেয়ে গেছি। সরকারদলীয় সাংসদ ইলিয়াস মোল্লাহ গত ৩০ জুন যা করেছিলেন, তা ছোটখাটো ভুলের একটি দৃষ্টান্ত। কী করেছিলেন তিনি সেদিন? সাংসদ ইলিয়াস মোল্লাহর বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছিল থানায় তার এজাহারে বলা হয়েছে, সার্জেন্ট শরীফুল ইসলাম গত ৩০ জুন আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কের আশুলিয়া থানার আশুলিয়া বাজারসংলগ্ন সেতুর পাশে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ওই দিন দুপুর থেকেই সেতুর উভয় পাশে সড়কটিতে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। সাংসদ ইলিয়াস মোল্লাহ গাড়িতে ওই সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় সেতুর কাছে যানজটে আটকা পড়েন। কিছুক্ষণ আটকা থাকার পর তিনি হেঁটে সেতুর ওপর যান। সেখান থেকে ইশারায় সার্জেন্ট শরীফুলকে সেতুর ওপর আসতে বলেন। সার্জেন্ট সেখানে যাওয়ামাত্র ইলিয়াস মোল্লাহ তাঁকে গালিগালাজ শুরু করেন। একপর্যায়ে তাঁর জামার কলার ধরে টানাটানি করেন এবং তাঁকে মারধর করেন। (প্রথম আলো ১০ জুলাই)। ‘পুলিশের কাজে বাধা, পোশাক ধরে টানাহেঁচড়া ও মারধরের অভিযোগে’ এই মামলাটি হয়েছিল। এ থেকে আমরা যা শিখলাম, তা হচ্ছে ‘কাজ’ করতে গিয়ে কোনো সাংসদ যদি ট্রাফিক পুলিশকে মারধর করেন, তবে তাঁকে ‘ছোটখাটো ভুল’ হিসেবেই ধরে নিতে হবে।
তবে আমাদের ধারণা, ‘সাংসদ’ বলতে এ ক্ষেত্রে সরকারি দলের সাংসদদেরই বোঝাবে। বিরোধীদলীয় সাংসদদের এই সিদ্ধান্তে বগল বাজানোর কিছু আছে বলে মনে হয় না। কারণ, বিরোধী দলের কোনো সাংসদ ‘পুলিশের কাজে বাধা দিলে’ তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশ সঙ্গে সঙ্গেই মামলা ও প্রয়োজনে গ্রেপ্তারও করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আগাম অনুমতি আছে—এমনটিই ধরে নিতে হবে।
জনপ্রতিনিধি হিসেবে সাংসদেরা কী ধরনের ছাড় পেতে পারেন, তা আমাদের কাছে কিছুটা পরিষ্কার হয়েছে। কিন্তু ছাত্রলীগ নেতাদের বেলায় কী হবে? তাঁরা যদি পুলিশকে মারধর করেন, তবে কি ছাড় পাবেন না? ‘এসআইকে ছাত্রলীগ নেতার মারধর’ এই খররের প্রথম প্যারাটি হচ্ছে, ‘তোর মতো দারোগা ১০টা আমার পকেটে থাকে। তুই আমার ফোনে গাড়ি ছাড়িসনি কেন?’ এ কথা বলেই তল্লাশি চৌকিতে দায়িত্বরত পুলিশের এক উপপরিদর্শকের (এসআই) গালে চড় মারেন কামরাঙ্গীরচর থানা ছাত্রলীগের নেতা জুম্মন মিয়া (প্রথম আলো ১৮ জুলাই)। এসআইয়ের অপরাধ, টেলিফোনে জুম্মন মিয়ার নির্দেশ পেয়েও আটক একটি মোটরসাইকেল ছেড়ে না দিয়ে মামলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এরপর পুলিশের টহল চৌকিতে এসে তিনি এসআইকে শুধু চড়ই মারেননি, আটক মোটরসাইকেলটিও ছিনিয়ে নিয়ে গেছেন তাঁর দলবল নিয়ে। এ ক্ষেত্রেও লাঞ্ছনার শিকার পুলিশের এসআই মামলা করেছেন। তবে পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন থেকে কোনো বিবৃতি দেওয়া হবে কি না সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত নই।
সাংসদ ‘সম্মানিত ব্যক্তি’ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু একজন ছাত্রলীগ নেতা সম্মানিত ব্যক্তি নন, তা আমরা কী করে বলব? এখন যিনি ছাত্রলীগে আছেন, দুই দিন পর আওয়ামী লীগে যাবেন, তারপর হয়তো সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়ে আইনপ্রণেতা হবেন, জনপ্রতিনিধি হবেন। জুম্মন মিয়াকে আমরা যদি ভবিষ্যতের একজন সম্ভাবনাময় নেতা হিসেবে বিবেচনা করি, তবে কিছু আগাম ছাড় তো তিনি পেতেই পারেন!
সাংসদ ইলিয়াস মোল্লাহর ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী যে দায়িত্ব ও ভূমিকা পালন করেছেন, একজন সম্ভাব্য আইনপ্রণেতা ও জনপ্রতিনিধির ক্ষেত্রেও তাঁরা একই কাজ করতে পারেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা করতে পারে, ছাত্রনেতাদের যেহেতু ভবিষ্যতে জনপ্রতিনিধি ও আইনপ্রণেতা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাই তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করতে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগবে। তবে বিষয়টি সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের নেতাদের মধ্যে সীমিত রাখাই যৌক্তিক হবে। সাধারণভাবে সব ছাত্র সংগঠনের ছাত্রনেতাদের ছাড় না দিয়ে শুধু ছাত্রলীগের নেতাদের ছাড় দেওয়ার বিষয়টি পরিষ্কার করে দিলে বিভ্রান্তি দূর হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলতে পারেন, ‘কাজ করতে গিয়ে’ ছাত্রলীগ নেতাদের ‘ছোটখাটো ভুল’ হতেই পারে। এসব ছোটখাটো ভুলের কারণে মামলা করার আগে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে অবশ্যই অনুমতি নিতে হবে। ছাত্রলীগ নেতা জুম্মন মিয়ার বিরুদ্ধে কেন থানায় মামলা হলো তা নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় কমিটির সভায় ভবিষ্যতে আলোচনা হতে পারে। বিষয়টি তদন্ত করতে আইজিকে নির্দেশও দিতে পারেন! বর্তমান জনপ্রতিনিধি ও ভবিষ্যতের সম্ভাব্য জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে পার্থক্য রাখার দরকার কী!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.