সারমেয় সমাচার by শাহাদুজ্জামান

‘কুকুরের কাজ কুকুর করেছে...’ বিখ্যাত সেই কবিতাটি পড়েছিলাম ছোটবেলায়। মর্মার্থ এই যে, কুকুর ইতর প্রাণী, সে মানুষকে কামড়াতে পারে, তাই বলে কুকুরকে কামড়ানো মানুষের শোভা পায় না ইত্যাদি। নিজের করুণ জীবনের কথা বলতে গিয়ে বাস্তব এবং সাহিত্যের চরিত্রকে বলতে শুনেছি ‘কুকুরের মতো বেঁচে আছি’। বাঘ, ভালুক বলে কাউকে গালি দিলে ব্যাপারটা যতটা নয়, অপমানের মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যায় যদি তাকে ‘কুকুর’ বলে গালি দেওয়া হয়। মোট কথা, সাধারণভাবে কুকুরের জীবন নেহাতই অচ্ছুত, লজ্জাকর একটি জীবন হিসেবেই বিবেচিত। কুকুরবিষয়ক এ ধারণা আমূল পাল্টাতে হয়েছে ইউরোপের নানা শহরে ঘোরার সুবাদে। এখানে কুকুরকে নিয়ে যে আড়ম্বর, তার যে মর্যাদা আর বৈভব, তাতে কুকুরের মতো বেঁচে থাকাটাকে রীতিমতো সৌভাগ্য হিসেবেই বিবেচনা করা যায়।
বিমানে আমার সহযাত্রী এক আমেরিকান বৃদ্ধার সঙ্গে আলাপ জমে ওঠার একপর্যায়ে তিনি আমাকে তাঁর পারিবারিক অ্যালবামটি দেখান। অ্যালবামের শুরুর কয়েক পাতাজুড়ে শুধু তাঁর প্রিয় কুকুরটির ছবি। কুকুরের নাম ‘ভ্যান গঘ’। তাঁর প্রিয় চিত্রকরের নামে নাম রেখেছেন তিনি। বেশ অনেকক্ষণ ধরে তাঁর ভ্যান গঘ যে কেমন দুষ্টু, এ নিয়ে তিনি বিস্তর গল্প শোনান আমাকে। এর অনেক পর তিনি তাঁর দুই মেয়ে এবং স্বামীর ছবি দেখান। ব্যাপারটি অস্বাভাবিক নয়। কারণ, কুকুর এখন অধিকাংশ পশ্চিমা দেশে অন্যতম পারিবারিক সদস্য। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আমেরিকায় প্রায় ৭০ শতাংশ পরিবারে অন্তত একটি কুকুর আছে। জীববিদদের মতে, কুকুরই হচ্ছে প্রথম বন্য প্রাণী, যা মানুষের পোষ মেনেছে। একসময় কুকুর ছিল মানুষের শিকারের সহযোগী। পরবর্তীকালে কুকুরকে মানুষ ব্যবহার করেছে তার ঘর পাহারার কাজে। আধুনিক পশ্চিমা দেশে মানুষ এখন কুকুরকে স্থান দিয়েছে তার নিজের শোবার ঘরে। গবেষণায় দেখা গেছে, পশ্চিমা দেশে মানুষের সঙ্গে কুকুরের সম্পর্ক এখন শুধু এসব কেজো ব্যাপারে সীমাবদ্ধ নয় বরং এ সম্পর্ক এখন অনেক বেশি আবেগী, মানসিক। এখানে মানুষে মানুষে সম্পর্ক অনেকটা শিথিল হওয়ার কারণে যে বিচ্ছিন্নতা, নিঃসঙ্গতা দেখা দিয়েছে, তাতে কুকুরের আনুগত্য, বিশ্বস্ততা মানুষকে এনে দেয় স্বস্তি। অপূর্ণ ভালোবাসা আর বাৎসল্যের অনুভূতি তৃপ্ত হয় কুকুরের মধ্য দিয়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, এসব দেশে যাদের সঙ্গী হিসেবে কুকুর আছে, তারা কুকুরবিহীন মানুষের চেয়ে দীর্ঘায়ু।
কুকুরের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য এখানে তাই দেখি সীমাহীন আয়োজন। সুপার মার্কেটগুলোতে কুকুরের জন্য বরাদ্দ এলাকায় দেখতে পাই সুদৃশ্য প্যাকেটে কুকুরের জন্য চর্ব, চোষ্য, লেহ্য ও পেয় বিচিত্র খাবার; তার জন্য সাবান, শ্যাম্পু, পারফিউমের বিপুল সমাহার। আমস্টারডামে যখন পড়াশোনা করতাম, এক শিক্ষিকা প্রতি বুধবার ক্লাসের পর আগে আগে ছুটতেন বাড়িতে। সেদিন ছিল তাঁর বাড়ির কুকুর দুটোকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়ার তারিখ। ঘরে খেতে খেতে কুকুরদেরও একঘেয়ে লাগে বলে ওদের জন্য রয়েছে বিশেষ রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্ট ছাড়াও শুধু কুকুরের জন্য আছে পার্ক, সমুদ্রসৈকত, স্পা। ব্রিটেনে কেবল কুকুরকে নিয়ে আছে জনপ্রিয় সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান, তাতে থাকে কুকুরের ঝলমলে ফ্যাশন শো, কুকুরের শারীরিক, মানসিক রোগ বিষয়ে পরামর্শ ইত্যাদি। এ বছর ‘ব্রিটেন গট ট্যালেন্ট’ নামের প্রতিভা অন্বেষণ প্রতিযোগিতায় বহু মানুষ প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছে গিয়েছিল এক নৃত্যপটীয়সী কুকুর।
চেনবাঁধা, চেনহীন কুকুরকে নিয়ে অসংখ্য পথচারীর নিয়মিত রাস্তায়, পার্কে হাঁটতে দেখি। বিড়াল আকারের কুকুর থেকে শুরু করে দেখতে পাই বাঘের সমান কুকুরও। শুনি কার কোন জাতের কুকুর, এর ওপর নির্ভর করে তার আভিজাত্যও। পথচারীরা পরস্পরের মধ্যে কথা না বললেও তাঁদের কুকুরেরা যদি পরস্পরকে শোঁকার আগ্রহ দেখায়, তাহলে তাঁরা ধৈর্যের সঙ্গে কুকুরগুলোকে সেই সামাজিকতার সুযোগ দেন। পাশে দাঁড়িয়ে পরস্পরের কুকুরের রূপের প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। কুকুরের সঙ্গে সদয় ব্যবহার করা এখানে আইনগত কর্তব্য। কুকুরের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটলেও তার জরিমানার বিধান আছেন কোনো কোনো শহরে। দেখেছি নিজের শিশুর মতো প্যারামবুলেটারে তার কুকুরকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন মহিলা এবং মাঝেমধ্যে কুকুরের মুখে তুলে দিচ্ছেন বিষ্কুট। একদিন দেখলাম এক ভদ্রলোক তাঁর কুকুরটিকে সাইকেলের সামনের ঝুড়িতে বসিয়ে নিয়ে চলেছেন; কুকুরটির চোখে সানগ্লাস, গলায় টাই। প্রভুভক্ত, প্রাচীন বিশ্বস্ত এই প্রাণীটির কদরের কোনো কমতি নেই এখানে।
মোট কথা, বিদেশে এসে আমার অগাধ কুকুরজ্ঞান হয়েছে। অবশ্য কুকুরের এই বিপুল সমাদর দেখে বেশ হতচকিত থাকি, বুকের ভেতর একটা চাপা দীর্ঘশ্বাসও জমে থাকে সারাক্ষণ। ভাবি, পৃথিবীর অন্য প্রান্তে কত লাখ-কোটি মানুষ এমন একটা কুকুরের জীবন পেলেও কতই না বর্তে যেত। বহু দিন আগে পড়া সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পাদটীকা’ নামের একটি গল্পের কথা মনে পড়ে। গল্পটি গ্রামের এক স্কুলশিক্ষকের বয়ানে বলা। স্কুলে এসেছেন বিলাতি স্কুল ইন্সপেক্টর। সঙ্গে তার প্রিয় কুকুর। ঘটনাচক্রে কুকুরটির একটি পা নেই। তিন পায়ে লেংচে চলা ওই কুকুরটিকে নিয়ে স্কুল পরিদর্শন করেন তিনি। সবাই ভয়ে কম্পমান। প্রসঙ্গক্রমে ওই কুকুরটির পেছনে মাসে ইন্সপেক্টরের কত খরচ হয়, আমরা তা জানতে পারি। ইন্সপেক্টর চলে গেলে শিক্ষক ছাত্রদের হিসাব করে দেখান ওই তিন ঠ্যাংয়ের কুকুরের প্রতিটি ঠ্যাংয়ের পেছনে যা খরচ, তা তাঁর মাসিক বেতনের চেয়েও বেশি। ছাত্রদের আর বুঝতে বাকি থাকে না যে তাদের প্রিয় শিক্ষকের দাম বস্তুত বিলাতি ওই ইন্সপেক্টরের কুকুরের একটি পায়ের চেয়েও কম।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.