লেজুড়বৃত্তির অবসান কি একদম অসম্ভব by মশিউল আলম

ইসলামী ছাত্রশিবিরের কার্যকরী পরিষদের সাধারণ সম্পাদকসহ ২৬ জন কেন একযোগে পদত্যাগ করলেন? ওই খবর প্রকাশের পর দুই দিনে সারা দেশে আরও ১৯৪ জন শিবির-সদস্যের গণপদত্যাগের কারণ কী? পদত্যাগকারীদের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমে পদত্যাগের যে কারণ উল্লেখ করা হয়েছে—সেই অভ্যন্তরীণ কোন্দলই কি এসব পদত্যাগের প্রকৃত কারণ, না এর পেছনে অন্য কোনো রহস্য আছে?
এসব প্রশ্ন আর এ নিয়ে নানা রকমের জল্পনাকল্পনা এখন রাজনীতির অঙ্গনে চলছে। তা চলুক; এই লেখায় আলোচনা করতে চাই এমন একটি প্রসঙ্গ, যা শুধু ইসলামী ছাত্রশিবির নয়, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগকেও স্পর্শ করবে।
প্রথমে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সাধারণ সম্পাদকসহ ২৬ জন নেতার গণপদত্যাগের বিষয়টি লক্ষ করা যাক। এই ছাত্রসংগঠনটির কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের মোট সদস্যসংখ্যা ৪১। এর মধ্যে ২৬ জন পদত্যাগ করলেন। অর্থাত্ পদত্যাগ করলেন অর্ধেকেরও বেশি; তাঁদের মধ্যে সাধারণ সম্পাদক, অর্থাত্ দ্বিতীয় শীর্ষস্থানীয় নেতাও আছেন। শিবিরের সভাপতি রেজাউল করিমের স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদে তাঁরা পদত্যাগ করেছেন বলে পদত্যাগকারী একাধিক নেতার বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। সভাপতির স্বেচ্ছাচারিতাই যদি মূল আপত্তির বিষয়, তাহলে তাঁকে ইমপিচ (অভিশংসন) করাই তো ছিল যুক্তিসংগত পদক্ষেপ; এবং সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে সেটা অবশ্যই হতে পারত। কারণ ছাত্রশিবিরের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কার্যকরী পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য মিলিতভাবে এটা করার অধিকার রাখেন। কিন্তু সভাপতিকে অভিশংসন না করে নিজেরাই কেন পদত্যাগ করলেন অধিকাংশ সদস্য? এই প্রশ্নের উত্তরে পদত্যাগকারী তিন নেতা প্রথম আলোর প্রতিবেদককে বলেছেন, তাঁরা শিবিরের সভাপতি রেজাউল করিমের স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের জানিয়েছিলেন, কিন্তু নেতারা তাতে কর্ণপাত করেননি। তাই তাঁরা নিজেরাই সরে এসেছেন। অর্থাত্ ইসলামী ছাত্রশিবিরের পরিপূর্ণ আনুগত্য ও নির্ভরশীলতা জামায়াতে ইসলামীর ওপর। ছাত্রসংগঠনটির অধিকাংশ সদস্য একজোট হয়েও জামায়াতের নেতাদের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেন না। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ কয়েকজন নেতা শিবির-সভাপতি রেজাউল করিমকে দিয়ে ছাত্রসংগঠনটিকে নিজেদের ইচ্ছামতো ব্যবহার করছেন—এমন অভিযোগ তাঁরা তুলেছেন; কিন্তু কার্যকর প্রতিকারে সচেষ্ট না হয়ে নিজেরাই সরে গেছেন; খোদ সংগঠন থেকেই বিদায় নিয়েছেন। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এই: ইসলামী ছাত্রশিবির স্বতন্ত্র কোনো ছাত্রসংগঠন নয়, প্রকৃতপক্ষে জামায়াতে ইসলামী নামের একটি নিবন্ধিত জাতীয় রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্তে পরিচালিত একটি অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন। জামায়াতের ওপরই নির্ভর করে শিবিরের অস্তিত্ব, জামায়াত নেতাদের অঙ্গুলিহেলনেই কাজ করেন শিবিরের নেতা, কর্মী ও সমর্থকেরা।
এটা বেআইনি। সরকার এ বিষয়ে আইনি প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নিতে পারে। তেমন আইন এখন বলবত্ আছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (সংশোধিত) আইন ২০০৯-এর ৯০ (১) (খ) ধারা অনুযায়ী যদি কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনের অধীনে নিবন্ধিত হতে চায়, তাহলে তার গঠনতন্ত্রে এই সুস্পষ্ট বিধান থাকতে হবে যে, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বা ছাত্র বা আর্থিক, বাণিজ্যিক বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারী-কর্মকর্তা বা শ্রমিক বা অন্য কোনো পেশার সদস্যদের নিয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনকে অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন হিসেবে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ...। জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত একটি রাজনৈতিক দল। ইসলামী ছাত্রশিবিরের ওপর কোনো ধরনের কর্তৃত্ব করার এখতিয়ার তাদের নেই। যদিও তাদের গঠনতন্ত্রে অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনের উল্লেখ নেই, কিন্তু শিবিরের একাধিক পদত্যাগী নেতা অভিযোগ করেছেন, মুজাহিদসহ জামায়াতের কয়েকজন নেতা ছাত্রশিবিরকে নিজেদের ইচ্ছামতো ব্যবহার করছেন। তাঁরা এ অভিযোগটি লিখিতভাবে নির্বাচন কমিশনকে জানাতে পারতেন।
কয়েক দিন আগে বিএনপির চেয়ারপারসন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতাদের তিন সপ্তাহের মধ্যে ছাত্রসংগঠনটির স্থায়ী গঠনতন্ত্র তৈরি করার নির্দেশ দিয়ে বললেন, এখন থেকে শুধু ছাত্ররাই ছাত্রদলের নেতৃত্বে থাকবে, যাঁদের ছাত্রত্বের মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে, তাঁরা যাবেন বিএনপি ও যুবদলে। প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, বিএনপির চেয়ারপারসন ছাত্রদলের নেতাদের এমন নির্দেশ দেওয়ার অধিকার রাখেন কি না। কোনোভাবেই না। বিএনপিও একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল। আইনত তার কোনো সহযোগী বা অঙ্গসংগঠন থাকতে পারে না।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিয়েও আওয়ামী লীগ সরকার যারপরনাই বিব্রত। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কয়েকবার ছাত্রলীগের ব্যাপারে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। একবার আক্ষেপ করে বলেছেন, ছাত্রলীগের ছেলেরা চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি করলে তাঁর দুঃখ হয়। তিনি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক প্রধানের পদটিও ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু ছাত্রলীগ এখনো সরকারি দল আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণেই চলছে, যদিও এই নিয়ন্ত্রণ কতটা কঠোর তা বোঝা যাচ্ছে না। কারণ ছাত্রলীগের নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে সরকারের জন্য বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।
সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্বি আদেশ আইন ২০০৯-এর রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনসংক্রান্ত ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ঘটছে ছাত্রদল, ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের ওপর আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর প্রত্যক্ষ কর্তৃত্বের মধ্য দিয়ে। অন্যান্য ছোট ছোট রাজনৈতিক দল ও তাদের অনুসারী ছাত্রসংগঠনগুলোর তত্পরতা ততটা দৃশ্যমান নয় যদিও, কিন্তু তাদেরও বাদ দেওয়া যায় না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির গঠনতন্ত্রে অঙ্গ/সহযোগী সংগঠনসংক্রান্ত ধারায় আইনের নিবন্ধনসংক্রান্ত শর্ত সুস্পষ্টভাবে লংঘন করা হয়েছে। বিএনপির গঠনতন্ত্রে পরিষ্কার বলা হয়েছে: ‘দলের এক বা একাধিক অঙ্গসংগঠন থাকতে পারে। এই সকল অঙ্গসংগঠনের নিজস্ব ঘোষণাপত্র, গঠনতন্ত্র, পতাকা ও কার্যালয় থাকবে এবং এইসকল অঙ্গসংগঠন মূল দলের শৃঙ্খলার আওতাধীন থাকবে।’ বিএনপির চেয়ারপারসনকে কার্যত সব অঙ্গসংগঠনের সর্বময় নিয়ন্ত্রকের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে অঙ্গসংগঠনের বদলে আছে সহযোগী সংগঠনের কথা: ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নীতিনির্ধারণ করিবে।...সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় সম্পাদক সংশ্লিষ্ট সহযোগী সংগঠনের কার্যক্রম তদারক ও সমন্বয় সাধন করিবেন।’
আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ঘটছে সবার চোখের সামনেই। ছাত্রসংগঠনগুলোকে রাজনৈতিক দলগুলোর ইচ্ছামতো ব্যবহার করা এমনই চিরাচরিত প্রকাশ্য ব্যাপার হয়েছে যে এর বিরুদ্ধে আইন আছে—এ কথাই কারোর স্মরণে আছে বলে মনে হয় না। নির্বাচন কমিশনও কখনো এ বিষয়ে কোনো কথা বলেছে বলে শুনিনি। তবে জানতে পেরেছি, কমিশন এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন, আইনি ব্যাপারগুলো খতিয়ে দেখছে।
আইন আছে, কিন্তু তার প্রয়োগ নেই—তাহলে আইন করার কী মানে দাঁড়ায়? রাজনৈতিক দলগুলো অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনের মাধ্যমে অনুগ্রহ বিতরণ ও তার বিনিময়ে দলের শক্তিবৃদ্ধির যে চর্চা করে আসছে, তার অবসান ঘটানোর জন্য অঙ্গ/সহযোগী সংগঠন রাখাকে নিষিদ্ধ করে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ আইনে সংশোধনী আনার সময় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশন আলোচনা করেছিল, একতরফাভাবে তাদের ওপর এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো তাতে রাজিও হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কার সংশোধিত অধ্যাদেশটি তাই নবম সংসদে অপরিবর্তিত অবস্থায় পাস করা হয়েছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ইতিবাচকভাবে বদলে দেওয়ার জন্য খুব শক্তিশালী এ আইনি হাতিয়ার জাতিকে উপহার দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার প্রশংসা পেয়েছে। কিন্তু এখন আইনটির অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশকে প্রায় অকার্যকর করে দেওয়া সত্যিই দুঃখজনক। আইন প্রয়োগ করার দায়িত্ব সরকারের, কিন্তু সরকারি দল নিজে ছাত্রসংগঠনকে সহযোগী সংগঠন হিসেবে রেখে তো অন্যদের বিরুদ্ধে এ সংক্রান্ত আইন প্রয়োগ করতে পারে না।
রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে পরিবর্তনের প্রত্যাশা করা হয়েছিল তার কিছুমাত্র অংশ পূরণের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এটা খুবই হতাশার কথা। কিন্তু আওয়ামী লীগ এমন একটি ঐতিহ্যবাহী ও শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন, যার কাছ থেকে পরিবর্তন প্রত্যাশা করা উচিত। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যে অভূতপূর্ব বিজয় ঘটেছে, তা কি দলটির প্রতি বিপুল জনসমর্থনের প্রত্যক্ষ প্রমাণ নয়? এই সমর্থনের জোরে আওয়ামী লীগ লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির অবসান ঘটাতে প্রথম পদক্ষেপটা অবশ্যই নিতে পারে। সহযোগী সংগঠনের নামে যেসব আপদ আওয়ামী লীগ ও তার সরকারের জন্য বারে বারেই বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে, তাদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে আওয়ামী লীগ পথ দেখাতে পারে। চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, জবরদখলকারী, সন্ত্রাসীদের ওপর থেকে সব ছত্রচ্ছায়া তুলে নিলে সরকারি দল ও সরকারের প্রতি জনগণের সমর্থন অনেক বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে বাড়বে সরকারের নৈতিক বল, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে তখন কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকবে না। নিজেদের যেসব দুর্বলতা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথে বাধা হিসেবে কাজ করে, সহযোগী সংগঠনগুলোকে বিলুপ্ত করার মধ্য দিয়ে সরকার সেগুলোর অনেকটাই সরিয়ে ফেলতে পারে। এটা করা আওয়ামী লীগের পক্ষে অন্য যেকোনো দলের চেয়ে বেশি সহজ। কারণ এ দলের জনভিত্তি খুব গভীর ও বিস্তৃত।
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.