কিশোরগঞ্জে ছড়ার মেলা -চারদিক by সাইফুল হক মোল্লা

২০০৫ সালে এ স্লোগান ধারণ করে শুরু হয়েছিল কিশোরগঞ্জ ছড়া উত্সব। পরে ২০০৬ সালে ‘মানবিক শুভতার লক্ষ্যে, ছড়া হোক মানুষের পক্ষে’। ২০০৭ সালে ‘বিবেকের মুক্তির জন্য, ছড়া হোক হাতিয়ারে গণ্য’। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ‘ছড়া দিয়ে রুখবোই যত ষড়যন্ত্র, জয় হোক মানুষের, জয় গণতন্ত্র’। ২০০৯ সালে ‘দিনবদলের অঙ্গীকারে, জাগবে ছড়া বারেবারে’। আর সর্বশেষ, ২০১০ সালে ‘উত্সবের অঙ্গীকার, যুদ্ধাপরাধীর বিচার’ স্লোগান ব্যক্ত করে কিশোরগঞ্জ প্রেসক্লাব মুক্তমঞ্চে ষষ্ঠবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়েছে কিশোরগঞ্জ ছড়া উত্সব।
৯ জানুয়ারি প্রেসক্লাব মুক্তমঞ্চে ছড়া উত্সবকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত কবি-সাহিত্যিকদের মিলনমেলা বসেছিল।
পাঁচ বছরের ধারাবাহিকতায় এবার ভিন্ন রকম আমেজে দিনব্যাপী ‘ষষ্ঠ কিশোরগঞ্জ ছড়া উত্সব’ উদ্যাপিত হয়েছে। উত্সব কেন্দ্র করে সর্বস্তরের ছড়াকার, কবি ও সাহিত্যপ্রেমীদের উত্সাহ-উদ্দীপনা ছিল দেখার মতো। সাহিত্যাঙ্গনে তা সৃষ্টি করে অভূতপূর্ব প্রাণের স্পন্দন। এই মহতী উত্সবকে কেন্দ্র করে ছড়াকার-কবি-সাহিত্যিকেরা যেন এক মঞ্চে এককাট্টা হয়েছিলেন।
সকালে ছিল বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রাটি প্রেসক্লাব মুক্তমঞ্চ থেকে বের হয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে পুনরায় প্রেসক্লাবে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে বেলুন উড়িয়ে ছড়া উত্সবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান আবুল কাসেম ফজলুল হক।
‘আব্বে হালায় কয় কি হুনেন, রাজাকারের পোলা/চাপার জোরে সাদা পানি, করবার চায় ঘোলা/আমরা মাগার জিন্দা আছি/না খায়া-না পিন্দা আছি/তব্বু হালায় তোগোর লগে/নাইকা আপস-মিল/আমরা মাগার মুক্তিসেনা/সাহস ভরা দিল্।’ ‘ধর, রাজাকার ধর, ছালার ভেতর ভর।’ ‘রাজাকার, দেশ ছাড়, হবে তোর বিচার।’ এ রকম অসংখ্য তেজি ছড়া একঝাঁক শিশুর সম্মিলিত সুরে পরিবেশনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ছড়া উত্সবের পর্দা ওঠে।
পরে ছড়া উত্সব পরিচালনা পর্ষদের আহ্বায়ক আহমেদ উল্লাহর সভাপতিত্বে প্রথম পর্বের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান আবুল কাসেম ফজলুল হক। বিশেষ অতিথি ছিলেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নূরে আলম সিদ্দিকী, এম এ আফজল, শাহ আজিজুল হক, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আসাদ উল্লাহ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক শেখ ফরিদ আহমেদ প্রমুখ।
প্রধান অতিথি তাঁর আলোচনায় ছড়াকে প্রতিবাদের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম উল্লেখ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে জনমত তীব্রতর করার জন্য ছড়াকারদের আরও ঝাঁঝালো ভাষায় নতুন নতুন ছড়া লেখার তাগিদ দেন। তিনি বলেন, ‘ছড়াকে বাংলা সাহিত্যে গুরুত্ব না দেওয়ার একটি প্রবণতা অনেক দিন ধরেই লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু আধুনিক ছড়াকারেরা তাঁদের লেখনীর জোরে প্রমাণ করে দিয়েছেন, ছড়া কোনো হেলাফেলা বা তাচ্ছিল্যের বিষয় নয়।’ তিনি ছড়াকারদের সাহিত্যের সবচেয়ে শক্তিশালী কলমযোদ্ধা হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, ‘এই কলমযোদ্ধারা কিশোরগঞ্জে প্রতিবছর ছড়া উত্সব করে নিজেদের সেই ঐক্য ও শক্তিমত্তার প্রমাণ রাখছেন।’ তিনি উত্সবকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত ছড়ার বই ও ছড়ার কাগজের সবগুলো ছড়াকে পশ্চিমবঙ্গের ছড়ার সঙ্গে তুলনা করে একটি গ্রন্থে দুই বাংলার সব ছড়াকে মলাটবদ্ধ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
দ্বিতীয় পর্বে অধ্যাপক প্রাণেশ কুমার চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব শাফিক আলম মেহেদী। বিশেষ অতিথি ছিলেন কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. শাহ কামাল, বাংলাদেশ গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের পরিচালক ছড়াকার আলম তালুকদার, ছড়াকার ফারুক নওয়াজ, আহমেদ জসীম, সিরাজুল ফরিদ, অধ্যক্ষ গোলসান আরা বেগম, অধ্যক্ষ শরীফ সাদী প্রমুখ।
এ পর্বে স্বাগত বক্তব্য দেন উত্সব পরিচালনা পর্ষদের সদস্যসচিব ছড়াকার জাহাঙ্গীর আলম জাহান। তিনি বলেন, ‘কিশোরগঞ্জে ছড়া উত্সবকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে যে যাত্রার সূচনা করেছিলাম, সবার সম্মিলিত প্রয়াসে তা ক্রমান্বয়ে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে; যা আগামী দিনে ছড়াকারদের জাতীয় ঐক্যকে নিশ্চিত করবে।’
উত্সবকে কেন্দ্র করে ছয়টি বই প্রকাশিত হয়। উত্সবে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রয়াত ছড়াকার শাহ সোহরাব উদ্দিনের গীতিকাব্য ভাণ্ডারীয় শাহী গীতি, মাজহার মান্নার কাব্যগ্রন্থ নিঃসঙ্গ লাটাই, আমিনুল ইসলাম সেলিমের ছড়াগ্রন্থ চিচিংফাঁকের দেশ, সাহিত্যের কাগজ বুনন, ছড়ার কাগজ আড়াঙ্গি ও খামচার মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
পরে উত্সবের অন্যতম আকর্ষণ সুকুমার রায় সাহিত্য পদক ও বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয় কবি অজামিল বণিককে তাঁর কেউ কেউ দেখে কাব্যের জন্য এবং ছড়াকার মো. নবী হোসেনকে তাঁর টাট্টুঘোড়ার ডিম ছড়াগ্রন্থের জন্য।
তৃতীয় পর্বে কিশোরগঞ্জ জেলাসহ অন্যান্য জেলা থেকে আগত কবি, ছড়াকার ও সাহিত্যিকদের কণ্ঠে উন্মুক্ত ছড়া-কবিতা আবৃত্তি করা হয়। এতে প্রায় দুই শতাধিক কবি-ছড়াকার অংশ নেন। পরে শিশু-কিশোর-তরুণদের সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন ও ছড়ালিখন প্রতিযোগিতায় শীর্ষস্থান অধিকারীদের মধ্যে পুরস্কার ও সনদ বিতরণ করা হয়।
ছড়ায় ছড়ায় কিশোরগঞ্জ মাতিয়ে গেলেন ছড়াকারেরা। যৌবনের দীপ্তি যেন প্রকাশ পাচ্ছিল তাঁদের উপস্থিতিতে।

No comments

Powered by Blogger.