লোথার ম্যাথাউস এখন ফুটবল-দূত

সেদিন ছিল জার্মানির জার্সি। আর এ দিন তিনি স্যুটেড-বুটেড। সেটি ছিল মিলানের সান সিরো। এ দিন কলকাতার এক হোটেল। মাঝখানে বি-শ বছর।
লোথার ম্যাথাউসকে দেখে তা বোঝার উপায় নেই!
খেলোয়াড়ি জীবনের চেহারাটা এখনো এমনভাবেই ধরে রেখেছেন যে, চাইলে এই ৪৭ বছর বয়সেও যেন আবার নেমে যেতে পারেন মাঠে!
বিশ বছর আগে তাঁর ফুটবল-জীবনকে পূর্ণতা দিতে এসেছিল সেই রাত। ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে তুলে ধরেছিলেন বিশ্বকাপ ট্রফি। কাল কলকাতার শীতার্ত দুপুরে সেই ট্রফি লোথার ম্যাথাউসকে আবার ভাসিয়ে দিল বিশ বছর আগের সেই অনির্বচনীয় অনুভূতিতে। ‘বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক হিসেবে এই ট্রফিটা তুলে ধরার অনুভূতি আসলে বলে বোঝানোর নয়’—বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্তটাও ধরা আছে এতেই।
এই বিশ্বে কজনেরই বা পরিচয় আছে সেই সুখানুভূতির সঙ্গে! তবে কাছ থেকে চর্মচক্ষে সোনার ওই ট্রফিটা দেখার অনুভূতিই কি কম রোমাঞ্চের! ফিফা বিশ্বকাপের অন্যতম স্পনসর কোকাকোলার সৌজন্যে যেটির সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে কলকাতাবাসীর। দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের আগে কোকের হাত ধরে এই ট্রফির বিশ্বভ্রমণের সূচনা হলো কলকাতায়। সেটিকে কেন্দ্র করে তিন দিনের উত্সব। মধ্যমণি অবশ্যই লোথার ম্যাথাউস।
এই ট্রফি যেখানেই যাবে, ম্যাথাউসের মতো কাউকে লাগবেই। বিশ্বকাপজয়ী খেলোয়াড় বা রাষ্ট্রপ্রধান ছাড়া আর কারও যে ওই ট্রফি তুলে ধরার অধিকার নেই। আপনি কী ভাবছেন, তা অনুমান করতে পারছি। ২০০২ সালেই না বাংলাদেশ ঘুরে গেছে ওই ট্রফি। কতজনই তো তা ছুঁয়েছেন। আবেগে উদ্বেল বাংলাদেশের স্ট্রাইকার আলফাজ আহমেদ যে অনুভূতি বোঝাতে দিয়েছিলেন অমর এক বাণী, ‘আজগুবি ব্যাপার!’ স্পনসরদের প্রভাবে আলফাজের মতো বাংলাদেশের অনেকেই বুঝতেও পারেননি, ওটি ছিল বিশ্বকাপ ট্রফির রেপ্লিকা। আসল ট্রফি নয়।
আসল ট্রফির এমনই মহিমা যে, সেটির জন্য বরাদ্দ প্রায় রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য নির্ধারিত নিরাপত্তাব্যবস্থা। গত পরশু কলকাতায় আগমনের পরই যেমন বোমা মারলেও কিছু হবে না এমন বিশেষ একটা ভল্টে রাখা হয়েছে এটিকে। ট্রফির এই বিশ্বভ্রমণে সঙ্গী হয়েছে ফিফার নিজস্ব নিরাপত্তাদলও।
আজ সল্টলেকের যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে সাধারণ্যে প্রদর্শিত হবে সেই ট্রফি। গতকাল দুপুরের আয়োজন শুধুই সংবাদমাধ্যমের জন্য। যেটির মূল আকর্ষণ অবশ্যই লোথার ম্যাথাউসের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্ব। যাতে দারুণ সপ্রতিভ ফিফার প্রথম বিশ্বসেরা ফুটবলার। উপস্থাপক দোভাষীর কথা বলেছিলেন। হাত নেড়ে সে প্রস্তাব উড়িয়ে দিয়ে ইংরেজিতে কথা বললেন। মাঝেমধ্যেই পরিচয় দিলেন দারুণ রসবোধেরও।
নিজের ক্যারিয়ার, জার্মান ফুটবল, ২০১০ বিশ্বকাপ, ম্যারাডোনা, মেসি-ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো দ্বৈরথ, অঁরি-বিতর্ক...বিচিত্র সব বিষয় ছুঁয়ে যাওয়া সেই প্রশ্নোত্তর পর্বে সবচেয়ে বেশি মূর্ত হয়ে উঠল ম্যাথাউসের ফুটবল-প্রেম। ‘চাইলেই কেউ ম্যারাডোনা-রোনালদো হতে পারবে না। আমি শুধু বলি, খেলাটা উপভোগ করো। এটা দারুণ একটা খেলা, যা জাতি-বর্ণ-ভাষার ব্যবধান ঘুচিয়ে দেয়’—বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে এত সব অর্জনের চেয়েও এই উপভোগ্যতাই ফুটবলে ম্যাথাউসের পাওয়া সবচেয়ে বড় উপহার।
অর্জনের কথা বললে একটা জায়গায় তো পেলে-ম্যারাডোনাও তাঁর পেছনে! ১৯৮২ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত পাঁচটি বিশ্বকাপে খেলেছেন ২৫টি ম্যাচ। বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার এই রেকর্ড কোনো দিন ভাঙবে কি না, এ নিয়ে তর্ক হতেই পারে।
সময়টা আবার লক্ষ করুন। এটা তো ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনার সময়! ম্যাথাউসের বিশ্বকাপ ক্যারিয়ারেও স্মরণীয়তম স্মৃতি হয়ে আছে ম্যারাডোনার সঙ্গে দ্বৈরথের সেই হিরণ্ময় মুহূর্তগুলো। স্মৃতিচারণার সময় ম্যাথাউসও যেন এক দশকেরও বেশি বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী মিডফিল্ডার থেকে ম্যারাডোনা-ভক্তে রূপান্তরিত! ‘আমি বিশ বছর পেশাদার ফুটবল খেলেছি। ম্যারাডোনার চেয়ে ভালো কোনো খেলোয়াড় দেখিনি।’
ম্যারাডোনার প্রতি এই পেশাদার শ্রদ্ধা ফেরতও পেয়েছেন। আত্মজীবনীতে ম্যারাডোনা তাঁর কঠিনতম প্রতিপক্ষের স্বীকৃতি দিয়েছেন ম্যাথাউসকে। আজও যেটিকে মাথায় করে রাখেন ম্যাথাউস, ‘একটা কারণ হয়তো আমি ফেয়ার খেলেও ওকে আটকাতে চেয়েছি। ওর পা ভেঙে দিতে চাইনি।’
ছিয়াশির বিশ্বকাপ ফাইনালে ম্যারাডোনাকে মার্কিং করার কঠিন দায়িত্বটাও পড়েছিল তাঁর ওপর। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? ম্যাথাউস হাসেন, ‘খুব কঠিন। ম্যারাডোনা এমন সব কিছু করত যে, ওর দিকে সারাক্ষণই মনোযোগ রাখতে হতো। তবে আমি ওর চেয়ে দ্রুততর ছিলাম বলে অনেক বল কেড়ে নিতে পেরেছি।’ হাসিটা আরও বিস্তৃত করে এরপরই ম্যাথাউস জানান, ‘শুধু জার্মানি-আর্জেন্টিনা কেন, ইন্টার মিলান-নাপোলিতেও আমরা ছিলাম প্রতিপক্ষ। আমি যেসব ম্যাচে খেলেছি, ম্যারাডোনা কোনো গোল করতে পারেনি, এটা আমার অনেক বড় তৃপ্তির জায়গা।’
২০১০ বিশ্বকাপে তাঁর ফেবারিট স্পেন। তবে সঙ্গে যোগ করে দিতে ভুললেন না, ‘এর মানে এই নয় যে, স্পেনই বিশ্বকাপ জিতবে।’ কিন্তু ম্যাথাউসের জার্মানি? ট্রফি হাতে ম্যাথাউসের সেই ছবিতেই থমকে আছে যাদের বিশ্বকাপ-সাফল্য! ম্যাথাউস আবার মনে করিয়ে দিলেন জার্মান ফুটবলের মাহাত্ম্যটা, ‘জার্মানি সব সময়ই ফেবারিট। হয়তো দলে অনেক গ্রেট খেলোয়াড় নেই, কিন্তু জার্মানি দল হিসেবে সব সময়ই দুর্দান্ত। কারণ আমরা শেষ বাঁশি বাজার আগ পর্যন্ত হার মানি না। এটাই জার্মানির শক্তি। এই যে কদিন আগে আফ্রিকান নেশসন কাপে ৪-০ এগিয়ে গিয়েও ড্র করতে হলো অ্যাঙ্গোলাকে। জার্মানির বিপক্ষে এটা কখনোই হবে না।’
জাতীয় দলের জার্সি গায়ে না হোক, ক্লাব ফুটবলে এই শেষ বাঁশি বাজার আগেই ম্যাচ শেষ ভেবে নেওয়ার পরিণতির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে ম্যাথাউসেরও। ১৯৯৯ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি ফাইনালে বাড়তি সময়ে দুই গোল খেয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কাছে বায়ার্ন মিউনিখের পরাজয় এখনো পোড়ায় তাঁকে, ‘মাত্র ৯০ সেকেন্ডে আমাদের ট্রফিটা ম্যানইউ নিয়ে গেল! এই একটা ম্যাচ আমি ভুলে যেতে চাই। আবার চাইও না। বরং আমি সবাইকে এটি মনে করিয়ে দিয়ে বলি, শেষ বাঁশি বাজার আগে কোনো উদ্যাপন নয়।’ সবচেয়ে যন্ত্রণার ম্যাচ এটি, সবচেয়ে আনন্দের? ১৯৯০ বিশ্বকাপে যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে ৪-১ গোলে জয়, যাতে তাঁর নিজের দুই গোল।
বর্তমানে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়ের কথা উঠল (‘২০০৯ মনে রাখলে অবশ্যই মেসি’), বিশ্ব ফুটবলে আফ্রিকা-এশিয়ার উঠে আসা, স্টেফি গ্রাফের সঙ্গে টেনিস খেলার স্মৃতি...। তবে প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে ঘুরে বেড়ানো লোথার ম্যাথাউসের যে ছবিটা শেষ পর্যন্ত মনে গেঁথে রইল, সেটি বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক লোথার ম্যাথাউস নন।
ফুটবলের দূত লোথার ম্যাথাউস!

No comments

Powered by Blogger.