জার্মানিতে বাঙালির গৌরব ও লজ্জা -ইউরোপের জানালা by সরাফ আহমেদ

হলভর্তি লোকজনের সামনে বাংলাদেশের গৌরবগাথার কথা বলছেন তিনি। জার্মান পার্লামেন্টের উন্নয়নবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি ইয়ুরগুন ক্লেমকে এমপি বলছেন তাঁর বাংলাদেশ সফরের অভিজ্ঞতা আর অনুভূতির কথা, ‘ধরুন, আমাদের দক্ষিণ জার্মানের বাভেরিয়া আর বাডেন ভুটেনবার্গের আয়তনের সমান আয়তনের বাংলাদেশে প্রায় ১৬ কোটি লোকের বাস আর আমাদের এই দুটি প্রদেশে বাস করে মাত্র ২৩ লাখ মানুষ। অথচ ওই ছোট এক ভূখণ্ডে ১৬ কোটি লোকের খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে; রাস্তাঘাট, পরিবহন, শিক্ষা, চিকিৎসাব্যবস্থা সবই চলছে। রয়েছে অভিজ্ঞ সুশীল সমাজ এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত এনজিও নেটওয়ার্ক আর অনেক নারীকর্মী।’ জার্মান সরকারের এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলবিষয়ক রাজনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের প্রধান ক্রিশ্চিয়ান ভাগনার বললেন, তাঁদের গবেষণায় উঠে আসছে যে আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় সামাজিক ও অর্থনীতিক উন্নয়নে আগুয়ান শক্তি হিসেবে দেখা যাবে। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে জার্মানিতে থাকি, বাংলাদেশকে নিয়ে জার্মানিতে এমন উচ্ছ্বসিত কথাবার্তা শুনিনি। শুনতে শুনতে অজান্তেই চোখে পানি চলে আসে।
২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে বার্লিন শহরের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের উন্নয়নবিষয়ক সংগঠন কনরাড আডেন আওয়ার ফাউন্ডেশন আয়োজিত তাদের সদর দপ্তরের সেই সেমিনারে আলোচনার বিষয় ছিল বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার পরিবেশ ও জ্বালানির নিরাপত্তা। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনিও উপস্থিত ছিলেন, আরও উপস্থিত ছিলেন সাবেক জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফলকার রুয়ে, পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্য, আমলা, জার্মানির দক্ষিণ এশীয় বিশেষজ্ঞরা এবং আমরা কিছু বাঙালি।
এর মধ্যে খবর পেলাম জার্মান পার্লামেন্টের দক্ষিণ এশিয়া উন্নয়নবিষয়ক সংসদীয় কমিটির আট সদস্য এ বছরেরই মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে জার্মান অনুদানে পরিচালিত প্রকল্পগুলো দেখতে বাংলাদেশ যাবেন। একই কাজে তাঁরা প্রতিবেশী দেশ ভুটান সফর করবেন। আর যাওয়ার আগে তাঁরা জার্মানিতে বাংলাদেশ বিষয় নিয়ে যাঁরা কাজকর্ম করেন তাঁদের সঙ্গে বার্লিনে পার্লামেন্ট ভবনে কথা বলবেন। আলোচনায় প্রথমেই শাহবাগ আন্দোলন প্রসঙ্গ, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি, বাংলাদেশজুড়ে জামায়াতের সহিংসতা, বৌদ্ধ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা-ভাঙচুর, আগামী নির্বাচন—এসব প্রসঙ্গ আসে। সবশেষ ড. ক্লেমকে জানান, বলতে খারাপ লাগলেও তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এবার তাঁরা বাংলাদেশ যাবেন না, শুধু ভুটান সফর করেই ফিরে আসবেন। নানা সূত্রে তাঁদের কাছে বাংলাদেশে নিরাপত্তাহীনতার খবর আছে। মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়।
কদিন আগে একটি সেমিনারে আবার দেখা হয় জার্মানির দক্ষিণ এশীয় বিজ্ঞান ও রাজনীতিবিষয়ক গবেষণা ফাউন্ডেশনের দক্ষিণ এশীয় বিভাগের পরিচালক ক্রিশ্চিয়ান ভাগনারের সঙ্গে। দীর্ঘদিন বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করছেন। সাম্প্রতিক সহিংসতা ও হরতাল আর নির্বাচন নিয়ে তাঁর চেহারায় দেখি হতাশার ছায়া। বললেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করতে জার্মানিসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বড় অঙ্কের তহবিল জোগাচ্ছে, তাই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আমাদের কাম্য।’ উল্লেখ্য, এই ফাউন্ডেশনই জার্মান সরকারকে বিভিন্ন দেশের নানা ঘটনার গবেষণা প্রতিবেদন দিয়ে থাকে।
এরপর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহান্তে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৈদেশিক ও নিরাপত্তানীতি-বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্যাথেরিনা অ্যাসটন বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন। সেখানে তিনি ধর্মীয় মৌলবাদীদের সহিংসতায় সবচেয়ে বেশি হামলার শিকার গোষ্ঠীগুলো, বিশেষ করে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে, রক্ষায় সহিংসতা রোধ এবং আরেকটি গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচনের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশের প্রধান দলগুলোকে আলোচনায় বসার তাগিদ দেন।
দেশজুড়ে হেফাজতিদের সহিংস আন্দোলন ও তাদের ১৩ দফা প্রশ্নে ঢাকায় নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত আইনবিদ আলব্রেখট কনজে ঢাকায় প্রকাশ্য একটি সভায় বলেছেন, হেফাজতে ইসলামের দাবি-দাওয়াগুলো বাংলাদেশের সেক্যুলার ঐতিহ্যের সঙ্গে মোটেও মেলে না; তা ছাড়া বাংলাদেশ ইরানের মতো ইসলামিক প্রজাতন্ত্র নয়, এটি একটি গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু বের্নহাড হার্টলাইন বহুবার বাংলাদেশে গেছেন। এর মধ্যে একদিন বললেন, বহুবার বাংলাদেশ সফরের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, বাংলাদেশে পরিবহনের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বাস-ট্রেন নেই অথচ প্রায় প্রতিদিন বাস-ট্রাক পুড়ছে; রাজশাহী, ঢাকা, চট্টগ্রামে ট্রেনে আগুন দেওয়া হয়েছে, এসব কারা করছে? আমি চুপ করে থাকি। কারা এসব পোড়াচ্ছে বা আমার দেশের সমস্যা, আমার থেকে আমার জার্মান বন্ধুবরের বেশি জানার কথা নয়।
ভিনদেশি আলব্রেখট কনজে, ক্যাথেরিনা অ্যাসটন, ক্রিশ্চিয়ান ভাগনার বা বের্নহাড হার্টলাইন বাংলাদেশের যে সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য বা গণতন্ত্র ও সহিংসতার কথা বললেন, তা ক্ষমতার মোহে বা ক্ষমতার লোভে আমাদের অনেক রাজনীতিক বোঝেন না বা না বোঝার ভান করছেন। কিন্তু বাংলাদেশে না জন্মেও ভিনদেশিরা বাংলাদেশের আত্মা আর জনগণের কথা বলছেন।
সবশেষে গত ২৪ এপ্রিল সাভার ট্র্যাজেডি, বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বাধীনতাযুদ্ধের পর এক দিনে হাজারের ওপর মানুষের মৃত্যুর ঘটনা বিরল। সেদিন থেকেই ইউরোপের সব পত্রিকা আর টেলিভিশনে সংবাদ শিরোনামে চলে আসে বাংলাদেশ। প্রতিবেশী, সহকর্মী বন্ধুবান্ধব সবাই খবরটি পড়েছেন বা দেখেছেন, তার পরও এমন করে জিজ্ঞাসা করে ঘটনা জানতে চান যেন আমারই কোনো স্বজন মারা গেছেন। রক্তের সম্পর্কের না হোক যাঁরা মারা গেছেন তাঁরা তো স্বজনই, আমাদের আত্মার আত্মীয়। গত কয়েক মাসের নানা ঘটনা আর এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে বা খুঁজতে গিয়ে আমার মতো লাখ লাখ প্রবাসী ক্ষুব্ধ বা ক্লান্ত হয়েছেন। স্বদেশের এসব ঘটনায় মনটা খুব ছোট হয়ে গেছে, তার পরও আপন স্বদেশ, দেশমাতৃকা—সে তো মায়ের মতোই, তাকে কি ভুলে থাকা যায়?
সবশেষে ভালো খবরটি হলো, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর মান ও শ্রমিকদের অধিকার ও মানবেতর অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে বহু দিন থেকেই ইউরোপের নানা দেশে ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইন বা এই জাতীয় সংগঠনগুলো ইউরোপীয় ক্রেতা কোম্পানিগুলোর ওপর শ্রম অধিকার লঙ্ঘন করে বাংলাদেশ থেকে সস্তায় তৈরি পোশাক আনার বিরোধিতা করে এই আধুনিক দাসপ্রথার বিরুদ্ধে চাপ দিচ্ছিল। সাভারের সাম্প্রতিক ট্র্যাজেডি আর তাদের আন্দোলনের ফলে এরই মধ্যে ২৩ মে জেনেভায় আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সদর দপ্তরে ইউরোপের ৩১টি নামী পোশাক কোম্পানি বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোর মান ও শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করবে বলে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।
সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.