বিজয়ের মাস -বিশ্বসভায় বাংলাদেশের প্রথম স্বীকৃতি by সিমিন হোসেন রিমি

১৯৭০-এর নির্বাচনে গাইবান্ধার একটি আসন থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন ওয়ালিউর রহমান রেজা। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই এর নানামুখী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি।
অক্টোবর মাসে তিনি ৬ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টার্সে আসেন। সেখানে তাঁর দায়িত্ব ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজখবর রাখা। তাঁদের আনুষঙ্গিক প্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যবস্থা করা ও ওষুধপত্র দেওয়া।
এরই মধ্যে একদিন তিনি জানতে পারলেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এই এলাকায় আসছেন। যেদিন তাঁরা এলেন, সেদিন ওয়ালিউর রহমান তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামার একটি বই পড়ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ বইটি দেখে জানতে চাইলেন কী বই। ওয়ালিউর রহমান বললেন, ‘দালাই লামার বইটা কিনেছি। কারণ, শিখতে হবে বিদেশের মাটিতে কীভাবে থাকতে হয়। দালাই লামা তো এ দেশেই আছেন। উনি যেভাবে আছেন, সে পদ্ধতিটা এই বই পড়ে শিখব। কারণ, আমরাও তো এই দেশে থাকব!’ এ কথা শুনে তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, ‘১৫ ডিসেম্বর আমরা ঢাকার মাটিতে জনসভা করব। আমাদের যুদ্ধের প্রথম অধ্যায় শেষ হয়েছে। আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে এসে গেছি। আমরা ১৫ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে মিটিং করব।’
২. যুদ্ধদিনের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে সুবিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করে চলেছেন তিনি অতি নিপুণভাবে। তাঁর দৃষ্টি প্রসারিত যুদ্ধের রণকৌশলে, মুক্তিযোদ্ধার মাঝে, শরণার্থী শিবিরে, বাংলাদেশের ভেতরের মানুষে, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। তাঁর দৃষ্টি প্রতি মুহূর্তের বিশ্ব কূটনৈতিক তত্পরতার ফলাফল থেকে উদ্ভূত নিত্যনতুন পরিস্থিতির বোঝাপড়ায়। এবং এ সবকিছুর ভেতর দিয়েই একমাত্র লক্ষ্য—যুদ্ধে জয়লাভ করা।
২৩ নভেম্বর, ১৯৭১ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দেশবাসীর উদ্দেশে তাঁর ‘জয় আমাদের কবজায়’ শিরোনামের বেতার ভাষণে বলছেন, ‘মুক্তিবাহিনী এখন যেকোনো সময়ে যেকোনো জায়গায় শত্রুকে আঘাত করতে পারে; এমনকি শত্রুর নিরাপদ অবস্থানের কেন্দ্রে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে তাকে বিমূঢ় করে দিতে পারে। জলে-স্থলে চমকপ্রদ অগ্রগতি ঘটেছে মুক্তিবাহিনীর।...একদিকে রণক্ষেত্রে শত্রুর বিপর্যয় ঘটেছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ইসলামাবাদের দুষ্কৃতিকারীরা আজ দিশেহারা ও কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।...এখন তারা চায় ভারতের সাথে যুদ্ধ বাধিয়ে একটা আন্তর্জাতিক সংকট সৃষ্টি করতে। তারা আশা করে যে, এমন একটি যুদ্ধ হলে বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের থেকে পৃথিবীর দৃষ্টি অন্যদিকে নিবদ্ধ হবে, মুক্তিবাহিনীর হাতে তাদের পরাজয়ের গ্লানি গোপন করা যাবে এবং এমন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হবে, যাতে তাদের পৃষ্ঠপোষকেরা হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পাবে। কিন্তু আমি প্রত্যয়ের সঙ্গে বলছি যে, এর একটি উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হবে না। বরঞ্চ এতে তাদের ভ্রান্তি, অপরাধ ও আত্মঘাতের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে, শত্রু এবং পরিণামে তাদের আত্মবিনাশ সুনিশ্চিত হবে।’
এই একই ভাষণের শেষ অংশে প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ‘স্বাধীনতার ধারণা অশেষ অর্থবহ। স্বাধীনতার তাত্পর্য নির্ভর করে যুদ্ধাবস্থায় এর জন্য আমরা কী মূল্য দেই এবং শান্তির সময়ে এর কী ব্যবহার করি, তার উপরে। শত্রু সংহারের প্রতিজ্ঞা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে শহীদের রক্তের উপযুক্ত সমাজ গঠনের প্রতিজ্ঞাও আমাদেরকে নতুন করে নিতে হবে।’
৩. প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ধীমান নেতৃত্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অবিস্মরণীয় সাফল্যমণ্ডিত ভূমিকা, অসীম সাহসী মুক্তিবাহিনীর হাতে পাকিস্তানি সেনাদের লজ্জাজনক পিছু হটা, পাকিস্তানি সামরিক শাসক গোষ্ঠীকে আরও বেশি দিশেহারা এবং ক্ষিপ্ত করে তোলে। সর্বোপরি ২৫ মার্চ রাত থেকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর পাকিস্তানি সামরিক শক্তির চাপিয়ে দেওয়া একতরফা হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা জনগণের ন্যায়সংগত সংগ্রামের প্রতি ভারতের আন্তরিকতাপূর্ণ সর্বোচ্চ সমর্থনদানের ফলে পাকিস্তান তার শেষ মরণ কামড় দেওয়ার চেষ্টা করে ভারতকে আক্রমণ করে। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান অতর্কিতে ভারতের পশ্চিমে সীমান্তে আক্রমণ শুরু করে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই উপমহাদেশকে কেন্দ্র করে শুরু হয় নানামুখী কূটনৈতিক তত্পরতা। এমন এক উত্তেজনাকর অবস্থায় ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ ভারত সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর স্বীকৃতিপত্রে লেখেন:
Dear Prime Minister,
My colleagues in the Government of India and I were deeply touched by the message which His Excellency the Acting President Syed Nazrul Islam and you sent to me on December 4. On its receipt, Government of India once again considered your request to accord recognition to the people’s republic of Bangladesh which you lead with such dedication. I am glad to inform you that in the light of the circumstances which prevail at present, government of India have decided to grant the recognition. This morning I made a statement on the subject in our Parliament......
ডিসেম্বরের ৮ তারিখ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে তাঁর ‘সোনার বাংলাকে গড়তে হবে’ শীর্ষক বেতার ভাষণে বলেন, “ভারতের জনসাধারণ অনেক আগেই আমাদেরকে স্বীকৃতি দিয়েছেন তাঁদের অন্তরে। এখন তাঁদের সরকার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি জানিয়েছেন।...স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হিসেবে আমাদের কূটনৈতিক স্বীকৃতি লাভ আজ সম্ভব হলো অগণিত শহীদের রক্তের বিনিময়ে, মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসিক তত্পরতা, অপূর্ব আত্মত্যাগ ও দুর্ভেদ্য ঐক্যের ফলে।...স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদেরকে জগত্সভায় সর্বপ্রথম স্বাগত জানিয়েছে ভারত। এক কোটি ছিন্নমূল বাঙালির পরিচর্যার ক্লেশ স্বীকার এবং বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য যুদ্ধের আপদ বহন আর মানবতা ও স্বাধীনতার আদর্শের প্রতি যে সুগভীর নিষ্ঠার পরিচয় ভারত দিয়েছে, তা বর্তমানকালে এক আশ্চর্য ঘটনারূপে বিবেচিত হবে। ভারতের এই দৃঢ়তাপূর্ণ সিদ্ধান্তে আমরা আনন্দিত।...ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি হবে পরস্পরের জন্য মৈত্রী ও শ্রদ্ধাবোধ। ভারতের পর ভুটান স্বীকৃতি দিয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে। এর জন্য আমরা ভুটানের রাজা ও জনসাধারণের নিকট কৃতজ্ঞ।...বাংলাদেশের স্বপ্ন যখন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাস্তবে রূপায়িত হলো, তখন সেই স্বপ্নের দ্রষ্টা, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শত্রুর কারাগারে বন্দী হয়ে আছেন। দেশবাসীর নিকটে অথবা দূরে যেখানেই থাকুন না কেন, বঙ্গবন্ধু সর্বদাই জাগরূক রয়েছেন তাদের অন্তরে। যে চেতনা আমাদের অতীতকে রূপায়িত করেছে, তিনি সেই চেতনার প্রতীক। যে রূপকাহিনী ভবিষ্যতে আমাদের জাতিকে জোগাবে ভাব ও চিন্তা, তিনি সেই কাহিনীর অংশ। তবু এই মুহূর্তে তাঁর অনুপস্থিতিতে আমরা সকলেই বেদনার্ত।
...যুদ্ধ জয়ের সঙ্গে সঙ্গে শান্তিকেও জয় করে আনতে হবে। নিষ্ঠুর যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষের উপরে ‘সোনার বাংলার’ সৌধ নির্মাণ করতে হবে। পুনর্গঠন ও উন্নয়নের এই আনন্দদায়ক ও মহান কাজে অংশ নিতে হবে বাংলাদেশের প্রতিটি সন্তানকেই।”
৪. ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের ফলে মুক্তিযুদ্ধে নতুন মাত্রা সংযুক্ত হয়। মুক্তিবাহিনী মাত্র কয়েক মাসে গেরিলা কায়দায় আক্রমণ করে যেভাবে পাকিস্তান বাহিনীকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল, এবার মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে চূড়ান্ত লড়াইয়ে যোগ দেয় ভারতীয় মিত্র বাহিনী। ১৩ দিনের টান টান উত্তেজনা ও যুদ্ধের ফলে পাকিস্তান বাহিনী পরাজয় মেনে নিয়ে আত্মসমর্পণ করে। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় সূচিত হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়ায়।
এই প্রসঙ্গে পরবর্তী সময়ে তাজউদ্দীন আহমদ যা বলেন, তা রাষ্ট্রনায়কোচিত দূরদর্শী উচ্চারণ হিসেবে একাত্তরেই ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছিল। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে কারো ঘাঁটি হবে না। এমনকি যুদ্ধের দিনে সবচেয়ে বিপর্যয়ের সময়ে ভারতীয় বাহিনীকে বলেছি, শ্রীমতী গান্ধীকে বলেছি, বন্ধু রাষ্ট্র হিসাবে তুমি আমাদের দেশে যাবে। বন্ধু তখনই হবে, যখন তুমি আমাদের স্বীকৃতি দেবে। তার আগে সার্বভৌমত্বের বন্ধুত্ব হয় না। ৬ ডিসেম্বর স্বীকৃতি দিয়ে ভারতীয় বাহিনী আমাদের সাথে এসেছিল। কোন গোপন চুক্তি ভারতের সাথে হয় নাই। একটাই চুক্তি হয়েছে, সেই চুক্তি প্রকাশ্য এবং কিছুটা লিখিত, কিছুটা অলিখিত। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং আমি যুক্তভাবে সই করেছিলাম। সেখানে লেখা ছিল, আমাদের স্বীকৃতি দিয়ে সহায়ক বাহিনী হিসাবে তোমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। এবং যেদিন আমরা মনে করবো আমাদের দেশে আর তোমাদের থাকার দরকার নেই, সেই দিন তোমরা চলে যাবে। সেই চুক্তি অনুসারে যেদিন বঙ্গবন্ধু শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে বললেন, ৩০ মার্চের মধ্যে তোমাদের বাহিনী উঠিয়ে নিয়ে যাবে, তখনই মিসেস গান্ধী ১৯৭২-এর ১৫ মার্চের মধ্যে সহায়ক বাহিনী উঠিয়ে নিয়ে গেলেন।’ (এই অংশবিশেষ ১৯৭৪ সালের ২০ জানুয়ারি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ থেকে নেওয়া।)
বিশ্ব রাজনীতির দিকে দৃষ্টি ফেরালে আমরা সুদূর-নিকট সব অতীতেই দেখতে পাব, কখনো শান্তি রক্ষার নামে, কখনো রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষায় সহযোগিতার নামে, কিংবা আগ্রাসন রুখতে অথবা বিধ্বংসী অস্ত্র খোঁজার নামে কীভাবে দেশে দেশে অন্য দেশের ঘাঁটি হয়ে যায়। অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যায় মূল রাষ্ট্রেরই। সে অর্থে ১৯৭১ সালে বিদেশের মাটিতে বসে, এক কোটি শরণার্থীর ভার বইছে যে দেশ এবং সে দেশের সব সহযোগিতা নেওয়ার পরও একমাত্র নেতৃত্বের দৃঢ়তা, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা এবং প্রবল আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন দেশপ্রেমের ফলেই সম্ভব হয়েছিল পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল একটি সম্মানজনক সমঝোতা চুক্তি সম্পন্ন করা, যা আজও অনন্য এক উদাহরণ।
৫. মুক্তিযুদ্ধের প্রতিদিনের ঘটনা সৃষ্টি করেছে এক একটি নতুন ইতিহাসের। অমূল্য রতনখচিত সেই ইতিহাসের পথ ধরে খুঁজে বের করতে হবে ১৯৭১-কে। এ দায়িত্ব সবার।
সিমিন হোসেন রিমি: সমাজকর্মী।
simrim_71@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.