প্রভাবশালী বলে তাঁদের শাস্তি হবে না -নগরদর্পণ: চট্টগ্রাম by বিশ্বজিত্ চৌধুরী

সীতাকুণ্ড থেকে আমার ঘনিষ্ঠ এক ভদ্রলোক ফোন করে বলেছিলেন, ‘আপনাকে একটা তথ্য দিই। আজ সন্ধ্যার পর সীতাকুণ্ড উপকূলের হাজারখানেক গাছ কাটা হবে। খবর পেলেও পুলিশ ওই সময় যাবে না, তারা যাবে গাছ কাটা শেষ হওয়ার পর। বন বিভাগও ব্যাপারটা জানে। বন কর্মকর্তারা কেউ অসহায়, কেউ ম্যানেজড; বনপ্রহরী বা বন বিটের দু-একজনকে পরিকল্পনামাফিক পিছমোড়া বেঁধে রাখার মতো নাটক হতে পারে, নাও হতে পারে। তবে আজ রাতের মধ্যেই গাছ কাটার কাজ যে শেষ হচ্ছে, তা নিশ্চিত।’
‘আপনি কী করে জানলেন?’
‘আমি কেন, এলাকার লোকজন প্রায় সবাই জানেন।’
কোরবানির ঈদ করার জন্য বাড়িতে এসেছিলেন ভদ্রলোক। ছুটি শেষে ঢাকায় কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার পথে গাড়িতে বসে গত ২৯ নভেম্বর রোববার সকালে ফোন করে এসব কথা জানিয়েছিলেন আমাকে। আমি তখন পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারিনি। কারণ, বিস্তারিত পরিকল্পনা যদি সবাই আগেভাগে জেনে যায়, তাহলে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন কি সম্ভব?
পরদিন সকালে সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলগুলোতে দেখলাম, সীতাকুণ্ড উপজেলার পাক্কা মসজিদ ও জোড় আমতলীর মধ্যবর্তী প্রায় এক কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকার দুই হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। বোঝা গেল, যা কিছু রটে, তার সবটাই নির্বিবাদে ঘটে।
এর সঙ্গে যে প্রভাবশালী লোকজন জড়িত ছিলেন, বলাই বাহুল্য। কিন্তু তাঁদের টিকিটি স্পর্শ করার সাধ্য কারও নেই। বরং পুলিশ যথারীতি নির্দিষ্ট সময়ের পর উপস্থিত হয়েছে ঘটনাস্থলে। সোনা মিয়া, হারেছ মিয়া নামের কয়েকজন নিরীহ লোককে (কাঠের টুকরা কুড়িয়ে নেওয়া বা কামলা খাটার জন্য উপস্থিত ছিল ঘটনাস্থলে) গ্রেপ্তার করে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছে। এসব ক্ষেত্রে মামলাও হয় খুব হাস্যকর। অজ্ঞাত কয়েকজন লোককে বাদী করে মামলা হয়, তাতে নিরীহ লোকজনকে হয়রানি করার একটা লাইসেন্স পেয়ে যায় পুলিশ। হয়রানির হাত থেকে বাঁচার জন্য এসব লোক ছুটে যান স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছে। প্রভাবশালীরা তখন ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। থানা-পুলিশ, দেনদরবার করে তাঁদের ছাড়িয়ে আনার মহত্ত্ব দেখান। অথচ কে না জানে, এসব মহান ত্রাতাই মূল অপরাধের হোতা!
এবার গাছ কাটার জন্য স্থানীয় সাংসদ আবুল কাশেম মাস্টারের ছেলে এস এম আল মামুন, নগর আওয়ামী লীগের নেতা আ জ ম নাছির উদ্দিন, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা আ ম ম দিলশাদ এবং বিএনপির নেতা আসলাম চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজনের নাম এসেছে। আওয়ামী-বিএনপি নেতাদের এই যৌথ অভিযানের ফলে প্রমাণিত হলো, ব্যক্তিগত স্বার্থের ক্ষেত্রে কোনো বিরোধ নেই—ভাগাভাগি করে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুটে নিতে মতৈক্য প্রতিষ্ঠা অনেক সহজ।
জাহাজভাঙা শিল্পের জন্য শিপইয়ার্ড তৈরির নামে উপকূলে গাছ কাটার উত্সব চলছে অনেক দিন ধরে। গত এক বছরে সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি এলাকায় ১২৫ একর সবুজ বেষ্টনী উজাড় করা হয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে পত্রপত্রিকায়। প্রতিবারই একই নাটক অভিনীত হয়েছে। পুলিশ এসেছে ধ্বংসযজ্ঞের পর, লোক দেখানো কিছু গ্রেপ্তার হয়েছে। বন কর্মকর্তা, পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসন বিভিন্ন জনকে দায়ী করে বক্তব্য দিয়েছে। ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে বক্তব্যও এসেছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। মামলা হয়েছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। সচেতন নাগরিকেরা এসব অপতত্পরতার বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশ করেছেন, মানববন্ধন হয়েছে। কিন্তু যাঁরা দায়ী, তাঁরা আড়ালে মুখ টিপে হেসেছেন—শিপইয়ার্ড তৈরির কাজ একধাপ এগিয়েছে বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন।
প্রসঙ্গক্রমে বলি, সীতাকুণ্ডের জাহাজভাঙা শিল্পের ভয়াবহ পরিবেশদূষণ নিয়ে বাদ-প্রতিবাদ চলছে দীর্ঘদিন ধরে। পরিবেশবাদীরা এই শিল্পের কারণে সমুদ্রদূষণ, এলাকাবাসীর স্বাস্থ্য সমস্যা, শ্রমিকদের মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে আন্দোলন করে আসছেন। প্রথম আলোসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গোলটেবিল বৈঠক করে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য প্রকাশ করে জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের কাছে বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। ‘বেলা’, ‘ইপ্সা’সহ কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নানা তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে শিল্পোদ্যোক্তা ও সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলের সঙ্গে দেনদরবার করছে দীর্ঘকাল ধরে। কিন্তু কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙেনি। নতুন নতুন শিপইয়ার্ড তৈরি হয়েছে। গাছ কাটাসহ পরিবেশদূষণের সব আলামত রয়েছে অব্যাহত।
জাহাজভাঙা ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বারবার দাবি করে আসছেন, এই শিল্প আমাদের লৌহজাত কাঁচামালের প্রধান জোগানদাতা। এটি হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান করছে বলেও উল্লেখ করেছেন তাঁরা।
কিন্তু পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা যেসব তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেছেন, তাতে এসব দাবি ধোপে টেকে না।
যত দূর মনে পড়ে, ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একবার রড ও অন্যান্য কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে দেশে যখন অস্থিরতা সৃষ্টি হয় এবং নির্দিষ্ট একটি সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হয় এর জন্য, তখন জাহাজভাঙা শিল্পের উদ্যোক্তারা জানিয়েছিলেন, এই তত্পরতার সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নন তাঁরা। কেননা, দেশের লোহার চাহিদার মাত্র ২৫—৩০ শতাংশ পূরণ করে থাকে এই শিল্প।
বলা হয়, আড়াই লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয় এই শিল্পে। কিন্তু দেশে যদি ৭০টি (যদিও ৪০—৪৫টির বেশি শিপইয়ার্ডের অস্তিত্ব নেই) জাহাজভাঙা শিল্পও চালু থাকে, তাতে প্রতিটিতে শ্রমিক থাকার কথা গড়ে ২০০ জন। অর্থাত্ এই শিল্পে মোট শ্রমিকের সংখ্যা ১০—১৫ হাজারের বেশি হওয়ার কথা নয়। তার মানে, এই শিল্পের গুরুত্বের কথা যতটা প্রচার করা হয়, আদপে ঠিক ততটা গুরুত্ব তা বহন করে না।
এসব দিক তুলে ধরে পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতির কথা বিবেচনা করে জাহাজভাঙা শিল্প বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন।
আমরা এ মুহূর্তে এটিকে ঠিক পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলি না। বরং পরিবেশ রক্ষা করে, শ্রমিকদের জীবনের ঝুঁকি হ্রাস করে, আহত শ্রমিকদের চিকিত্সাসেবা নিশ্চিত করে এই শিল্প চালু রাখাই হবে যুক্তিসংগত।
দেখা যাচ্ছে, জাহাজভাঙা শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও মালিকেরা তা করেননি। ২০০৯ সালের মার্চে আদালত পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেওয়ার জন্য দুই সপ্তাহের সময় বেঁধে দিয়েছিলেন উদ্যোক্তাদের। অন্যথায় কাজ বন্ধ করতে হবে বলেও নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। পরে সময় বাড়ানোর জন্য শিল্পমালিকেরা আবেদন করলে তার সুরাহা এখনো হয়নি।
সারা বিশ্বে মাত্র গুটিকয়েক দেশে জাহাজভাঙা শিল্প চালু আছে। এর মধ্যে তুরস্ক ও চীনে পৃথক ডকইয়ার্ড করে জাহাজভাঙার কাজ করা হয়। ভারতের গুজরাটে জনবসতি থেকে অনেক দূরে এলাং গ্রামে এই শিল্পের কাজ চলে। এর পরও এসব দেশে পরিবেশবাদীরা সোচ্চার। অথচ আমাদের দেশে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে জনবহুল সীতাকুণ্ড উপজেলার উপকূলে জাহাজভাঙার কাজ চলছে। পৃথক ডকইয়ার্ড করে এই কাজটি করার দাবি জানিয়ে আসছেন পরিবেশবাদীরা দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু ব্যয়বহুল বলে তাঁদের এই দাবিও উপেক্ষিত হয়েছে।
এই যখন অবস্থা, তখন কী বিবেচনায় উপজেলা প্রশাসন নতুন করে শিপইয়ার্ড স্থাপনের অনুমতি দিচ্ছে, তা আমাদের বোধগম্য নয়। উপজেলা প্রশাসন বলছে, যেখানে সবুজ বেষ্টনী নেই, কেবল সেখানেই শিপইয়ার্ড তৈরির অনুমতি দিয়েছে তারা। কিন্তু এই নিয়ম যে কতটা বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরোর মতো, তা প্রমাণ করেছেন নতুন উদ্যোক্তারা। তাঁরা আগে সবুজ বেষ্টনী লোপাট করে দিয়ে তারপর যাচ্ছেন শিপইয়ার্ডের অনুমতির জন্য।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সিডর, নার্গিস, আইলার মতো ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ছোবল যখন উপকূলীয় মানুষের নিয়তি হয়ে উঠেছে, তখন হাজার হাজার গাছ কেটে মানুষের জীবন বিপন্ন করে তুলছে কিছু অর্থলোভী মানুষ।
একজন মানুষকে কেউ খুন করলে তার ফাঁসি হয়, হাজার হাজার গাছ খুন করে লাখো মানুষের জীবন বিপন্ন করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কোনো শাস্তি হবে না? শুধু তাঁরা ক্ষমতাবলয়ের কাছাকাছি থাকেন বলে? প্রভাবশালী বলে?
বিশ্বজিত্ চৌধুরী: লেখক, সাংবাদিক।
Email : bishwa_chy@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.