আমিনুলের ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন মিইয়ে গেল বুলেটে by শুভ্র দেব
বাবা-মা দু’জনের স্বপ্ন ছিল ছেলেকে বিদেশে পাঠাবেন। কিছুদিন বিদেশে থেকে টাকা ইনকাম করার পরে দেশে ফিরিয়ে আনবেন। তারপর বিয়ে দেবেন। আর ছেলে আমিনুলের স্বপ্ন ছিল ভালো ফুটবল খেলোয়াড় হবে। তার সমস্ত চিন্তা-চেতনা ফুটবল খেলা ঘিরেই ছিল। খেলাধুলা করে বেশকিছু পুরস্কারও অর্জন করেছে। কিন্তু আন্দোলন চলাকালীন ২১শে জুলাই গুলিবিদ্ধ হন আমিনুল। বুকের এপাশে গুলি লেগে ওপাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। বুলেটের আঘাতে আমিনুলের ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন মিইয়ে গেছে। বাবা-মায়ের বুক খালি করে তিনি এখন পরপারে। স্মৃতি বুকে আঁকড়ে স্তব্ধ হয়ে আছেন তারা।
আমিনুলের বাবা মো. ওবায়দুল মিয়া গত রোববার মানবজমিনকে বলেন, আমার ছেলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। অভাবের সংসারে আমাকে সহযোগিতা করার জন্য বিভিন্ন কাজকর্মে লেগে যায়। সর্বশেষ বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম তৈরির একটি কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। মাসে ৯ হাজার টাকা বেতন পেতেন। তবে কাজকর্ম করলেও তার ফুটবল খেলার প্রতি খুব মনোযোগ ছিল। দিনরাত শুধু ফুটবল নিয়ে ভাবতেন। বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে ফুটবল খেলে পুরস্কারও পেয়েছেন। প্রায়ই আমাদের বলতো সে বড় ফুটবলার হতে চায়। কিন্তু এই আন্দোলন সবকিছু শেষ করে দিলো। আমাদের বুকটা একেবারেই খালি হয়ে গেল। আমার একটা মাত্র সন্তান। আমরা কোনো দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নই। আমার ছেলে শিক্ষার্থীও নয়। অথচ বাসার পাশে ঝালমুড়ি খেতে গিয়ে ছেলেটা মারা গেল। এই শোক সইবার ক্ষমতা আমাদের নাই। সেদিনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ওইদিন আমার ছেলে বাসায় ঘুমাচ্ছিল। ঘরে চাল নাই। তার মা তাকে ডাক দিয়ে দোকান থেকে চাল এনে দেয়ার জন্য বলেন। সে দোকান থেকে চাল এনে দেয়। চাল দিয়ে মায়ের কাছে ঝালমুড়ি খাওয়ার জন্য কিছু টাকা চায়। তার মা ২০ টাকা দিলে সেটি নিয়ে বাইরে চলে যায়। তখন মাগরিবের সময়। শনির আখড়া গোয়ালবাড়ী মোড়ে হঠাৎ করেই গুলিবিদ্ধ হয়। তার বুকে গুলি লাগার পর কিছুদূর হেঁটে যায়। তারপর আর পারছিল না। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তখন তার পরিচিত দু’জনকে দূর থেকে ডাকে। তারাই তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে স্থানীয় অনাবিল হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমি রিকশা চালাই। কত জায়গায় আমাকে যেতে হয়। ভাগ্যক্রমে সেদিন ওই হাসপাতালের সামনে আমি ছিলাম। আমার চোখের সামনে দিয়েই দুই যুবক একজন গুলিবিদ্ধকে নিয়ে ওই হাসপাতালে আসে। আমিতো চিনতে পারিনি। কারণ কত মানুষই গুলিবিদ্ধ হচ্ছে। তাদেরকে আশপাশের হাসপাতালগুলোতেই প্রথমে আনা হয়। কিন্তু গুলিবিদ্ধ ওই কিশোরকে হাসপাতালের ডাক্তাররা পরীক্ষা- নিরীক্ষা করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। তখন তাকে নিয়ে আসা ওই দুই যুবক আমাকে বলে, মামা ঢাকা মেডিকেলে যাবেন। তখন আমি রাজি হয়ে যাই। তারা গুলিবিদ্ধ কিশোরকে যখন রিকশায় তুলে তখন আমি দেখি সে আমার ছেলে আমিনুল। তাকে দেখেই আমি চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যাই। পরে আমার মাথায় ও মুখে পানি দেয় তারা। আমার জ্ঞান ফিরে আসে। তখন একটি সিএনজি করে আমি তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানকার চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে বলেন- আমার ছেলে আর বেঁচে নাই। কান্নাজড়িত কণ্ঠে আমিনুলের বাবা বলেন, আমার ছেলে তো আরও অনেক আগেই মারা গেছে। স্থানীয় হাসপাতালেই আমি সেটি টের পেয়েছি। চিকিৎসকরা আমাকে জিজ্ঞেস করেন ছেলের মরদেহের ময়নাতদন্ত করবো কি না। পরে আমি ময়নাতদন্ত না করেই পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার ঘড়িপাশার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাই। সেখানেই তার মরদেহ দাফন করা হয়।
ওবায়দুল মিয়া বলেন, ছেলেকে হারিয়ে আমরা শোকে কাতর হয়ে আছি। বিশেষ করে তার মা’কে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না। দিন রাত শুধু কান্নাকাটি করে। খেতে গেলেও কান্না, ঘুমাতে গেলেও কান্না। পাড়া-প্রতিবেশী কেউ খোঁজ খবর নিতে এলেও কান্না করেন। আমাদের খুব আদরের সন্তান ছিল। আমরা কখনো তাকে কষ্ট দেইনি। সবসময়ই চোখে চোখে রাখতাম। কিন্তু কীভাবে কী হয়ে গেল। নিজ চোখে দেখিনি কার গুলিতে সে মারা গেছে। এখন আমি কাকে দোষ দেবো। অভাবের সংসার। শুনেছি আন্দোলনে যারা মারা গেছেন তাদেরকে অনুদান দেয়া হবে। সেজন্য নাকি একটি মামলা করতে হবে। তাই এলাকার এক বিএনপি নেতাকে মামলার জন্য বলেছিলাম। পরে তিনি ওনার মতো মামলা করেছেন। আমি লেখাপড়া জানি না। শুধু স্বাক্ষর করেছি। পরে শুনেছি অনেক মানুষকে আসামি করা হয়েছে।
No comments