আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন লুটপাটের রাজা-মহারাজা by জাবেদ রহিম বিজন

আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে ক্ষিতীশ চন্দ্র বিশ্বাসের দুর্নীতি-লুটপাট ছিল ওপেন সিক্রেট। চাকরি থেকে অবসরে গেলেও মুখে মুখে রয়ে গেছে তার অপকর্মের কথা। ঢাকায় ফ্ল্যাট-এপার্টমেন্ট তো আছেই, কলকাতাতেও নাকি বাড়ি রয়েছে তার। তার পথ ধরে লুটপাটে আলোচিত হয়ে ওঠেন স্টেশনের আরও কয়েক কর্মকর্তা। বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের নেতা হয়ে স্টেশনকে অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেন এই কর্মকর্তারা। নিজেদের পদোন্নতি, হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের পিডি (প্রকল্প পরিচালক) হয়ে লুটপাটে মত্ত হন।

১৯৮৮ সালে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি জীবন শুরু হয় ক্ষিতীশ চন্দ্র বিশ্বাসের।  ২০১২ সালে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনের হর্তাকর্তা বনে যান এই কর্মকর্তা। ২০১৫ সালে বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদ গঠন করে নিজে সভাপতি হন। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিপরীতে নিজেকে কোম্পানির আরেক শাসকে পরিণত করেন সভাপতি পদের বলে। তখন থেকে নিজের আখের গোছানো হয়ে ওঠে তার কাজ।

নির্বাহী প্রকৌশলী পদোন্নতিতে কোম্পানির ব্যবস্থাপক হন। এরপর ২০১৬ সালে ৫ হাজার ৬শ’ কোটি টাকার ৪০০ মেগাওয়াট ও সিসিপিপি (নর্থ) প্রকল্পের পরিচালক হন। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদমর্যাদার কর্মকর্তার বদলে নির্বাহী প্রকৌশলী হয়েও প্রকল্প পরিচালক হন। প্রকল্পের মেয়াদকাল দেখিয়ে ২ বছরের জন্যে নিজের চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে নেন। প্রকল্পে নিম্ন্নমানের মালামাল ব্যবহারেও রেকর্ড করেন ক্ষিতীশ। এছাড়াও দরপত্রের মূল প্রাক্কলন বিক্রি, পদোন্নতি বাণিজ্য, প্রকল্পের কোটি কোটি টাকার স্ক্র্যাব-ক্যাবল বিক্রি করে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বিদ্যুৎ স্টেশনের একজন ঠিকাদার জানান, তিনি যে প্রকল্পের পিডি ছিলেন সেগুলোতে কান্ট্রি অফ অরিজিন  মেইনটেন করা হয়নি। নর্থ ও সাউথ প্রকল্পের কাজের পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। নর্থ পাওয়ার প্লান্ট চালুর শুরুতেই টারবাইনের সমস্যা দেখা দেয়। ৪০০ মেগাওয়াট প্রকল্পে স্টিল স্ট্রাকচারে পুরাতন মালামাল রঙ করে লাগানো হয়। ২৭০০ এবং ২৯০০ কোটি টাকার এই দুই প্রকল্পের পিডি হিসেবে কয়েকশ’ কোটি টাকা লুটে নেন ক্ষিতীশ চন্দ্র বিশ্বাস। ঢাকার শ্যামলী ও বসুন্ধরায় তার ফ্ল্যাট রয়েছে। কলকাতাতেও বাড়ি করেছেন বলে আলোচনা আছে। অপ্রয়োজনে কোম্পানির রেস্ট হাউসের পাশের একটি খাল ভরাট করে সোহাগপুর গ্রামের মানুষকে দুর্ভোগে ফেলেন। ভরাট করেন নদী। মদ ও নারীপ্রীতির জন্যেও আলোচিত এই কর্মকর্তা। তার এই কাজের সঙ্গী ছিলেন ঠিকাদার বাবুল আহমেদ। সে কারণে বাবুলকে নর্থ পাওয়ার প্লান্টে ৭০ কোটি টাকার কাজ দেন ক্ষিতীশ। যাতে ২০ কোটি টাকা লাভ হয় বাবুলের। বেপরোয়া এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ১২ই জানুয়ারি একটি অভিযোগ দেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছফিউল্লাহ মিয়া। সোহাগপুর গ্রামের জুয়েল সিকদার বলেন, ক্ষিতীশ অনেক ক্ষমতাশালী ছিলেন। চায়না প্রজেক্টে অনেক দুর্নীতি হয়েছে তার সময়। একই গ্রামের অহিদ মিয়া বলেন-রাতের আঁধারে প্রকল্পের ওয়্যার হাউজ থেকে ক্যাবলসহ অন্য মালামাল বের করে বিক্রি করে দিতেন। প্রায়শই এমন ঘটনা ঘটেছে। এ কাজেও তার সহযোগী ছিলেন বাবুল। রাতের কারবারি ছিলেন ক্ষিতীশ। ক্ষিতীশের পর এই স্টেশনের ক্ষমতাধর কর্মকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন তত্ত্ব্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান ভূঁইয়া। বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের সাধারণ সম্পাদকও তিনি। ৫ই আগস্টের পর স্বপরিবারে কর্মস্থল থেকে পালিয়ে যান। ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে সহকারী প্রকৌশলী (তড়িৎ) হিসেবে বিদ্যুতে তার চাকরি শুরু হয়। অনেক সিনিয়র কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলীর পদ দখল করেন। এতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা একজন পরিচালকের সমপরিমাণ সুযোগ সুবিধা ভোগের সুযোগ হয়। কামরুজ্জামান পটুয়াখালীতে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন প্রকল্পের পরিচালক হয়ে ৮শ’ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করেন সেখানে। যাতে দুর্নীতি সীমা ছাড়িয়েছে  বলেই অভিযোগ। ৪৫০ কোটি টাকায় মাটি ভরাট, এমব্যাঙ্কমেন্ট,  স্ল্লোপ প্রোটেকশন এবং ৩৫০ কোটি টাকায় ১৩ কিলোমিটার সীমানা প্রাচীর, অফিস ও আনসার ক্যাম্প তৈরি, বাড়িঘর ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের ১ হাজার বর্গফুটের ১ হাজার এবং ১১শ’ বর্গফুটের ১০০টি বাড়ি নির্মাণ করা হয়। কিন্তু এই কাজ খুউব নিম্নমানের হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। এরপর এই প্রকল্পের কাজের আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। পটুয়াখালীর প্রকল্প পরিচালক হলেও গত ৬ বছর ধরে তিনি আশুগঞ্জে পাওয়ার স্টেশনেই অফিস করেন। পাওয়ার প্লান্ট ভাতা, টিএ-ডিএ নিচ্ছেন। কোম্পানির ২২৫ মেগাওয়াট ও সিসিপিপি প্রকল্পের ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রকিউরমেন্ট ও কনস্ট্রাকশন কন্ট্রাকটর হুন্দাই ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের সাইট অফিস করার জন্য পাওয়ার স্টেশন কোম্পানির টাকায় মেটাল বিম, ইন্ডাস্ট্রিয়াল টিন ও ইটের দেয়াল দিয়ে ঘর করা হয়। যাতে অনেক এসি সংযোজন করা হয়। পাওয়ার  স্টেশনের নিজস্ব এই সম্পদ হুন্দাইয়ের মাধ্যমে বিক্রি করে লাভবান হন প্রকল্পের পরিচালক কামরুজ্জামান ভূঁইয়া ও তার আগের প্রকল্প পরিচালক অজিত কুমার সরকার। তারা এজন্যে ১৫ লাখ টাকা করে ৩০ লাখ টাকা ঘুষ নেন। কামরুজ্জামান কোম্পানির ২টি দামি মেটাল কন্টেইনারও হুন্দাইকে দিয়ে দেন। এগুলো নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ আটক করলে কামরুজ্জামান পুলিশের সঙ্গে কথা বলে ছাড়িয়ে নেন। তার ভুলের জন্যে ২০১৬ সালে ২২ মেগাওয়াট ও সিসিপিপি’র টারবাইনের ব্লেড ভেঙে যায়। কিন্তু এ ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। সরকারের প্রায় আড়াইশ’ কোটি টাকা খরচ করে তা মেরামত করা হয়। ৪৫০ মেগাওয়াটের (সাউথ ও নর্থ) প্লান্টের ১নং গেট ৪ বার ভেঙে করা হয়। এতে পকেট ভারী হয়েছে তার। এভাবে ৪৫০ মেগাওয়াট (নর্থ) এর নতুন প্রশাসনিক ভবন করার কয়েক মাসের মধ্যে  কোটি টাকা খরচ করে ছাদ মেরামত করা হয়। এই প্লান্টের স্টোরে ফায়ার ফাইটিং লাইনের কাজ না করে পরে তা করা হয়। নানাভাবে লুটপাট হয়ে ওঠে এই কর্মকর্তার প্রধান কাজ। তার দায়িত্বে অবহেলার কারণে সিনিয়র কেবল জয়েন্টার আবুল কালাম আজাদ মারা যান। আলোচনা রয়েছে এই কর্মকর্তা চিকিৎসার নামে থাইল্যান্ডে গিয়ে ঠিকাদারদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ করেন। ঢাকার পূর্বাচল ও ময়মনসিংহ শহরে নামে-বেনামে অনেক জায়গা সম্পদ করেছেন তিনি। ৫ই আগস্টের পর পালিয়ে গিয়ে ঢাকায়   কোম্পানির এমডি’র সঙ্গে বৈঠক করে প্রধান প্রকৌশলীর প্রাপ্ত সুবিধাদি প্রত্যাহার করে গোপনে পটুয়াখালী প্রকল্পে যোগ দেন। বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের বর্তমান সভাপতি কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক (পরিচালন ও সংরক্ষণ) মো. আবদুল মজিদও কম নন। অনিয়ম-দুর্নীতির ওস্তাদ। ভীষণ ক্ষমতাধর এই কর্মকর্তা নির্বাহী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) এবং ৪শ’ মেগাওয়াটের (ইস্ট) প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বেও রয়েছেন। আবদুল মজিদ ২০০৩ সালে সহকারী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) পদে যোগদান করেন। শতকোটি টাকার পুরাতন ১২৮ মেগাওয়াটের দু’টি ইউনিট নামমাত্র মূল্যে বিক্রির একজন কারিগর তিনি। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. কবির হোসেন। তাকে ক্ষিতীশের কার্বনকপি বলেই জানেন সবাই। ইতিপূর্বে ৪শ’ মেগাওয়াট ও ইস্ট প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ছিলেন বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদধারী এই কর্মকর্তা। ২০১৪ সালের নভেম্বরে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন কবির হোসেন। এছাড়াও কোম্পানির পূর্ববর্তী চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদও নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন। এই বিষয়ে খোঁজখবর জানতে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ সাঈদ একরাম উল্লাহর মোবাইলে একাধিকবার কল করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.