গুলশানে বাড়ি দখলের মামলা: সালাম মুর্শেদীকে আসামি করতে সায় দেয়নি দুদক by মারুফ কিবরিয়া
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালে উচ্চ আদালতের একাধিকবার নির্দেশের পর গুলশানের পরিত্যক্ত বাড়ি দখলের অভিযোগ নিয়ে অনুসন্ধানে নামে দুদক। অনুসন্ধান শেষে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয় সংস্থাটি। তবে ওই প্রতিবেদনে সালাম মুর্শেদী আসামি হওয়ার মতো সব ধরনের আলামত থাকলেও দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের বারণে তাকে বাদ দিয়েই মামলার সুপারিশ করা হয়। দুদকের এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, অনুসন্ধানে সালাম মুর্শেদীর অপরাধ প্রমাণ হয়।
কিন্তু প্রতিবেদনে তাকে আসামি করতে বারণ করেছিল কমিশন। এই কর্মকর্তা আরও জানান, সালাম মুর্শেদী এ বিষয়ে কোনো তদবিরও করেননি। কোনো দিন কমিশনে আসেননি। তারপরও তাকে ছাড় দিয়ে মামলা তৈরির প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। আর এই নির্দেশনা আসে দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর দপ্তর থেকে।
এক দুদক কর্মকর্তা বলেন, এই অনুসন্ধানটি আগেই শেষ হয়ে যেতো। কিন্তু সালাম মুর্শেদীকে বাদ দিয়ে কোন প্রক্রিয়ায় মামলা করা যায় তা নিয়ে গড়িমসি চলে। এমপিকে বাদ দিয়ে মামলা করার জন্য কমিশনেরই স্পষ্ট নির্দেশনা ছিল। চলতি বছরের ৬ই ফেব্রুয়ারি নথি জালিয়াতি করে সরকারি পরিত্যক্ত বাড়ি দখলের অভিযোগে রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যানসহ ১১ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এতে আসামি করা হয়- রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন খাদেম, প্রকৌশলী এম আজিজুল হক, সাবেক সহকারী সচিব আবদুস সোবাহান, রাজউকের সহকারী পরিচালক শাহ মো. সদরুল আলম, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক হাবিব উল্লাহ, সাবেক উপ-পরিচালক আজহারুল ইসলাম, সাবেক পরিচালক আবদুর রহমান ভূঁঞা, সদস্য লে. কর্নেল (অব.) এম নুরুল হক, গৃহায়ন অধিদপ্তরের ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক শাখা সহকারী মাহবুবুল হক, মীর মোহাম্মদ হাসান ও মীর মো. নুরুল আফছার।
সালাম মুর্শেদীর দখলে থাকা গুলশান-২ এর ১০৪ নম্বর সড়কের ২৯ নম্বর বাড়িটি পরিত্যক্ত সম্পত্তি বলে অভিযোগ করে তদন্তের নির্দেশনা চেয়ে রিট আবেদন করেছিলেন আইনজীবী ব্যারিস্টার সুমন। ২০২২ সালের ৩০শে অক্টোবর সেই আবেদনে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়। গত বছরের ৩০শে জানুয়ারি অভিযোগ অনুসন্ধানে কমিটি করে দুদক। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে অনুসন্ধান শেষ করে দুদক। মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিরা প্রতারণার মাধ্যমে নিজেরা লাভবান হওয়ার আশায় এবং অপরকে লাভবান করার অসৎ উদ্দেশ্যে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় প্রকাশিত গেজেটে ‘খ’ তালিকাভুক্ত গুলশান আবাসিক এলাকার সিইএন (ডি)-২৭ নং, হোল্ডিং নং-২৯, রোড নং-১০৪ প্লটটি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও অবমুক্তকরণ ছাড়াই জাল জালিয়াতির মাধ্যমে মিথ্যা রেকর্ডপত্র তৈরি করে হস্তান্তর অনুমতি ও নামজারি অনুমোদন করার মাধ্যমে সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ এবং আত্মসাতের সুযোগ দিয়েছেন।
যেভাবে অপরাধের দায় মুর্শেদীরও
দুদক অনুসন্ধান শুরুর পরপর জাতীয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিদপ্তরে একটি চিঠি পাঠানো হয়। সেই চিঠির আলোকে অধিদপ্তর একটি তদন্ত কমিটি গঠন ও তার প্রতিবেদন প্রস্তুত করে। যা দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরজমিন পরিদর্শন ও গুলশান আবাসিক এলাকার লে-আউট নকশা পর্যালোচনায় রোড নং-১০৪ ও রোড নং-১০৩ এর সংযোগ স্থলের কর্নার প্লট/বাড়ির অবস্থান বিবেচনায় ২৭ নং প্লটটি ১০৪ নং রাস্তায় অবস্থিত। যা ১৯৮৬ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত ৯৭৬৪(১) নং পৃষ্ঠার ৪৬ নং ক্রমিকে ‘খ’ তালিকাভুক্ত পরিত্যক্ত বাড়ি। অর্থাৎ ঢাকার গুলশান আবাসিক এলাকার গুলশান সিইএন(ডি) ব্লকের ১০৪ নং রোডের ২৯ নং হোল্ডিংস্থিত ২৭ নং বাড়ি। সর্বশেষ জরিপ/সিটি জরিপে সংশ্লিষ্ট এলাকার সিইএন(ডি) ব্লকের ২৭ নং প্লটের ৫২০৪ ও ৫২০৫ দাগসমূহ সিটি জরিপের ৯ নং খতিয়ানভুক্ত যা সরকারের পক্ষে গণপূর্ত নগর উন্নয়ন বিভাগ ঢাকা এর নামে রেকর্ডভুক্ত।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মালেকা রহমানের আবেদনের প্রেক্ষিতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের স্মারক নং-২৮ এর মূলে তার বরাবর প্রেরিত পত্রে জানানো হয় যে, সংশ্লিষ্ট এলাকার বাড়ি নং-সিইএন (ডি) ২৭, হোল্ডিং নং-২৯, রোড নং-১০৩, ঢাকার বাড়িটি পরিত্যক্ত সম্পত্তির ‘ক’ ও ‘খ’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি এবং অবমুক্তির কোনো অবকাশ নাই। এ প্রসঙ্গে তদন্ত কমিটি বলেছে, বাস্তবে ওই এলাকায় রাজউকের লে-আউট নকশায় কথিত বাড়ির অস্তিত্ব বিদ্যমান নাই। এক্ষেত্রে সুকৌশলে ওই এলাকার ১০৪ নং রোডে অবস্থিত উক্ত বাড়িটি ১০৩ নং রোড দেখিয়ে জাল-কাগজপত্র সৃজনপূর্বক হস্তান্তর-নামজারিসহ অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিইএন(ডি) ২৭ নম্বর প্লটের মূল নথি পাওয়া যায়নি। যেসব নথি রয়েছে তার সবই ফটোকপি। সেই কাগজপত্র পর্যালোচনা করে কমিটি দেখতে পায় যে উক্ত প্লটটি ১৯৬০ সালে পহেলা সেপ্টেম্বর ঢাকা রি-রোলিং মিলসকে বরাদ্দ দেয়া হয়। নথিতে থাকা কাগজে দেখা যায়, ১৯৬৯ সালের ২০শে অক্টোবর বিক্রয় চুক্তিনামা মোতাবেক প্লটটি মালেকা রহমানের সঙ্গে বিক্রয় চুক্তি সম্পাদিত হয়। পরবর্তীকালে ১৯৯৫ সালে মালেকা রহমানের আবেদনের প্রেক্ষিতে তার সন্তান মীর মোহাম্মদ হাসান ও মীর মোহাম্মদ নুরুল আফছার দানসূত্রে এই প্লটের যৌথ লিজ গ্রহীতা হিসেবে গণ্য করা হয়। পরে এদের আবেদনের কারণে ১৯৯৭ সালে ৩১শে মার্চ বিভাজিত প্লটের ২৭/বি সালাম মুর্শেদী বরাবর হস্তান্তরে অনুমোদন করা হয়। ওই বছরের ২৮শে ডিসেম্বর তার আবেদনের প্রেক্ষিতে উক্ত প্লটটি হাসান ও নুরুলের পরিবর্তে হস্তান্তরসূত্রে সালাম মুর্শেদীর নামে নামজারি ও হস্তান্তর গ্রহীতা হিসেবে গণ্য করা হয়। পরে তার আবেদনে ২০০৪ সালে রাজউক ইমারত নির্মাণের জন্য নকশা অনুমোদনের ছাড়পত্র দেয়া হয় মুর্শেদীকে।
এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি আরও বলেছে, ঢাকা রি- রোলিং মিলসের কাছ থেকে মালেকা বেগম/রহমান নামের ব্যক্তি বা উক্ত নামধারী ব্যক্তি হস্তান্তরসূত্রে/ক্রয়সূত্রে লিজ গ্রহীতা হিসেবে গণ্য করার স্বপক্ষে কোনো বৈধ কাগজপত্র পাওয়া যায়নি। পরবর্তীকালে দুই পুত্রকে দানপত্র ও দানপত্রে মালেকা রহমানের স্বাক্ষর সিআইডি কর্তৃক ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। একইসূত্রে সালাম মুর্শেদী ও ইফফাত আরা হকের অনুকূলে সংশ্লিষ্ট বিভাজিত প্লট হস্তান্তর/নামজারি কার্যক্রম বাতিল বলে বিবেচিত।
এমনকি সালাম মুর্শেদী নিজেই ২০১৪ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর বাড়িটি পরিত্যক্ত ‘খ’ তালিকা থেকে অবমুক্তির জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর আবেদন করেন। নিষ্পত্তি না হওয়া বিষয়টি দুদকের অনুসন্ধানেও চলে আসে।
অনুসন্ধান শেষে কী বলেছিল দুদকের আইন বিভাগ
দুদকের অনুসন্ধান দলের দেয়া প্রতিবেদনে স্পষ্টতই বলা হয়েছে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট জমি পরিত্যক্ত সম্পত্তি যা অবৈধ জাল কাগজ সৃজন করে হস্তান্তর করা হয়েছে। এতে বর্ণিত ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা তা সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা নির্ণয় সাপেক্ষ। এখানে আইনগত কোনো প্রশ্ন/ব্যাখ্যার বিষয় জড়িত নেই। ঘটনাগত প্রশ্নে কমিশন যেকোনো আইনগত সিদ্ধান্ত নিতে পারে বিধায় অনুসন্ধান প্রতিবেদনটি গ্রহণ করা বা না করা সম্পূর্ণ কমিশনের এখতিয়ারাধীন বিষয়।
No comments