‘গণতন্ত্র এখনো বিপদমুক্ত নয়’
বিতাড়িত স্বৈরাচার গত ৫ই আগস্ট দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছে উল্লেখ করে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনা এবং উদ্ভূত যে পরিস্থিতি, এগুলো পর্যালোচনা করলে কিন্তু নিঃসন্দেহে একটি কথা বলা যায় যে, গণতন্ত্র এখনো কিন্তু বিপদমুক্ত নয়। এরকম একটা পরিস্থিতিতে কোনো কোনো অপশক্তি যাতে আবার গণঅভ্যুত্থানের চূড়ান্ত লক্ষ্যে এবং সাফল্যের ধারাকে ব্যর্থ করতে না পারেন, সেজন্য দল-মত-নির্বিশেষে আমাদের সকলকে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, অগণতান্ত্রিক, অবৈধ গণতান্ত্রিক সরকার নিজেদের শাসন-শোষণ থেকে জনগণের দৃষ্টিকে ভিন্ন দিকে প্রভাবিত করতে বিভিন্ন সময় কিন্তু দেশে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি তৈরির কিন্তু অপচেষ্টা চালিয়েছে। কিংবা কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো তারা এখনো চেষ্টা করছে। আপনারা যদি এই যে বিতাড়িত পলাতক স্বৈরাচারের দুঃশাসনের ১৫ বছর দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কিংবা ধর্মীয় স্থাপনার ওপর এই যে হামলাগুলো হয়েছে, এই ঘটনাগুলো হয়েছে-এগুলো যদি আমরা সকলে মিলে নিরপেক্ষভাবে পর্যালোচনা করতে যাই তাহলে কিন্তু আমরা দেখবো, একটা হামলার ঘটনাও কিন্তু সরাসরি ধর্মীয় কারণে সংঘটিত হয়নি; বরং পতিত এই যে রাজনৈতিক দলটা, এদের অসৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য প্রতিটি হামলার নেপথ্য কারণ।
তারেক রহমান বলেন, আমি এর আগে আমরা যে অনুষ্ঠানগুলো করেছি, সেখানে কিন্তু আপনাদের সঙ্গে আমি মতবিনিময়ের সভায় বলেছিলাম যে, দেশের সুশীল সমাজ, সর্বদলীয় এবং সর্বধর্মীয় প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটা নাগরিক তদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে বিভিন্ন ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বাসা-বাড়ি কিংবা ধর্মীয় উপাসনালয়ে যে সংঘটিত এই ঘটনা, প্রত্যেকটা হামলার নেপথ্যে ঘটনা উদ্ঘাটন করে সুষ্ঠু বিচার করা। এই দাবি আমি জানিয়েছিলাম। কিন্তু গত ১৫ বছরে একটা ঘটনারও কী বিচার হয়েছে? বিচার দূরে থাক। একটা ঘটনারও কী বিশ্বাসযোগ্য কোনো তদন্ত হয়েছে? ২০১২ সালে রামু বৌদ্ধ বিহারে হামলা, অথবা ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হামলাসহ দেশের কোনো একটা হামলারও কিন্তু বিচার হলো না। কেনো তদন্ত হলো না, কেনো?
সংখ্যালঘু কিংবা সংখ্যাগুরু দল-মত-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে প্রত্যেকটি নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র এবং সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, নিজ নিজ অধিকার রক্ষায় প্রত্যেকটি নাগরিকের ভোটের অধিকার একটি কার্যকরী এবং শক্তিশালী অস্ত্র। যতদিন পর্যন্ত মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ব-খৃস্টান, অর্থাৎ দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেকটি নাগরিক নির্ভয়ে, নিশ্চিন্তে নিজের ভোট দিয়ে, নিজের পছন্দের প্রার্থীকে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করে জনগণের কাছে একটি জবাবহিদিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠাতা করতে সক্ষম না হবে, ততদিন পর্যন্ত কোনো নাগরিকই নিরাপত্তা এবং অধিকার সুরক্ষিত নয়।
বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশের জনগণের আবহমানকালে এই যে ধর্মীয় সামাজিক শিক্ষা, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি-কখনোই কিন্তু অপর ধর্ম কিংবা বর্ণের মানুষের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক আচরণের শিক্ষা দেয় না। এমনই কী বাংলাদেশে কখনো কোনোকালেই কিন্তু সাম্প্রদায়িক হামলা কিংবা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতো পরিস্থিতি ছিল না। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতে এটি করার কোনো কারণই আমি দেখি না। আমি মনে করি, কোনো কারণ নেই।
তিনি বলেন, হাতেগোনা দুই-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশে সংখ্যালুঘুকেন্দ্রিক অধিকাংশ হামলার ঘটনা কিন্তু ধর্মীয় কারণে হয়নি। অধিকাংশ হামলার ঘটনা অবৈধ লোভ- লাভের জন্য, দুর্বলের ওপর সবলের হামলা কিংবা এর নেপথ্যে রয়েছে অসৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে চরিতার্থ করা। তাই ধর্মীয় সংখ্যালুঘু মানেই নিজেদের দুর্বল ভাবার কোনো কারণ নেই। আর এই স্বৈরাচারী দুর্বৃত্ত কিংবা ক্ষমতালোভীদের কাছে সংখ্যালুঘুসহ কেউ নিরাপদ নয়।
তারেক রহমান বলেন, গুম, খুন, অপহরণ কিংবা আয়নাঘরের ভীতিমুক্ত পরিবেশের অনেক বছর পর আতঙ্কমুক্ত এবং স্বাধীনভাবে আজকের এই অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এরকম একটি স্বাধীন ও মুক্ত পরিবেশের জন্য দেশের সকল ধর্ম-বর্ণের গণতন্ত্রকামী মানুষ গত ১৫ বছর ধরে কিন্তু আন্দোলন ও সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। আমাদের এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় লক্ষ কোটি জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে, হাজারো শহীদের বা অসংখ্য ভাইয়ের চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজকের এই স্বাধীন এবং স্বস্তির পরিবেশ আমরা অর্জন করতে পেয়েছি। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার এই রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানে যারা হতাহত হয়েছেন। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি- দেশের জনগণ তাদের এই আত্মত্যাগ ও অবদান সারাজীবন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
সভাপতির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপি’র রাজনীতি হচ্ছে সকলকে নিয়ে রাজনীতি করা। আমাদের যে একটা ভয়াবহ দানবকে একটা অবিশ্বাস্য বিপ্লবের মধ্যদিয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যদিয়ে দীর্ঘ ১৫ বছর লড়াই করে বিজয় অর্জন করেছি, তারপরে এই বিপ্লব নস্যাৎ করার জন্য পরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্র হয়েছে, চক্রান্ত হয়েছে এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই এবং দুঃখজনকভাবে আপনাদের এর ভেতরে ফেলে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। যেটা আমরা সবসময় আপত্তি জানিয়েছি। ইন্ডিয়ার জার্নালিস্ট এসেছিল দলে দলে, সবাইকে একটা কথা আমরা বলেছি যে, এই পরিবর্তনের ফলে যেটুকু ঘটেছে সেটা সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক সেটা কোনো সাম্প্রদায়িক নয়। আজকে আবার একই চক্রান্ত শুরু হয়েছে পাবর্ত্য চট্টগ্রামে। দেখুন এগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে দেখবেন না। আজকে সেখানে একইভাবে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এটা কিন্তু আমাদের অবশ্যই রুখে দাঁড়াতে হবে। আসুন আমরা ভবিষ্যতে যেন একটি রেইনবো নেশন বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করতে পারি তারেক রহমানের নেতৃত্বে সেই পথে আমরা এগিয়ে যাই।
বিএনপির ধর্মবিষয়ক সহ-সম্পাদক অমলেন্দু দাস অপু এবং হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান কল্যাণ ফ্রন্টের মহাসচিব তপন দে’র যৌথ পরিচালনায় শুভেচ্ছা অনুষ্ঠানে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আবদুল মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী, চেয়ারপারসনে উপদেষ্টা অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চৌধুরী, হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান কল্যাণের চেয়ারম্যান বিজন কান্তি সরকার, ফেনীর কামাক্ষা চন্দ, খাগড়াছড়ির অজয় সেনগুপ্ত, সাভারের উত্তম ঘোষ, খুলনার সুজনা জলি, বরিশালের সঞ্জয় গুপ্ত, অবসরপ্রাপ্ত টিভি প্রযোজক মনোজ সেন গুপ্ত, গৌড় সিনহা, ইসকানের চারু চন্দ্র্র দাস ব্রহ্মচারী, চট্টগ্রাম অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস গোস্বামী, মহানগর পূজা উদ্যাপন কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার দেব, পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর, সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ শর্মা, গুলশান পূজা কমিটির জেএল ভৌমিক, পান্না লাল দত্ত, হিন্দু মহাজোটের সুশান্ত কুমার চক্রবর্তী, হিন্দু বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদের নির্মল রোজারিও প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, এজেডএম জাহিদ হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, কেন্দ্রীয় নেতা জয়ন্তু কুমার কণ্ড, আবদুল বারী ড্যানি, অর্পনা রায়, রমেশ দত্ত, দেবাশীষ রায় মধু, সুশীল বড়ুয়া, জনগোমেজ, মিল্টন বৈদ্যসহ কেন্দ্রীয় এবং হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান কল্যাণ ফ্রন্টের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
No comments