নিউইয়র্কে দেখা হচ্ছে না ইউনূস-মোদির, তবে বাংলাদেশ-ভারত বৈঠক হবে :পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন
জাতিসংঘের ৭৯তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সূচি প্রায় চূড়ান্ত। শনিবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা নিজেই এ তথ্য জানান।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান উপলক্ষে ওই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিউ ইয়র্ক যাচ্ছেন।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনের ফাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার দেখা হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, উনাদের দুজনের নিউ ইয়র্কে উপস্থিতি এক সাথে হচ্ছে না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিউ ইয়র্ক থেকে আগে চলে আসছেন আর প্রধান উপদেষ্টা একটু পরে যাচ্ছেন। কাজেই তাদের সেখানে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেই মনে হচ্ছে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর দ্বিপক্ষীয় আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, জয়শঙ্করের সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে যে এক ধরনের টানাপোড়েন চলছে এটা স্বীকার করতে হবে। সমস্যা সমাধান করতে হলে সমস্যার অস্তিত্ব অস্বীকার করলে চলবে না। আমরা অবশ্যই টানাপোড়েন দূর করার চেষ্টা করবো এবং ওয়ার্কিং রিলেশন যেন হয়। তবে সম্পর্কটা হতে হবে মর্যাদা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতে। এর ভিত্তিতে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া সম্ভব এবং আমরা সেই চেষ্টাই করব।
এর আগে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা লিখিত বক্তৃতায় বলেন, ‘আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর হতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯-তম অধিবেশনের উচ্চ পর্যায়ের বিতর্ক পর্ব শুরু হতে যাচ্ছে। এ অধিবেশনে যোগদানের জন্য প্রধান উপদেষ্টা আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইটে নিউইয়র্কে পৌঁছাবেন।’
তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোর মতো এবার বাংলাদেশ থেকে শতাধিক সদস্যের প্রতিনিধিদল ভাড়া করা উড়োজাহাজে নিউ ইয়র্ক সফর করবেন না। বরং যার যেই সংশ্লিষ্টতা বা দায়িত্ব, সে অনুযায়ী যতটা সম্ভব সীমিত আকারে প্রতিনিধিদল গঠন করা হয়েছে। আমি আমার দায়িত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ উচ্চ-পর্যায়ের সভাসমূহে অংশগ্রহণের জন্য ভিন্ন একটি ফ্লাইটে দুই দিন আগে নিউ ইয়র্কে যাবো। প্রধান উপদেষ্টা তিন দিন নিউ ইয়র্কে অবস্থান করে সফর শেষে ২৭ সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন।’
তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘এবছরের অধিবেশন বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এবছরই জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তির ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে। এ উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে ২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সদরদপ্তরে বাংলাদেশ একটি উচ্চ-পর্যায়ের সংবর্ধনার আয়োজন করছে। এতে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদলের প্রধানগণের পাশাপাশি জাতিসংঘের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা, কিছু সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানবৃন্দ, বিভিন্ন সংস্থা প্রধানবৃন্দ অংশগ্রহণ করবেন বলে আমরা আশা করছি। এ কথা বলার অবকাশ রাখে না যে, প্রধান উপদেষ্টার পরিচিতি এবং সুনাম বিশ্বব্যাপী। এ কারণে অনেকগুলো বিশ্বখ্যাত সংবাদ সংস্থা তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। এছাড়া, বিভিন্ন পর্যায়ে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক ও সভায় অংশগ্রহণ করার জন্যও অনুরোধ এসেছে। যেহেতু তিনি মাত্র তিনদিন নিউ ইয়র্কে অবস্থান করবেন, সেহেতু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষে এই স্বল্প সময়েরর মধ্যে সকলের অনুরোধ রক্ষা করা বেশ কঠিন।’
তিনি বলেন, ‘২৭ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাধারণ বিতর্ক পর্বে বক্তব্য রাখবেন। তিনি তার বক্তব্যে বিগত দুই মাসে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া অভাবনীয় গণ-অভ্যুত্থানের বিবরণ ও আগামী দিনে জনভিত্তিক, কল্যাণমুখী ও জনস্বার্থে নিবেদিত একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় বিশ্ব দরবারে তুলে ধরবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের বলিষ্ঠ অবস্থান, জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব, জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, বিশ্বব্যাপী সংঘাত, রোহিঙ্গা সংকট, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিকূলতা, উন্নয়নশীল দেশসমূহ হতে সম্পদ পাচার প্রতিরোধ, নিরাপদ অভিবাসন, অভিবাসীদের মৌলিক পরিষেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, জেনারেটিভ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রযুক্তির টেকসই হস্তান্তর, এবং ফিলিস্তিন সম্পর্কিত বিষয়সমূহ তাঁর বক্তব্যে উঠে আসতে পারে।’
তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা বেশ কয়েকটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অংশগ্রহণ করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। তিনি নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, নেপালের প্রধানমন্ত্রী, ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জাতিসংঘ মহাসচিব, জাতিসংঘ মানবাধিকার সম্পর্কিত হাই কমিশনার, বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রেসিডেন্ট, ইউএসএইডের প্রশাসক প্রভৃতির সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অংশ নিয়ে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। আসলে, এ সময়ে অনেক বৈঠকের সিদ্ধান্ত শেষ মুহূর্তেও হয়ে যায়। সে বিবেচনায় নতুন বৈঠক তালিকায় যোগ হতে পারে; আবার সময়ের অভাবে কোনো বৈঠক বাদও যেতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, ইতালির প্রেসিডেন্ট এবং কুয়েতের ক্রাউন প্রিন্সের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক আয়োজনের আলোচনা চলমান রয়েছে। এছাড়াও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রধান উপদেষ্টার সাথে দেখা করতে পারেন বলে আলোচনা চলছে।'
পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, ‘এবারের সাধারণ অধিবেশনের সাইড লাইনে আমিও বেশ কয়েকটি ইভেন্টে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবো। এর মধ্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘সামিট অব দ্য ফিউচার’। আগামী ২২-২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিতব্য ‘সামিট অব দ্য ফিউচার’-এ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ‘প্যাক্ট অব দ্য ফিউচার’ শীর্ষক একটি ভবিষ্যৎমুখী ঘোষণাপত্র অ্যাডাপ্ট করবেন। এই ‘প্যাক্ট অব দ্য ফিউচার’-এর সংযুক্তি হিসেবে ‘ডিক্লারেশন অন দ্য ফিউচার জেনারেশন’ এবং ‘গ্লোবাল ডিজিটাল কমপ্যাক্ট’ শীর্ষক আরও দু’টি ঘোষণাপত্র গৃহীত হবে বলে আমরা আশাবাদী।’
উল্লেখ্য, এই তিনটি ডকুমেন্ট-এর চলমান নেগোসিয়েশন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ বিষয়ে আলোচনা ও মত বিনিময়ের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কর্তৃক জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের সহযোগিতায় ঢাকায় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এছাড়া আমি আরও যে সকল সভায় অংশগ্রহণ করবো বলে আশা করছি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের মন্ত্রীপর্যায়ের সভা, কমনওয়েলথ রাষ্ট্রসমূহের পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণের সভা, ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার মন্ত্রী পর্যায়ের সভা, স্বল্পোন্নত দেশসমূহের বার্ষিক মন্ত্রীপর্যায়ের সভা, এশিয়া সহযোগিতা সংলাপের মন্ত্রী পর্যায়ের সভা ইত্যাদি।'
পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, ‘এছাড়া আমরা রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ে একটি উচ্চ-পর্যায়ের সাইড ইভেন্টও আয়োজন করছি। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কার কাজ শুরু করেছে। এ প্রেক্ষাপটে এবারের অধিবেশন নতুন বাংলাদেশের জন্য জাতিসংঘে বা বিশ্ব সভায় নতুন পদচারণা। এবারের অধিবেশনে আমাদের কাছে একটি বিরাট সুযোগ বিশ্ব দরবারে এই বৈষম্যহীন, ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশকে উপস্থাপনের জন্য।’
তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘের অগ্রাধিকার ইস্যুগুলোর প্রত্যেকটি বাংলাদেশের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই ইস্যুগুলোর ওপর যেসব ইভেন্ট আছে, সেগুলোর সবকয়টিতেই বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে বলে আশা করা যাচ্ছে। জাতিসংঘসহ বহুপাক্ষিক কূটনীতিকে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসাবে মনে করে বাংলাদেশ। সার্বিক বিবেচনায় এবারের অধিবেশনে উপদেষ্টার নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রকে বিস্তৃত ও সুদৃঢ় করবে আশা করা যাচ্ছে।’
No comments