মেহেদীর পরিবারে কান্না by ফাহিমা আক্তার সুমি

চৌদ্দ বছর বয়সী মেহেদী হাসান জুনায়েদ। স্বপ্ন দেখতেন একদিন বড় হবেন। পড়াশোনা শেষে বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করবেন। কিন্তু স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই পুলিশের বুলেট কেড়ে নেয় তার জীবন। দুই ভাইবোনের মধ্যে মেহেদী ছিলেন ছোট। রাজধানীর উইল পাওয়ার স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন মেহেদী। ৫ই আগস্ট সোমবার ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে যোগ দিতে তার বন্ধুর সঙ্গে চাঁনখারপুলে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। তার মাথায় দুইটি গুলি লাগে। দুপুর দেড়টার দিকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সেদিন মেহেদীকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর শেষবারের মতো নিয়ে যাওয়া হয় তাদের নিজ বাড়িতে। মেহেদীর মৃত্যুতে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে পরিবারটি। ঘর জুড়ে সন্তানের রেখে যাওয়া স্মৃতি আঁকড়ে কেঁদে যাচ্ছেন বাবা-মা।

মেহেদীর মা সোনীয়া জামান মানবজমিনকে বলেন, আমাদের সন্তান ছিল আমাদের রত্ন। মেহেদী মেধাবী এবং সাহসী ছিল। ঘটনার দিন সকালে আমার সন্তানকে রসুন ভর্তা দিয়ে ভাত খাইয়ে দিয়েছিলাম। এ সময় মেহেদী বলেছিল এর আগে সে দু’বার আন্দোলনে গিয়েছিল এবং সেখানে খাবারও বিতরণ করেছিল। মেহেদীর মা বলেন, ঘটনাস্থলে থাকা মেহেদীর এক বন্ধু জানায়- মেহেদী পুলিশের খুব কাছে গিয়ে ঢিল ছুড়ছিল। সে মেহেদীকে ফিরে আসতে বলেছিল, কিন্তু মেহেদী রাজি হয়নি। মেহেদীর কোনো দোষ ছিল না। আমি গর্বিত যে আমার ছেলে ন্যায়ের জন্য রাজপথে দাঁড়িয়েছিল। যারা নিহত হয়েছে আমি সবার বিচার চাই।  

পুরান ঢাকার ধুপখোলা পুকুরপাড়ে মেহেদীর নিজ বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার ব্যবহৃত সবকিছুই সাজানো-গোছানো, নেই শুধু মেহেদী। সে খেলাধুলা খুব পছন্দ করতো। পরিবারের সবার ছোট হওয়ায় তাকে সবাই ভালোবাসতো। একমাত্র বোন ছিল তার বন্ধু, সারাক্ষণ বোনের সঙ্গে কেটে যেতো গল্পে। মাতিয়ে রাখতো পুরো ঘরটি। তার মৃত্যুতে পুরো পরিবারটিতে এখানো থামেনি শোকের ছায়া। নীরব হয়ে রয়েছে বাড়িটি। কাঁদতে কাঁদতে সোনীয়া বলেন, ওর বাবা বাসা থেকে বের হয় না, একদম নীরব হয়ে গেছে। মেয়েটা ওর বন্ধুকে হারিয়েছে। মেহেদী বাসায় থাকলে সারাক্ষণ আম্মু আম্মু করতো। আমি খুব মিস করছি আমার সন্তানটিকে। মেহেদী ফাস্টফুড আইটেমগুলো খেতে খুব পছন্দ করতো। আমার সন্তান চলে যাওয়ার একমাস পার হয়ে গেছে কিন্তু আমার কাছে সবসময় মনে হয় ও ঘরেই আছে। আমি রাতে প্রায়ই ওকে স্বপ্ন দেখি। আমার সন্তানটির এই শূন্যতা কেউ পূরণ করতে পারবে না। দুইটা সন্তানকে কোনোদিন হাত-পা, শরীর কাটতে দেইনি এত যত্ন করে বড় করেছি। আমি যখন মেহেদীকে দেখি তখন ওর শরীর রক্তে ভেজা ও মাথায় ব্যান্ডেজ করা ছিল। শুধু আমার সন্তান মৃত্যুর জন্য না, একজন মা হিসেবে আমি মারা যাওয়া সব সন্তানের বিচার চাই। এরা তো খুব বেশি কিছু চাইছিল না, সামান্য একটা দাবির জন্য শত শত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে হলো। এরা তো আমাদের রত্ন ছিল। আমরা মায়েরা গর্বিত যে এমন সন্তানদের জন্ম দিয়েছি।

তিনি বলেন, অন্যদিন ঘুম থেকে দেরি করে উঠলেও ওইদিন সকাল ৬টার সময় ঘুম থেকে উঠে যায় মেহেদী। এ সময় শুয়ে শুয়ে আন্দোলনের ভিডিওগুলো দেখে। সকাল ১০টার দিকে নাস্তা দিতে চাইলে বলে আম্মু রসুন ভর্তা দিয়ে ভাত খাবো। তখন আমি তাকে রসুন ভর্তা দিয়ে ভাত খাইয়ে দেই। মেহেদী বলে আমি এর আগে দুইদিন আন্দোলনে গিয়েছিলাম তুমি বকবে বলে বলিনি। আমার মেয়েটা বলে আম্মু আমি কলেজে যাবো সবাই আজ একসঙ্গে বের হবে কলেজ থেকে। তখন আমি মেয়েকে বলেছি তাহলে তোমার সঙ্গে আমিও যাবো। আর মেহেদী বলে ঠিক আছে আম্মু আমি তাহলে বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলনে যাবো। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বের হয়ে যায় বুকের মানিকটি। আমিও ছেলে বের হওয়ার পাঁচ মিনিট পরে মেয়েকে নিয়ে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের দিকে যাই। তখন রাস্তায় অনেকবার পুলিশের বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম। সোয়া দুইটার দিকে হঠাৎ আমার বড় ভাই কল দিয়ে বলে তুমি কই। এ সময় বলে মেহেদী কই? গুলির ঘটনাটি শুনতে পায়। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় মেহেদী। যারা হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং আশপাশে যারা ছিল তারাও বলেছে একই কথা। খবর শুনে আমি একটা রিকশা নিয়ে বাসার দিকে চলে আসি। বাসায় এসে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে আমার সন্তান আর নেই। ভেবেছিলাম হয়তো কোনো আঘাত লেগেছে কিন্তু এসে দেখি আমার মেহেদীর রক্তাক্ত নিথর দেহ রেখে দিয়েছে বাড়ির সামনে। আমার একমাত্র ছেলে ছিল মেহেদী। কীভাবে আমার মনটাকে সান্ত্বনা দিয়ে রাখবো।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.