সিকৃবিতে দুর্নীতি: অবৈধ নিয়োগে ১৪ বছর চাকরি করে অবসরে আনিছ

বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে নিয়োগ-পদোন্নতি ঘিরে দলীয়করণ, অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির যেন হাট বসেছিল সিলেট কৃষি  বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিকৃবি)। শর্ত শিথিল, যোগ্যপ্রার্থীদের বঞ্চিত করে অযোগ্যদের উচ্চতর পদে নিয়োগের রীতিমতো মচ্ছব চালিয়েছিলেন ১৬ বছরের বিভিন্ন সময়ের সাবেক ভিসিরা।  বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ সমর্থিত রফিক-আওলাদ প্যানেলে হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী হলের ভিপি ছাত্রলীগ নেতা আনিছুর রহমান। পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সিকৃবি’র সাবেক দুর্নীতিবাজ দুই ভিসি প্রফেসর ড. আব্দুল আউয়ালের সময় ইউজিসি’র নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে জনসংযোগ ও প্রকাশনা দপ্তরে ডেপুটি ডিরেক্টর (এডহক) ভিত্তিতে নিয়োগ ও পরে ভিসি প্রফেসর ড. শহীদ উল্লাহ তালুকদারের সময়ে পরিচালক পদে স্থায়ী নিয়োগ লাভ করেন। শর্তানুসারে তার চাকরির পূর্ব কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। বয়সও ছিল বেশি। নিয়োগ বোর্ডে তিনি একাই ছিলেন প্রার্থী। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক এডহক ভিত্তিতে জনবল নিয়োগ না করার জন্য (২৫.০৩.০৯ তারিখে) প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেও সরকারি সিদ্ধান্তকে তোয়াক্কা না করে ডেপুটি ডিরেক্টর পদে বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে একদিনের অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও ডেপুটি ডিরেক্টর অস্থায়ী (এডহক) হিসেবে আনিছকে নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট পদে নিয়োগ পেতে কমপক্ষে ১০ বছর চাকরির অভিজ্ঞতাকে পাশ কাটিয়ে এ নিয়োগ দেয়া হয়। ছাত্রলীগ নেতা আনিছুর রহমান ২০১০ সালের মার্চ মাসে রেজিস্ট্রার পদে আবেদন করেন।

রেজিস্ট্রার পদের জন্য গঠিত বাছাই বোর্ড আনিছের যোগ্যতা না থাকায় অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে ২০১০ সালের ২২শে আগস্ট স্মারকে (রেজি.কার্যা/পরিষদ বিভাগ /১০/৯৭) জনসংযোগ ও প্রকাশনা দপ্তরের ডেপুটি ডিরেক্টর (এডহক) হিসেবে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে। অথচ এই পদে তিনি আবেদনই করেননি। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়- পতিত স্বৈরাচার, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ের কর্মকর্তা ডা. আওলাদ হোসেনের ঘনিষ্ঠ দাবিদার সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আনিছুর রহমানকে ওয়ার্ল্ড ভিশন এনজিওতে চাকরিরত অবস্থায় ৪৭ বছর বয়সে অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র আওয়ামী দলীয় বিবেচনায় অনিয়মের মাধ্যমে ২০১০ সালের ২৩শে আগস্ট জনসংযোগ দপ্তরের পরিচালক পদের বিপরীতে উপ-পরিচালক (এডহক)  হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। অথচ এ পদে নিয়োগ পেতে হলে যোগ্যতা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী পরিচালক অথবা সমমানের পদে ৫ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতাসহ বিশ্ববিদ্যালয় অথবা সরকারি/আধা-সরকারি/স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে একাধারে সর্বমোট ১০ বছর চাকরির অভিজ্ঞতা থাকা বাধ্যতামূলক হওয়ার পাশাপাশি বয়স সর্বোচ্চ ৪০ বছর হতে হবে। কোনো  নিয়োগ  বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই এডহক (অস্থায়ী)  ভিত্তিতে ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগ দেয়ার পর নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ২০১০ সালের ২রা নভেম্বর অফিস আদেশে আনিছকে একটি অতিরিক্ত ইনক্রিমেন্ট প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে ২০১২ সালের ১২ই এপ্রিল এডহক (অস্থায়ী) হিসেবে ২ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই নিয়মিত করা হয়। এর ১ বছরের মাথায় ২০১৩ সালের ২২শে আগস্ট স্মারকে (রেজি/সংস্থাপন-১/ব্যক্তি নথি (কর্মকর্তা-৭৪)/১০/১৫৪৪) জনসংযোগ ও প্রকাশনা দপ্তরের পরিচালক পদে নিয়োগ প্রদান করা হয় আনিছকে। যে নিয়োগ বোর্ডে একমাত্র আনিছকেই ইন্টারভিউ কার্ড প্রদান করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে এবং নিয়োগ বোর্ডে একজন মাত্র বহি: সদস্যের স্বাক্ষরে কোরাম না হওয়া সত্ত্বেও তার নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়।

আওয়ামী-বামপন্থি হিসেবে পরিচিত একাধিক শিক্ষক-কর্মকর্তা মানবজমিনকে জানিয়েছেন- আনিছুর রহমানের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ থেকে শুরু করে তাকে ওই পদ পাইয়ে দিতে সবধরনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন তৎকালীন দুর্নীতিবাজ ভিসি শহীদ উল্লাহ তালুকদার। রেজিস্ট্রার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়- ইউজিসির নির্দেশিত নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালক পদে নিয়োগ প্রদান করতে হলে ৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকার পাশাপাশি ১ম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে একাধারে ১৫ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু সেটি পূর্ণ হওয়ার  কথা  উল্লেখ না করে বিজ্ঞপ্তিতে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানের চাকরির অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করা হলেও জনসংযোগ দপ্তরে ডেপুটি ডিরেক্টর (এডহক) হিসেবে যোগদানের ৩ বছরের মাথায় আনিছকে দলীয় বিবেচনায় জনসংযোগ ও প্রকাশনা দপ্তরের পরিচালক পদে নিয়োগ প্রদান করা হয়। দলীয় বিবেচনায় অবৈধভাবে নিয়োগ লাভের পর  দীর্ঘ ১৪ বছর আওয়ামী সরকারের আমলে দাপটের সঙ্গে চাকরি করা আনিছ ৩০শে আগস্ট পিআরএল ছুটি শেষ করেছেন বলে রেজিস্ট্রার দপ্তর সূত্রে জানা যায়। অবৈধ নিয়োগ লাভের পর ১৪ বছরে প্রায় ১ কোটি ৫ লাখ টাকা বেতন ভাতাদি উত্তোলনসহ ভবিষ্যৎ তহবিল খাতের প্রায় ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করেছেন আনিছ। এখন অবসরের এককালীন কোটি টাকা পাওয়ার জন্য তদবির করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব শাখার কর্মকর্তারা জানান- বিশ্ববিদ্যালয়ে পেনশনযোগ্য চাকরি গণনার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকরি বিবেচনাযোগ্য। সেটি এখন খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.