অশান্ত পাহাড়, নিহত ৪
রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি জানিয়েছেন- খাগড়াছড়ির পাহাড়ি-বাঙালির সংঘর্ষের রেশ রাঙ্গামাটি শহরেও ছড়িয়েছে। এর জেরে রাঙ্গামাটিতে পাহাড়ি ও বাঙালির মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে একজন নিহত ও ৫০ জন আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় শহর জুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। গতকাল সকালে আগাম ঘোষণা ছাড়াই কয়েক হাজার পাহাড়ি যুবক বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে শহরের জিমনেসিয়াম হয়ে প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা বনরূপা বাজারে এসে মসজিদ, পেট্রোল পাম্পসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালাতে থাকে। এতে শহর জুড়ে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় স্থানীয় বাঙালিরা সংগঠিত হয়ে ধাওয়া দিলে পাহাড়িরা পিছু হটে। রাস্তায় চলাচলকারী বাস, ট্রাক ও ট্যাক্সিতে হামলা এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়। শহরের হ্যাপির মোড়কে কেন্দ্র করে এর দু’দিকে অবস্থান নেয় পাহাড়ি ও বাঙালিরা। পরে পাহাড়ি-বাঙালি উভয়পক্ষ শহরের বনরূপা, হ্যাপির মোড়, কালিন্দিপুর, রাজবাড়ী, স্টেডিয়াম এলাকা, কল্যাণপুর, ভেদভেদীসহ বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এতে করে অন্তত ৩০টি যানবাহন ভাঙচুরের পাশাপাশি উভয়পক্ষের অন্তত অর্ধশতাধিক লোকজন আহত হন। রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একজন নিহত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করলেও তার নাম ও ঠিকানা তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত করেনি। আহতদের মধ্যে বাঙ্গালিদের বেশ কয়েকজনের শরীরে গুলির আঘাত রয়েছে। এ ছাড়া পাহাড়িরা মারধর ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতের কারণে আহত হয়েছেন বলে হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে। আহতদের মধ্যে ১০-১২ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক সাদিয়া আক্তার। পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. জামাল উদ্দিন জানান, সকালে পাহাড়িদের একটি মিছিল বনরূপায় এসে ফিরে যাওয়ার সময় বাঙালিদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলাসহ বেশ কয়েকটি গাড়িতে ভাঙচুর করে। এরপরই বাঙালি ব্যবসায়ীরা সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের পাল্টা ধাওয়া দেয়।
খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানিয়েছেন: খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় পাহাড়ি-বাঙালি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উভয় পক্ষের ৮ জন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া বৃহস্পতিবারের সংঘর্ষে ৩ জন নিহত হয়েছেন। এ সময় দুর্বৃত্ত কর্র্তৃক অগ্নিসংযোগের ঘটনায় উভয় পক্ষের প্রায় অর্ধশতাধিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে। এ ঘটনায় পরস্পরবিরোধী অভিযোগ পাওয়া গেছে। বৃহস্পতিবার বিকালে উপজেলার লারমা স্কয়ার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি’র সদস্যরা টহলে রয়েছে। বর্তমানে দীঘিনালায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা।
সংঘর্ষের সূত্রপাত যেভাবে: বুধবার খাগড়াছড়িতে চোর সন্দেহে বাঙালি যুবক মোহাম্মদ মামুন (৩০) কে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। মামুন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার বাসিন্দা। এর প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টায় দীঘিনালা সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেয়। পূর্বনির্ধারিত সময়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল শুরু করলে স্থানীয় পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে আসা সাধারণ বাঙালি শিক্ষার্থীদের ওপর পরিকল্পিতভাবে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে এবং লাঠিসোটা নিয়ে ধাওয়া করে। এতে আন্দোলনকারী সাধারণ বাঙালি শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এ ঘটনায় কয়েকজন বাঙালি শিক্ষার্থী আহত হয়। পরে বোয়ালখালী বাজার এলাকা ও আশপাশ এলাকা থেকে বাঙালি লোকজন জড়ো হয় বাসটার্মিনালের দক্ষিণ প্রান্তে। তখন বিভিন্ন এলাকা থেকে পাহাড়ি লোকজনও জড়ো হতে থাকে লারমা স্কয়ারে। একপর্যায়ে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। তখন লারমা স্কয়ার থেকে বাঙালিদের দিকে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে সন্ত্রাসীরা। এতে মুহূর্তের মধ্যে এলাকায় চরম আতঙ্ক এবং উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। আর তা ছড়িয়ে পড়ে উপজেলা জুড়ে। কিছুক্ষণ পরেই দুর্বৃত্তরা লারমা স্কয়ারে সড়ক ও জনপদের জায়গায় গড়ে ওঠা অস্থায়ী ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান দোকানপাটে আগুন দেয়। পরে পুলিশের পক্ষে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টায় যখন বেসামাল অবস্থা, তখন সেনাবাহিনীর সদস্যরা মাঠে নামেন। ততক্ষণে মার্কেটের প্রায় সকল দোকানপাট পুড়ে যায়। মার্কেটটিতে পাহাড়ি-বাঙালি উভয়পক্ষের দোকানপাট ছিল। তাদের মধ্যে সখ্যতাও ছিল বেশ।
পুলিশের সূত্রগুলো বলছে, দীঘিনালায় পাহাড়ি ও বাঙালির সংঘর্ষের জের ধরে বৃহস্পতিবার রাতভর জেলা সদরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে সদরসহ পুরো জেলায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। রাতের গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনায় ৩ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন। নিহতরা হলেন জুনান চাকমা (২০), ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) ও রুবেল চাকমা (৩০)। বৃহস্পতিবার রাতে জেলা শহরের নারানখখাইয়া, স্বনির্ভর এলাকায় ব্যাপক গুলির শব্দ শোনা যায়। পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গভীর রাত পর্যন্ত গুলির শব্দ পাওয়া যায়। এরমধ্যে ধনঞ্জয় চাকমা দীঘিনালায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সংঘর্ষে মারা যান। অপর ২ জনকে আহত অবস্থায় রাতে খাগড়াছড়ি সদর থেকে হাসপাতালে আনা হয়। খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, রাতে আহত অবস্থায় হাসপাতালে ১৬ জনকে আনা হয়। তারা বেশির ভাগই সদর উপজেলা থেকে এসেছেন। এরমধ্যে ৩ জন মারা যান। নিহত ব্যক্তিদের মৃত্যুর কারণ ময়নাতদন্ত শেষে বলা যাবে। বর্তমানে হাসপাতালে আরও ৯ জন চিকিৎসাধীন। রাতেই ৪ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এরমধ্যে একজন বাঙালি রয়েছেন। আহত বাকি ৯ পাহাড়িকে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হচ্ছে।
এদিকে আগুন লাগার ঘটনাস্থল লারমা স্কয়ার থেকে ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের দূরত্ব ছিল মাত্র ৫০০ মিটারের কাছাকাছি। খুব কাছে থেকেও ফায়ার সার্ভিস যথাসময়ে না পৌঁছায় আগুনে আরও কিছু অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, গত রাত থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাঙালি ও পাহাড়ি সম্প্রদায়ের বেশ কিছু ফেসবুক আইডি থেকে দীঘিনালায় সংঘাত ঘটানোর উগ্রতা ছড়ানো হয়েছে। অথচ এ বিষয়ে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফ থেকে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। এ ছাড়া যদি সমন্বিত কোনো সভা বা মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হতো তাহলে অবশ্যই এই সংঘাত ও ক্ষতি এড়ানো যেতো। এই ঘটনায় অনুষ্ঠানিকভাবে কোনো পক্ষ থেকে এখনো পর্যন্ত কারও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে এ ঘটনায় পরস্পর পরস্পরকে দুষছেন। দীঘিনালা থানার অফিসার্স ইনচার্জ মো. নুরুল হক বলেন, ‘দীঘিনালায় একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। যা কখনো কাম্য নয়। বর্তমানে পরিস্থিতি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
বিশেষ মতবিনিময় সভা: গতকাল বিকালে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণ্ন্ন রাখতে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিশেষ মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান এর সভাপতিত্বে এতে খাগড়াছড়ি রিজিয়নের রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমান হাসান প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। এ সময় খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশ সুপার মো. আরেফিন জুয়েল, জেলা বিএনপি’র সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ওয়াদুদ ভূঁইয়া, খাগড়াছড়ি প্রেস ক্লাবের সভাপতি তরুণ কুমার ভট্টাচার্য্য, প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট জসিম উদ্দিন মজুমদার, মারমা প্রতিনিধি ম্রাসাথোয়াই মারমা, চাকমা প্রতিনিধি অনিমেষ চাকমা এবং ত্রিপুরা প্রতিনিধি বক্তব্য রাখেন। মতবিনিময়ে বক্তারা ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হতাহতের ঘটনায় খুবই উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সবাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনরুদ্ধারের উপর জোর দেন। সবাইকে আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানান।
খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান বলেন, আপনারা কেউ আতঙ্কিত হবেন না, গুজবে কান দিবেন না। আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণ্ন্ন রাখতে কাজ করছি। ইতিমধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। শান্তি-সম্প্রীতি অক্ষুণ্ন রাখতে দীঘিনালায় আমরা উভয় পক্ষের ৪০ জন সদস্যকে নিয়ে একটি শান্তি কমিটি গঠন করেছি। আশা করি পরিস্থিতি শিগগিরই স্বাভাবিক হবে। ক্ষতিগ্রস্তদের আমরা সরকারি সহায়তার আওতায় আনবো।
রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমান হাসান বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, প্রশাসন যৌথবাহিনী কাজ করছে। এ ছাড়া স্থানীয় সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে জরুরি আইনশৃঙ্খলা সভা করা হয়েছে। সকলে মিলে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি আমরা। সেনাবাহিনী সবসময় জনসাধারণের পাশে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণ্ন্ন রাখতে আমরা কাজ করছি। ফেসবুক গুজব মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। আপনারা গুজবে পা দেবেন না। গুজব থেকে দূরে থাকতে সকলের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
No comments