মোহাম্মদপুরে সাদেক খানই ছিলেন সব by সুদীপ অধিকারী

সাদেক খানের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানের বিষয়ে দুদকের সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন বলেন, আমাদের একটি গোয়েন্দা উইং রয়েছে। তারা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক আগে থেকেই তারা সাবেক এমপি সাদেক খানের বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। তারা অনেক তথ্য-প্রমাণও পেয়েছেন। সেই প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতেই সাদেক খানের বিরুদ্ধে আমাদের অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, শিয়া মসজিদ, আদাবর, বসিলা, ঢাকা উদ্যান, বুদ্ধিজীবী, জাফরাবাদ, পুলপাড়, গদিঘর, রায়েরবাজার নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৩ আসন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪নং ওয়ার্ড পুরোটাই এই আসনের অন্তর্গত। রাজধানীর এই বিশাল এলাকার  বেশির ভাগেরই নিয়ন্ত্রণ ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য সাদেক খানের হাতে। মোহাম্মদপুর, কাটাশুর, জাফরাবাদ, বুদ্ধিজীবী, রায়েরবাজার, গদিঘর, বসিলা, ঢাকা উদ্যান এলাকায় তিনিই সর্বেসর্বা। তার মতের বাইরে যাওয়ার সাধ্য কারোর-ই নেই। নিজেদের সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে ভয়ের রাজনীতি কায়েম করে এলাকাটিতে বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, ফিলিং স্টেশন, কাঁচামালের আড়তসহ নামে বেনামে গড়েছেন অঢেল সম্পদ। যার অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক।

সাদেক খান ১৯৭৩ সালে ঢাকা কলেজ ছাত্র লীগের সদস্য পদের মধ্যদিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। এরপর ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত  অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের তৎকালীন ৪৭ নং ওয়ার্ড ও বর্তমান ৩৪ নং ওয়ার্ড থেকে পরপর চার বার কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। দুইবার ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। ১৯৯৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ছিলেন মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সে সময় থেকেই নিজের দলের মধ্যেই একাধিক গ্রুপিং সৃষ্টি করার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে রাতের ভোটে হন ঢাকা-১৩ আসনের এমপি। এরপর আর পেছনে তাকানো লাগেনি তার। নিজের সন্ত্রাসী বাহিনীর দাপটে সরকারি খালের জমি দখল, হিন্দু সম্পত্তি দখল করে গড়ে তুলেছেন সাদেক ফিলিং স্টেশন, সাদেক নগর মডেল টাউন, সাদেক খান কৃষি মার্কেট, সাদেক খান হাঁস-মুরগির মার্কেট, সাদেক খান শুঁটকি মার্কেট, সাদেক খান ইট মার্কেট, সাদেক খান বালি মার্কেট, সাদেক খান বস্তিসহ একাধিক সম্পত্তি। ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে নিজ নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে একাধিক রাস্তারও নামকরণ করেছেন তিনি। রায়ের বাজার গদিঘর এলাকার ৫৪ নম্বর বাড়িতে বাস করলেও মোহাম্মদপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নামে-বেনামে একাধিক বাড়ি, ফ্ল্যাট রয়েছে তার। মোহাম্মদপুর বসিলা, ৪০ ফিট, ঢাকা উদ্যান এলাকায় সরকারি খাল ভরাট করে যেসব আবাসন গড়ে উঠেছে, অভিযোগ আছে এর নেপথ্যে কাজ করেছেন সাবেক এই সাংসদ। প্রতিটি আবাসন কোম্পানিকে প্রতি মাসেই মোটা অঙ্কের প্রোটেকশন মানি দিতে হতো তাকে।

সরজমিন দেখা গেছে, পশ্চিম ধানমণ্ডির রায়ের বাজার মসজিদের পেছন থেকে সোজা চলে গেছে হাশেম খান রোড। রোডটি গিয়ে গাবতলী-সদরঘাট রোডের যেই স্থানে মিলিত হয়েছে ঠিক তার ডান হাতেই ‘সাদেক ফিলিং স্টেশন’। যেটি পুরো পশ্চিম ধানমণ্ডির পানি নিষ্কাশনের পানি বের হওয়া খালের জায়গার ওপর। পুরো ফিলিং স্টেশনটিই পানি উন্নয়ন বোর্ডের খালের জায়গা ভরাট করে তৈরি করা হয়েছে।  আর এই ফিলিং স্টেশনের পেছনেই রয়েছে ‘সাদেক নগর মডেল টাউন’ নামে বিশাল আবাসন প্রকল্প। তেল পাম্পের পেছনে চারপাশে দেয়ালে ঘেরা এই মডেল টাউনে রয়েছে একাধিক বিশাল বহুতল ভবন। আর ভবনগুলোর যাতায়াতের রাস্তার পাশে এখনো পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাইনবোর্ড টানানো রয়েছে। সাইনবোর্ডের পাশ দিয়েই চলে গেছে ভবনে ঢোকার প্রবেশ দ্বার। আর পাম্পের ভেতর দিয়ে ভবনগুলোতে যাওয়া-আসার জন্য তৈরি করা হয়েছে বিশেষ রাস্তা। সাবেক এই সংসদ সদস্য প্রায়ই সেখানে সময় কাটাতেন। ফিলিং স্টেশনের সামনের গাবতলী-সদরঘাট রাস্তা ধরে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের দিকে এগুতেই হাতের বামে রাস্তার পাশের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে ‘সাদেক খান শুটকি মাছের আড়ৎ’। ইটের অর্ধেক দেয়ালের ওপর স্টিলের পাত ও টিন দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল এই শুঁটকি মাছের আড়ত। এরপরই রয়েছে ‘সাদেক খান হাঁস-মুরগির আড়ত’। রায়ের বাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের সঙ্গে লাগোয়া এই মার্কেটে প্রতিদিন রাতে-দিনে লাখ লাখ টাকার বেচা-কেনা চলে। এর থেকে কয়েক পা সামনে গেলেই মেইন রাস্তার দুইপাশ দিয়েই রয়েছে সাদেক খানের নামে বাজার। প্রথমে হাতের ডানে সাদেক পিয়াজ-রসুন-আদার পাইকারি মার্কেট। এরপর সাদেক খান কৃষি মার্কেট, সাদেক খান ফল মার্কেট, সাদেক খান আড়ত। সাদেক খান কৃষি মার্কেটের পাশেই রাস্তায় আলহাজ সাদেক খান মার্কেট। টিনের ছাউনি করা মার্কেটের নির্ধারিত জায়গা ছাড়াও রাস্তার উভয় পাশের ফাঁকা জায়গা দখল করে বসানো হয়েছে বাজার। এভাবেই দিনের পর দিন বছরের পর বছর রাস্তা ও সরকারি জায়গা দখল করে মুনফা লুটছেন সাদেক খান গং। আর এসব বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য তার রয়েছে আলাদা আলাদা বাহিনী। যাদের মাধ্যমে এই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। শুধু বাজার, মার্কেট, ফিলিং স্টেশন,নামে বেনামে বাড়ি নয় সাবেক এই সাংসদের নামে বুড়িগঙ্গার খালের ওপর নিজ নামে ‘ঘাট’ও রয়েছে। সাদেক খান মুরগির আড়তের পাশ দিয়ে যাওয়া রাস্তার শেষে গিয়ে মিশেছে রায়ের বাজার সাদেক খান ঘাটে। এদিকে রায়ের বাজার মসজিদের পেছন থেকে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত রাস্তাটিকে নিজের নামে ‘সাদেক খান রোড’ নামকরণ করেছেন। আশপাশের রাস্তা, মার্কেটগুলোও ক্ষমতার দাপটে তার এবং তার পরিবারের সদস্যদের নামে নামকরণ করিয়ে নিয়েছেন। মিয়া চান খান সড়ক, আজিজ খান সড়ক, সাদেক খান সড়ক, মুকিম খান রোড, হাসেম খান রোডসহ রায়ের বাজার বুদ্ধিজীবী এলাকার প্রতিটি রাস্তাই ক্ষমতার জোরে সাদেক খান নিজের ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে করেছেন।

মো. আব্বাস নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের এই ১৬ বছরে সাদেক খান নিজের নামে ও বেনামে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। এর মধ্যে রায়ের বাজার গদিঘর এলাকায় তার নিজ নামে একটি বাড়ি রয়েছে। সেখানে তিনি বসবাস করতেন। এ ছাড়াও রায়ের বাজার বৈশাখী মাঠের পাশে তার আরও একটি বাড়ি রয়েছে। সাদেক খান রোডেও তার বেশ কয়েকটি সুউচ্চ ভবন রয়েছে। যেগুলো অন্য মানুষের নামে থাকলেও মূল মালিক তিনিই। রায়ের বাজার সুলতানগঞ্জ লেনেও তার একটি বহুতল ভবন রয়েছে। আব্বাস বলেন, শুধু দেশে নয় ’১৯ সালে দেশের বাইরে মালয়েশিয়াতেও তিনি অনেক সম্পত্তি করেছেন। সেখানে বাড়ি-গাড়ি সব আছে তার। মো. জসিম নামে গদিঘর এলাকার আরেক বাসিন্দা বলেন, রায়ের বাজার-বুদ্ধিজীবী এলাকায় সাদেক খানের যেমন সম্পত্তি রয়েছে তার থেকে আরও বেশি, সম্পত্তি করেছেন নদীর ওই পাড়ে (কেরানীগঞ্জ)। সেখানে ইট ভাটা, বালু মহল, বালুর ব্যবসা, আবাসন ব্যবসাসহ অনেক সম্পদ তার। আর মোহাম্মদপুর তিন রাস্তা থেকে আঁটি বাজার পর্যন্ত রাস্তার দুই ধার দিয়ে যেসব আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠেছে তার প্রতিটি থেকেই মাসোহারা পেতেন তিনি। আর এসব টিকিয়ে রাখতে নিজের দলের মধ্যেই কতো রক্ত ঝরিয়েছেন, কতো গ্রুপিং করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। তিনি বলেন, গত দুটি জাতীয় নির্বাচনের আগে মনোনয়ন পেতে ও নিজ দলের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে একাধিক সংঘর্ষ বাধিয়েছেন সাদেক খান। আর তার এই বাহিনী দিয়েই রায়ের বাজার বস্তি, মার্কেট, আবাসন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। কোনো দিবস আসলে তার লাঠিয়াল বাহিনী এসব বস্তি প্রতি ১০/১৫টি গরু বরাদ্দ দেন তিনি। আর এই বস্তির লোক হাতে রেখে তাদের দিয়েই নিজের ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। এই এলাকার কাউন্সিলর হোক আর আওয়ামী লীগ নেতা সবই তার লোক। তার ইশারা ছাড়া কারও কিছু করার সাহস নেই। তিনি বলেন, এখন আওয়ামী লীগ নেই। এদিকে সাদেক খানের কথার বাইরে গেলেই নির্যাতনের শিকার হতে হয় বলে জানিয়েছেন রায়ের বাজার বুদ্ধিজীবী বস্তির বাসিন্দা নাসরিন। তিনি বলেন, এখানে সরকারের থেকে নতুন পাকাঘর করা হবে বলে আমাদের সকলের ঘর ভেঙে দেয়া হয়। অনেকে নিজের ঘর নিজেই ভেঙে নেই। কিন্তু বছরের পর বছর পার হলেও এখনো পাকা ঘরের মুখ দেখিনি। এ বিষয়ে কারোর কথা বলারও সাহস নেই। কথা বললেই তাকে এলাকা ছাড়া করা হবে।

সাদেক খানের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানের বিষয়ে দুদকের সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন বলেন, আমাদের একটি গোয়েন্দা উইং রয়েছে। তারা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক আগে থেকেই তারা সাবেক এমপি সাদেক খানের বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। তারা অনেক তথ্য প্রমাণও পেয়েছেন। সেই প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতেই সাদেক খানের বিরুদ্ধে আমাদের অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।

প্রসঙ্গত, সরকার পতনের পর গত ২৪শে আগস্ট রাজধানীর পশ্চিম নাখালপাড়া এলাকা থেকে পুলিশের হাতে আটক হন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও ঢাকা-১৩ আসনের সাবেক এমপি সাদেক খান। পরে তাকে ছাত্র আন্দোলনের সময় নিহত ট্রাকচালক মো. সুজন (২৪) হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.