ক্যাম্পাসে নৃশংসতায় কারা? সাবেক ছাত্রলীগ নেতাসহ ৪ জন আটক

পর পর দু’টি ঘটনা। দু’টিই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। দু’জনকে পিটিয়ে বর্বর কায়দায় হত্যা করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতাকে। এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তোলপাড় চলছে দেশ জুড়ে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কাঠগড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। যদিও দু’টি ঘটনায় দ্রুতই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ ও দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের নেতারা। এ ছাড়া বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনও ঘটনা দু’টির প্রতিবাদ এবং দায়ীদের বিচার দাবি করেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন আইন কারও হাতে তুলে নেয়ার সুযোগ নেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর আইন বিচার, সংসদ বিষয়ক এবং প্রবাসী কল্যাণ ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, বিচারবিহর্ভূত কোনো হত্যাকাণ্ড গ্রহণযোগ্য হবে না। যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হলটির শিক্ষার্থীদের মধ্যে আন্তঃবিভাগ খেলা চলছিল। বুধবার ক্রিকেট খেলার সময় একটি ব্যাগে থাকা ৬টি মোবাইল হারিয়ে যায়। এ নিয়ে দিনভর উত্তপ্ত ছিল হলের পরিবেশ। হলের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের সতর্ক করে দেন শিক্ষার্থীরা। এরপর রাত ৮টার দিকে ফুটবল খেলা চলছিল। সে সময় বহিরাগত তোফাজ্জল হলের ভেতরে ঘোরাফেরা করছিলেন। এ দেখে শিক্ষার্থীদের সন্দেহ হয়। তিনি বিভিন্ন জায়গায় হাঁটাচলা করতে থাকেন। তার বেশভূষা দেখে সন্দেহ হয় প্রথম বর্ষের কিছু শিক্ষার্থীর। তারা একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা রুমে নিয়ে ফোনের বিষয়ে জানতে চাই, সার্চ করি। কিজন্য এসেছে এখানে সেটাও জানতে চাই। তিনি অযাচিত কথা বলছিলেন। আমরা ভেবেছিলাম নেশাগ্রস্ত। তাকে হালকা চড় থাপ্পড় দেয়া হয়। তাকে মারলেও খুব একটা রিঅ্যাকশন দেখাতো না। নাম্বার চাইলে পরিবারের কয়েকজনের নাম্বার মুখস্ত বলেন তিনি। সেই নম্বরে কল দিয়ে জানতে পারি মানসিক ভারসাম্যহীন। একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, একটা পর্যায়ে তোফাজ্জল বলতে শুরু করেন খিদা লাগছে ভাত খাবো। তখন তাকে ক্যান্টিনে নিয়ে যাওয়া হয়।
ক্যান্টিনে নিয়ে যাওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছিলেন আসিফ হাসান। তিনি বলেন, ক্যান্টিনে নিয়ে তাকে খেতে দিতে বলি। এরপর মুরগি ও সবজি দিতে বলি। তিনি এমনভাবে খাচ্ছিলেন দেখে মনে হচ্ছিল না খুব একটা ক্ষুধার্থ। এরপর নিজের থেকে মাছ খেতে চায়। তার জন্য শোল মাছ অর্ডার করা হয়। খাওয়ার সময় খুব নিশ্চিত মনে কথা না বলে খাচ্ছিলেন। তাকে যে চুরির দায় দেয়া হচ্ছে এনিয়ে কোনো চিন্তাই যেন নেই তার। সুন্দরমতো ভাত খেলেন।
প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, খাওয়া শেষে চুপ করে চেয়েছিলেন তোফাজ্জল। এই খাওয়ার সময়েই হলের নিজস্ব গ্রুপে ছড়িয়ে পড়ে মোবাইল চোর ধরা পড়েছে। ততক্ষণে ক্যান্টিনে বড় ভাইয়েরা চলে আসে। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হলের আরেকটি কক্ষে। এরপর সেখানে ২৫ থেকে ৩০ জন শিক্ষার্থী ছিলেন। আর প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা রুমের বাইরে ছিলেন। মারার সময় খুব বারবার চুরি করেনি বলে মাপ চেয়েছিল। আর নির্যাতন করার সময় খুব একটা চিৎকার, কান্না না করায় আরও বেশি মারা হয়েছে। তিনি বলেন, একপর্যায়ে তার হাতের উপর লাঠি রেখে দুপাশে কয়েকজন করে দাঁড়িয়ে নির্যাতন করে। হাতের ও পায়ের আঙ্গুলগুলো থেতলে যেতে থাকে। বারবার বলা হচ্ছিল- বল তুই চুরি করেছিস? ফোনগুলো কোথায়? তিনি বারবার বলছিলেন- আমি মোবাইল চুরি করি নাই।
আরেক শিক্ষার্থী বলেন, মারধরের সময় পরিবারের বেশ কয়েকজনের ফোন নম্বর দিয়েছিলেন। ধারাবাহিক নির্যাতনের মধ্যেই হত্যাকাণ্ডে জড়িত শিক্ষার্থীরা কথা বলেন তার মামার সঙ্গে। তার মাধ্যমে মানসিক ভারসাম্যহীন জানার পরেও তাকে ছাড়েননি অভিযুক্ত শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম, সিনিয়র শিক্ষার্থীরা তাদের নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে জানান, তোফাজ্জলকে সবচেয়ে বেশি মারধর করেছেন ছাত্রলীগের সদ্য পদত্যাগ করা উপ-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক ও পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জালাল আহমেদ, মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সুমন, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের ফিরোজ, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের আব্দুস সামাদ, ফার্মেসি বিভাগের মোহাম্মদ ইয়ামুজ জামান এবং পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনিস্টিউটের মোত্তাকিন সাকিন। নির্যাতন করা শিক্ষার্থীদের সবাই ফজলুল হক মুসলিম হলের শিক্ষার্থী।
প্রাণীবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী সুলতান প্রথমে চোর সন্দেহে তাকে ধরে গেস্টরুমে নিয়ে আসেন। সূত্রটির তথ্যমতে, মারধরে জড়িত ছিলেন- মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ বিভাগের রাশেদ কামাল অনিক, গণিত বিভাগের রাব্বি এবং সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের ওয়াজিবুল। তারা সবাই ওই হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
হলের প্রত্যক্ষদর্শী একজন শিক্ষার্থী ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, আমি হল গ্রুপে ৮টার সময় দেখি হলে চোর ধরা পড়েছে। হলের গেস্ট রুমে, গিয়ে দেখি চোর বসা। রুমে তখন প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা ছিলেন। গেস্টরুমে তাকে বেশি মারা হয়নি। ওখানে হালকা মারার পরে ক্যান্টিনে নিয়ে আসে খাওয়ানোর জন্য। তারপর শুনি তাকে এক্সটেনশন বিল্ডিং’র গেস্টরুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি তখন ওখানে গিয়ে দেখি ২০-২১, ২১-২২ ও ২২-২৩ সেশনের ব্যাচ। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ জন। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা ছিল, ওরা মারে নাই। ২০-২১ আর ২১-২২ সেশনের ওরা খুব বেশি মেরেছে। নির্যাতনের একপর্যায়ে তার মামাকে ফোন দিয়ে জানানো হয় ৩৫ হাজার টাকা পাঠাতে। তার মামা অপারগতা শিকার করলে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন পেটানোর নেতৃত্ব দেয়া তিন চারজন। তারা বলেন, ও নাকি মানসিক ভারসাম্যহীন। তাহলে এতগুলো নম্বর মুখস্ত থাকে কীভাবে। আবার আরেকটি ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে শোনা যায় দুই লাখ টাকা দাবি করা হয়েছিল।
তিনি আরও জানান, দুই-তিনজন মিলেই ওরে ওখানে মেরে ফেলছে। এরা হলেন- মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের ২০-২১ সেশনের মোহাম্মদ সুমন, ওয়াজিবুল, ফিরোজ ও জালাল। এদের মধ্যে সুমন, ফিরোজ এবং জালাল সবচেয়ে বেশি মেরেছে। গেস্টরুমে হাত বেঁধেছে জালাল। সুমন চোখ বন্ধ করে মেরেছে, মারতে মারতে পড়ে যায়। এরপরে পানি এনে তাকে পানি খাওয়ানো হলে সে উঠে বসে। এরপর আবার শুরু হয় পেটানো। এই দফায়ও সবচেয়ে বেশি মেরেছে ফিরোজ। পরে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ১৮-১৯ সেশনের জালাল আসে। জালাল এসে আরও মারতে উৎসাহ দেয়। বলে ‘মার, ইচ্ছামতো মার; মাইরা ফেলিস না একবারে’। এ সময় গ্যাস লাইট দিয়ে পায়ে আগুনও ধরিয়ে দেয়। পরে সুমন এসে তোফাজ্জলের ভ্রু ও চুল কেটে দেয়।
ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, পরে ওখানে স্যার (হলের আবাসিক শিক্ষক) আসেন। আমি ওদেরকে অনেক ফেরানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু ওরা মানেনি। এক্সটেনশন বিল্ডিং এর গেস্টরুম থেকে যখন তাকে বের করা হয় তখন স্যার এসে পড়েছেন। মারধরে তোফাজ্জলের ডান হাত এবং বাম পায়ের মাংসের কিছুটা অংশ খুলে পড়ে যায়। অনেকে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। আমি বলি কাপড় আনো, ওর পা বেঁধে দেই। কারণ ব্লিডিং হইলে তো সেন্সলেস হয়ে যাবে। পরে কাপড় এনে একটা জুনিয়র পা বেঁধে দেয়।
একপর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে শিক্ষার্থীরাই ঢাকা মেডিকেলে কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এর পরপরই লাশ রেখে শিক্ষার্থীরা হাসপাতাল থেকে যে যার মতো চলে যান।
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জালাল অভিযোগের বিষয়ে বলেন, আমি স্যারের সঙ্গে ছিলাম। প্রথম ও দ্বিতীয় টার্মে পেটানোর বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। তৃতীয় টার্মে যখন যাই একটা স্টাম্প টেনে নেই। কিন্তু ভিডিওতে মনে হচ্ছে আমি পিটাইছি। আমি যদি পেটাতাম তাহলে আমি পালিয়ে যেতাম, ইন্টারভিউও দিতাম না।
জানা যায়, তোফাজ্জল হোসেন, বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলী ইউনিয়নের বাসিন্দা। সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা-মা হারিয়েছেন আট বছর আগে। পরে প্রেমসংক্রান্ত বিষয়ে আঘাত পেয়ে হয়ে পড়েছিলেন মানসিক ভারসাম্যহীন। পুরো ঘটনা কয়েক ঘণ্টাব্যাপী চললেও ঘটনাস্থলে যাননি হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক শাহ মোহাম্মদ মাসুম। তাকে বারবার ফোন দিয়েও ঘটনার সময় পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরও প্রভোস্টকে ফোনে পাননি। যদিও রাতে ‘ঘুমিয়েছিলেন’ বলে  সকালে গণমাধ্যমকর্মীদের জানান। সদ্য নিয়োগ পাওয়া প্রভোস্টের নির্লিপ্ততার সমালোচনা করছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। তিনি প্রথমেই শক্তভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করলে এমন মর্মান্তিক ঘটনা এড়ানো যেতো বলে তাদের অভিমত।
এই ঘটনায় মধ্যরাতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বিক্ষোভ মিছিল করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ঘটনার বিচার চেয়ে মিছিল, প্রতিবাদ ও স্লোগান ও সমাবেশে গতকাল সারা দিন উত্তাল ছিল ঢাবি। এ ঘটনায় গতকাল সকাল থেকে তৎপর ছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলেন- মো. জালাল মিয়া, সুমন মিয়া, মো. মোত্তাকিন সাকিন, আল হুসাইন সাজ্জাদ ও আহসানউল্লাহ। জালাল মিয়া হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপ-সম্পাদক। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে তিনি ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে সক্রিয় ছিলেন।
ঢাবি প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, তোফাজ্জল হোসেনের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা করে ঢাবি প্রশাসন। মামলায় অজ্ঞাতদের আসামি করা হয়েছে। শাহবাগ থানার ওসি শাহাবুদ্দিন শাহীন মামলা দায়েরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ আটক ও মামলার বিষয় নিশ্চিত করে বলেন, ভুক্তভোগীর ন্যায়বিচার নিশ্চিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তদন্তে পূর্ণ সহযোগিতা করছে।
যা ঘটেছিল জাহাঙ্গীরনগরে: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ই জুলাই রাতে ভিসি’র বাসভবনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে শাখা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেন শিক্ষার্থীরা। পরে তিনি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
বুধবার বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। গণধোলাইয়ের পর তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির হাতে তুলে দেয় শিক্ষার্থীরা। সেখানে তালা ভেঙে তাকে মারধর করা হয়। পরে তাকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেট সংলগ্ন একটি দোকানে অবস্থান করছিলেন শামীম মোল্লা। তার অবস্থানের খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী সেখানে গিয়ে তাকে আটক করে গণধোলাই দেয়। পরে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম উপস্থিত হয়। একপর্যায়ে নিরাপত্তাকর্মীদের সহায়তায় তাকে নিরাপত্তা শাখায় নিয়ে আসা হয়। সেখানেও ছাত্রদলের একটি টিম কেচিগেইটের তালা ভেঙে তাকে বেধড়ক মারধর করে। ফলে শামীম মোল্লা মারা যেতে পারে বলে ধারণা করছে সংশ্লিষ্টরা।
এ ঘটনায় একটি ভিডিও থেকে প্রাথমিকভাবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কয়েকজনকে শনাক্ত করা গেছে। তারা হলেন- সাঈদ হোসেন ভূঁইয়া, রাজু আহমেদ এবং রাজন হাসান, হামিদুল্লাহ সালমান এবং এমএন সোহাগ, ইংরেজি বিভাগের ৫০ ব্যাচের মাহমুদুল হাসান রায়হান, ইতিহাস বিভাগের ৪২ ব্যাচের জোবায়ের।
তবে প্রান্তিক গেইটের ঘটনায় আহসান লাবিব ও আতিক নামে দু’জন জড়িত। তবে তারা নিরাপত্তা শাখায় শামীম মোল্লাকে তুলে দেয়। পরে একদল ছাত্রদলকর্মী তালা ভেঙে তাকে মারধর করেন। সাঈদ হোসেন ভূঁইয়া ৩৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। এছাড়া রাজু আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও রাজন হাসান ৪৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী, হামিদুল্লাহ সালমান ইংরেজি ৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও এমএন সোহাগ কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। নিরাপত্তা কার্যালয়ের ভেতরে চেক শার্ট পরিহিত অবস্থায় শামীমকে পেটায় আরেকজন। এ সময় তার হাতে গাছের ডাল দেখা গেছে। এ দিয়েই পিটিয়েছেন তিনি। তাকে রাজু আহমেদ বলে শনাক্ত করা গেছে।
মারধরের সম্পৃক্ততার বিষয়ে সাঈদ বলেন, কেউই হত্যার উদ্দেশ্যে তাকে মারধর করেনি। একজন সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে আমি দেখতে গিয়েছিলাম। আর একজন মানুষ যিনি হেঁটে পুলিশের গাড়িতে গেছে আর কিছুক্ষণের মধ্যে মারা গেছেন এর রহস্য উদ্‌ঘাটন করা জরুরি।
এ বিষয়ে রাজু আহমেদ বলেন, আমি সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে শোনার পর সেখানে গেছিলাম। সেখানে গিয়ে আমি শামীমকে ধমক দিই, তাকে মারধর করিনি। রাজন হাসান বলেন, আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম কিন্তু মারার জন্য সেখানে যায়নি। যারা তালা ভাঙার চেষ্টা করছিল তাদের আমি নিষেধ করেছিলাম। হামিদুল্লাহ সালমান বলেন, আমি সন্ধ্যায় হলে ছিলাম। পরে খবর পেয়ে প্রক্টর অফিসে যাই কিন্তু শামীম মোল্লাকে মারধর করিনি। সোহাগ বলেন, আমি টিউশন থেকে ফেরার পথে হইচই দেখে সেখানে গিয়েছিলাম কিন্তু মারধর করিনি।
শিক্ষার্থীরা জানায়, শামীম মোল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের জুয়েল-চঞ্চল কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক। শামীম বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশেপাশের এলাকায় মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, জমিদখল, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত। এছাড়া তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও রয়েছে। গত ১৫ই জুলাই রাতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় সে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে।
এ ঘটনার পর প্রক্টরিয়াল টিমের খবরে আশুলিয়া থানা পুলিশের একটি দল নিরাপত্তা শাখায় আসে। এ সময় পুলিশ ও প্রক্টরিয়াল টিম শামীমকে ১৫ই জুলাই রাতে ভিসি’র বাসভবনে হামলার ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এ সময় শামীম মোল্লা হামলার ঘটনায় নিজের অংশগ্রহণ ও ঘটনাস্থলে হামলাকারীদের সঙ্গে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষক মেহেদী ইকবাল উপস্থিত থাকার কথা স্বীকার করে।
শামীম মোল্লা জানান, ১৫ই জুলাই রাতে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা এলাকা থেকে হামলা করতে নিয়ে যাওয়া হয়। তারেক ও মিজান নামে সাবেক দুই ছাত্রলীগ নেতা তাকে বঙ্গবন্ধু হলে নিয়ে যায়। সেখানে ছাত্রলীগ সভাপতি সোহেলের নেতৃত্বে পেট্রোল বোমা তৈরি করা হচ্ছিল এবং হামলার জন্য দেশীয় ও আগ্নেয়াস্ত্র প্রস্তুত করা হচ্ছিল। প্রস্তুতি শেষে ভিসি’র বাসভবনে হামলা করতে যাওয়া হয়। হামলার সময় তারেক এক রাউন্ড গুলি ছোড়ে বলে জানায়।
এদিকে, সন্ধ্যা ৭টায় প্রক্টর অফিসে আসেন ভিসি অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান। তিনি উত্তেজিত শিক্ষার্থীদের শান্ত করার চেষ্টা করেন ও আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তার শাস্তি নিশ্চিতের আশ্বাস দেন। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক একেএম রাশিদুল আলম বলেন, ১৫ই জুলাই ভিসি’র বাসভবনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগে সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতাকে শিক্ষার্থীরা আটক করে প্রক্টরিয়াল বডির হাতে তুলে দেয়। আমরা আশুলিয়া থানায় অবহিত করলে পুলিশের একটি টিম আসে। ওই ছাত্রলীগ নেতার নামে আগেও বেশ কয়েকটি মামলা আছে। তাকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়েছে।
তবে তিনি গণধোলাইয়ে মৃত্যুর বিষয়টিকে অস্বাভাবিক উল্লেখ করে বলেন, তাকে শিক্ষার্থীরা আটকের পর মারধর করে প্রক্টরিয়াল বডির হাতে তুলে দেয়। পরে আমরা আশুলিয়া থানায় অবহিত করলে পুলিশের একটি টিম এসে তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। এরপর পুলিশে সোপর্দ করলে তিনি নিজে হেঁটে পুলিশের গাড়িতে ওঠেন। তখন তাকে দেখে আশঙ্কাজনক মনে হয়নি। পরবর্তীতে পুলিশের গাড়িতে মৃত্যুর বিষয়টি অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। বিষয়টি ভালোভাবে না জেনে মন্তব্য করতে পারছি না। 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.