অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অধ্যাদেশ অনুমোদন: ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে সংস্কারের সুপারিশ দেবে কমিশন

‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অধ্যাদেশ, ২০২৪’ এর নীতিগত সিদ্ধান্ত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এ ছাড়াও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা এবং সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা, ২০২৪-এর খসড়ার অনুমোদনও দেয়া হয়। গতকাল উপদেষ্টা পরিষদের এক বৈঠকে এ অনুমোদন দেয়া হয়। অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ছয় সংস্কার কমিশনের প্রধানরা। বৈঠকে পহেলা অক্টোবর থেকে সংস্কার কমিশনের কাজ শুরু করা ও ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে সংস্কার প্রস্তাবের সুপারিশ রিপোর্ট আকারে সরকারের কাছে উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। রিপোর্টটি জনসাধারণের জন্যও উন্মুক্ত থাকবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক শেষে ফরেন সার্ভিস একাডেমি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এমনটাই  জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা প্রফেসর ড. আসিফ নজরুল। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সরকার ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অধ্যাদেশ, ২০২৪’ এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। এতে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক ব্যাপক দমনপীড়ন ও গণহত্যা চালানোর ফলে পুরো দেশে দলমত নির্বিশেষে ছাত্র-জনতা উত্তাল গণবিক্ষোভ করে। আন্দোলনের একপর্যায়ে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচারের দাবিতে সরকার পতনের একদফা দাবিতে ঐক্যবদ্ধ ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গত ৫ই আগস্ট প্রেসিডেন্টের কাছে পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করেন। প্রেসিডেন্ট গত ৬ই আগস্ট দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক সংকট মোকাবিলা, জনস্বার্থ ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রক্ষা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সচল রাখা এবং রাষ্ট্রের নির্বাহী কার্যপরিচালনার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন বিষয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট সুপ্রিম কোর্টের মতামত চান। সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে দেয়া উপদেষ্টামূলক এখতিয়ার প্রয়োগ করে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ৮ই আগস্ট মতামত প্রদান করেছেন যে, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণে জরুরি প্রয়োজনে প্রসিডেন্ট রাষ্ট্রের নির্বাহী কার্যপরিচালনার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্য উপদেষ্টা নিযুক্ত করতে পারবেন। প্রেসিডেন্ট এভাবে নিযুক্ত প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্য উপদেষ্টাদের শপথ পাঠ করাতে পারবেন। এতে আরও বলা হয়, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ডকট্রিন অব নেসেসিটি অনুসারে সাংবিধানিক সংকট মোকাবিলায় সর্বস্তরের জনগণের ঐকান্তিক ইচ্ছা ও পরম অভিপ্রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে, গণঅভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতার প্রতিনিধিদের প্রস্তাবের ভিত্তিতে এবং ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের রাষ্ট্র সংস্কার আকাঙ্ক্ষা পূরণের ও রাষ্ট্রের নির্বাহী কার্যপরিচালনার জন্য রাষ্ট্রপতি ৮ই আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেন। গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্ষমতা ও দায়িত্ব, প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টাদের পদমর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা, পদত্যাগ এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ে বিধান করা জরুরি। এই প্রেক্ষাপটে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অধ্যাদেশ, ২০২৪’ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। অন্যদিকে বৈঠকে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা এবং সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা, ২০২৪’ এর খসড়ার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা এবং সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালার খসড়া প্রণয়ন করে উপদেষ্টা পরিষদ বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা এবং সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ যারা সরকার বা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত, তারা প্রতি বছর আয়কর জমা দেয়ার সর্বশেষ তারিখের পরবর্তী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে নীতিমালায় সংযুক্ত ছকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী জমা দেবেন। এ বিধান রেখে খসড়া আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা উপদেষ্টা পরিষদ বৈঠকে অনুমোদিত হয় বলে জানিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এরই মধ্যে সরকারি সব কর্মচারীর সম্পদের হিসাব দিতে হবে বলে জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এজন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি কাজ করছে।

সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ৬টি প্রস্তাবিত কমিশনের প্রধানদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক হয়েছে। যেখানে উপদেষ্টাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আসিফ নজরুল, আলী ইমাম মজুমদার, ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং আদিলুর রহমান। এ ছাড়াও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, আমরা প্রধানত আলোচনা করেছি সংস্কার ভাবনা, সংস্কার কমিশনগুলো কীভাবে কাজ করতে চায়, সদস্য বাছাই প্রক্রিয়া কী হবে, কবে নাগাদ সংস্কার রিপোর্ট দেয়া হবে, রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনের সম্পর্ক কী হবে- এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আইন উপদেষ্টা বলেন, ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয় যে কমিটি পহেলা অক্টোবর থেকে কাজ শুরু করবে আর ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে সংস্কার রিপোর্ট প্রদান করবে। এটি হচ্ছে প্রথম ধাপ। রিপোর্টের ভিত্তিতে দ্বিতীয় ধাপে আমাদের প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে উপদেষ্টারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংস্কার ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুরু করবেন। এরপর সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্বে এটা নিয়ে বিশদাকারে কনসালটেশন হবে। সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট পাওয়ার পর সেগুলো অনলাইনে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। সবার মতামতকে গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করা হবে। তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার বিপ্লবের প্রত্যাশা কেবল নির্বাচনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। সেটা ছিল রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্ন এবং প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। এবং বাংলাদেশে যেন কোনোভাবেই আর কোনোদিন ফ্যাসিবাদী শাসন জেঁকে বসতে না পারে সে সম্ভাবনা রোধ করার লক্ষ্যে কী কী সংস্কার করা প্রয়োজন সে ধরনের চিন্তা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যদিয়ে প্রতিফলিত হয়েছিল। সেটার লক্ষ্যে এ সংস্কার কমিশনগুলো প্রাথমিক স্তরে কাজ শুরু করেছে।
এ সময় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেন, সংস্কার কমিশনগুলো গঠনের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন ফ্যাসিবাদী শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট ছিল সেখান থেকে মুক্তি দেয়া। এখানে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্যদিয়ে সবার অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয় যেমন আছে। তেমনই তার আগে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকারের কাছে একটা দায়িত্ব আছে। সেটি হচ্ছে যে, প্রতিষ্ঠানগুলো গত ১৫ বছরে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে যেগুলো জনগণের স্বার্থে কাজ করতে পারছে না সেগুলোকে ঢেলে সাজানো। যার উদ্দেশ্যে সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। কমিশন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করবে। এ কমিশনগুলো আগামী তিন মাসের মধ্যে তাদের প্রস্তাবনা উপস্থাপন করবে। সেটার ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। জনগণের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে এ কমিশনগুলো কাজ করবে। তারা যথেষ্ট রকম স্বাধীন থাকবে। কোনো রকম রাজনৈতিক চাপ যেন না থাকে সে বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়াও তাদের কার্যপরিধি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। শিগগিরই জানানো হবে কোন কোন ক্ষেত্রগুলোতে তারা কাজ করবেন এবং কারা কারা এ কমিশনগুলোতে থাকবেন।
নির্বাচন কমিশন বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমরা কর্তৃত্ববাদী সরকারের অধীনে ছিলাম। বহুক্ষেত্রে আমরা বঞ্চনার মধ্যে ছিলাম। বিশেষ করে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারা। এ বিষয়গুলোর যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে জন্যই কতোগুলো পরিবর্তন আনতে হবে। কার্যপরিধি কী হবে, কীভাবে কাজ করবে, রিপোর্ট কবে নাগাদ দিতে হবে, কী কী বিষয় থাকতে হবে- এসব বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।
এদিকে এক প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, কোনোরকম মব জাস্টিস, আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া, গণপিটুনি দেয়ার মতো ঘটনা গ্রহণ করা হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নিহতের ঘটনায় খুবই মর্মাহত আমরা। এটা আমাদের খুবই কষ্ট দিয়েছে। ইতিমধ্যে ব্যবস্থা নিয়েছি। তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা এড়ানোর জন্য আমরা যত রকমের পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন, তত রকম পদক্ষেপ নেবো। তিনি বলেন, বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যাকাণ্ড একসেপ্ট করা হবে না। আমরা একটা জিনিস নিশ্চিত করছি, আমাদের সরকার আইনিভাবে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেবে। তদন্ত ও বিচার সাপেক্ষে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.