হ্যারোডসের নারী কর্মীদের ওপর যৌন নিপীড়ন চালাতেন মালিক আল ফায়েদ
‘আল ফায়েদ: হ্যারোডসের শিকারি’ শিরোনামে সম্প্রতি একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রকাশিত হয়। তাতে তুলে ধরা হয়, হ্যারোডসের নারী কর্মীদের ওপর মালিক আল ফায়েদের যৌন নিপীড়নের নানা তথ্যপ্রমাণ। হ্যারোডসের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সে সময় ফায়েদের এসব কর্মকাণ্ডে কোনো হস্তক্ষেপ নেয়নি। বরং অভিযোগগুলো ধামাচাপা দেওয়ায় ভূমিকা রেখেছিল।
প্রামাণ্যচিত্রটি প্রকাশের পর থেকে হ্যারোডসের আরও অনেক সাবেক কর্মী বিবিসির সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। আল ফায়েদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন তাঁরা। এমন ২০ নারী বিবিসিকে জানিয়েছেন, তাঁরা আল ফায়েদের হাতে যৌন নিপীড়ন বা ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন।
যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের এসব ঘটনা ঘটেছে যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডন, ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস ও সেন্ট ত্রোপেজ এলাকা এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবি শহরে। ভুক্তভোগী এই নারীদের হয়ে কাজ করা আইনজীবী ব্রুস ড্রামমন্ডের ভাষ্য, হ্যারোডসের ভেতরে দুর্নীতি ও নিপীড়নের যে জাল বোনা হয়েছিল, তা ছিল অবিশ্বাস্য ও খুবই অন্ধকার।
ভুক্তভোগী এমনই এক নারী হ্যারোডসের ‘অন্ধকার’ জগতের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, লন্ডনের পার্ক লেনের একটি বাসায় তাঁকে ধর্ষণ করেছিলেন আল ফায়েদ। এতে তাঁর কোনো সম্মতি ছিল না। সেটা ফায়েদকেও জানিয়েছিলেন। তবে কোনো কাজ হয়নি।
লন্ডনের মেফেয়ার এলাকার আরেক নারীও আল ফায়েদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনেছেন। ঘটনার সময় তিনি ছিলেন একজন কিশোরী। ওই নারী বলেন, মোহামেদ আল ফায়েদ একজন রাক্ষসের মতো ছিলেন। তিনি একজন যৌন নিপীড়নকারী। তাঁর মধ্যে কোনো নৈতিকতা ছিল না। হ্যারোডসের সব কর্মী তাঁর কাছে ‘খেলনার’ মতো ছিলেন।
ফেরিওয়ালা থেকে ধনকুবের
মোহামেদ আল ফায়েদের জীবনের শুরুর দিকটা অতটাও সহজ ছিল না। তাঁর পেশাজীবন শুরু হয়েছিল মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ার রাস্তায়। পথচারীদের কাছে পানীয় ফেরি করে বিক্রি করতেন তিনি। পরে সৌদি আরবের একজন ধনী অস্ত্র ব্যবসায়ীর বোনকে বিয়ে করেন তিনি। তারপর নতুন দুনিয়ায় পা রাখেন ফায়েদ। ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য।
১৯৭৪ সালে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান আল ফায়েদ। ১৯৮৫ সালে যখন হ্যারোডস কিনে নেন, তত দিনে তিনি পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন। গত শতকের নব্বইয়ের দশক ও চলতি শতকের শুরুর দশকে বিভিন্ন টেলিভিশন টক শো ও বিনোদন অনুষ্ঠানে নিয়মিত দেখা যেত তাঁকে।
মোহামেদ আল ফায়েদের আরেকটি পরিচয় রয়েছে। তিনি দোদি ফায়েদের বাবা। ১৯৯৭ সালে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় দোদি ও প্রিন্সেস অব ওয়েলস ডায়ানা নিহত হন। সে সময় দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কের গুঞ্জন উঠেছিল। এ নিয়ে ‘দ্য ক্রাউন’ নামে নেটফ্লিক্সে সম্প্রতি একটি ধারাবাহিক প্রচারিত হয়েছে। ফলে নতুন প্রজন্মের কাছেও ডায়ানা-দোদি বেশ পরিচিত।
যাহোক, হ্যারোডস কিনে নেওয়ার পর নিয়মিত দোকানটির পণ্য বিক্রির সুবিশাল কক্ষগুলো পরিদর্শনে যেতেন আল ফায়েদ। প্রতিষ্ঠানটির সাবেক কর্মীরা বিবিসিকে জানিয়েছেন, এই পরিদর্শনের সময় কোনো তরুণী কর্মীকে চোখে লাগলে পদোন্নতি দিয়ে ওপরের তলায় নিজের অফিসে কাজ দিতেন তিনি।
তারপর ওই কর্মীর ওপর নিপীড়ন চালানো হতো। কখনো তা করা হতো হ্যারোডসের অফিসে, কখনো আল ফায়েদের লন্ডনের বাসায়, কখনো আবার বিদেশ সফরে গিয়ে। বিদেশে আল ফায়েদের নিপীড়নের কথা বলতে গেলে আসে প্যারিসের রিৎজ হোটেলের কথা। ওই হোটেলেরও মালিক তিনি। এ ছাড়া কাছেই তাঁর উইন্ডসোর ভিলাতেও চলত যৌন নিপীড়ন।
আল ফায়েদের নিপীড়নের বিষয়টি হ্যারোডসের সাবেক কর্মীরাও জানতেন। যেমন অ্যালিস (ছদ্মনাম) নামের এক কর্মী বলেন, ‘আমরা একে অপরের দিকে তাকাতাম আর ভাবতাম, “তুমি এক অভাগা মেয়ে। আজকের শিকার তুমি।” আর এটা থামাতে না পারার জন্য নিজেদের খুবই দুর্বল মনে হতো।’
‘তিনি আমাকে ধর্ষণ করেন’
নব্বইয়ের দশকে আল ফায়েদের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করতেন র্যাচেল (ছদ্মনাম)। একদিন রাতে তাঁকে লন্ডনের পার্ক লেনে ফায়েদের বাসায় ডাকা হয়। সেখানে যাওয়ার পর নিজের বিছানায় তাঁকে বসান ফায়েদ। তাঁর পায়ে হাত রাখেন। তখন র্যাচেল বুঝতে পারেন, কী হতে চলেছে। তিনি বলেন, ‘তিনি আমাকে ধর্ষণ করেন।’
এই পার্ক লেনের বাসায় আল ফায়েদের যৌন নিপীড়নের শিকার ১৩ নারীর সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি। তাঁদের মধ্যে র্যাচেলসহ চারজন ধর্ষণের অভিযোগ এনেছেন। যেমন সোফিয়া। তিনি বলেন, ‘এর (নিপীড়নের) বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না আমার। আমার কোনো পরিবার ছিল না। জানতাম, এর মধ্য দিয়েই আমাকে যেতে হবে। তবে এমনটা হোক তা চাইতাম না।’
গিমা নামের আরেক নারী ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত আল ফায়েদের ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন। তিনি জানান, বিদেশ সফরে গিয়ে ফায়েদের আচরণ আরও ভয়ংকর হয়ে উঠত। প্যারিসের উইন্ডসোর ভিলায় তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। তাঁর (গিমা) শোবার কক্ষে ঢুকেই ধর্ষণ করেছিলেন ফায়েদ। এরপর ডেটল দিয়ে শরীর ধুয়ে ফেলতে বলেছিলেন। কারণ, তিনি কোনো প্রমাণ রাখতে চাননি।
এ ছাড়া প্যারিসে আল ফায়েদের মালিকানাধীন বিভিন্ন সম্পত্তিতে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার কথা বিবিসিকে জানিয়েছেন আরও আট নারী। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন এই নিপীড়নকে ‘ধর্ষণের চেষ্টা’ আখ্যায়িত করেছেন।
আল ফায়েদের এই কর্মকাণ্ডের বিষয়টি জানলেও মুখ খুলতেন না হ্যারোডসের অনেক কর্মী। যেমন টনি লেমিং। ১৯৯৪ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত হ্যারোডসের ডিপার্টমেন্টাল ম্যানেজার ছিলেন তিনি। লেমিং বলেন, নারী নিপীড়নের যেসব ঘটনা হ্যারোডসের ভেতরেই ঘটেছিল, সেগুলো সম্পর্কে তিনি জানতেন। এটা গোপন কিছু ছিল না। নিপীড়নের বিষয়টি সবাই জানতেন।
লেমিংয়ের মতোই সোজাসাপটা স্বীকারোক্তি দিয়েছেন আল ফায়েদের নিরাপত্তারক্ষী দলের সাবেক সদস্যরাও। ১৯৭৯ সালে হ্যারোডসে নিরাপত্তা রক্ষার কাজে যোগ দিয়েছিলেন ইমন কোইলি। পরে ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত নিরাপত্তা দলের উপপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। কোইলি বলেন, ‘আমরা জানতাম যে তরুণীদের প্রতি তাঁর (ফায়েদ) তুমুল আগ্রহ ছিল।’
ভয়ের সংস্কৃতি
বিবিসির সঙ্গে কথা বলা নারীরা জানিয়েছেন, তাঁরা হ্যারোডসে কাজ করার সময় ভয়ের মধ্যে থাকতেন। এ কারণে আল ফায়েদের বিরুদ্ধে মুখ খোলাটা তাঁদের জন্য কঠিন ছিল। সারাহ (ছদ্মনাম) নামের একজন বলেন, দোকানে একটি ভয়ের সংস্কৃতি চালু ছিল। সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা থেকে একেবারে নিচের স্তরের কর্মীরাও সব সময় ভয়ের মধ্যে থাকতেন।
হ্যারোডসের কর্মীদের ফোনকলে আড়ি পাতা হতো বলেও বিশ্বাস করতেন অনেকে। নারীরা আল ফায়েদের ‘অপকর্ম’ নিয়ে একে অপরের সঙ্গে কথা বলতে ভয় পেতেন। কারণ, তাঁরা মনে করতেন, গোপন ক্যামেরা তাঁদের ওপর সব সময় নজর রাখছে।
হ্যারোডসের সাবেক নিরাপত্তা কর্মকর্তা ইমন কোইলি জানিয়েছেন, কীভাবে তিনি কর্মীদের কল রেকর্ডগুলো খতিয়ে দেখতেন। দোকানজুড়েই নাকি গোপন ক্যামেরা স্থাপন করা ছিল। এমনকি নির্বাহীদের কক্ষেও এ ধরনের ক্যামেরা রাখা ছিল। কোইলি বলেন, মন চাইলেই আল ফায়েদ যে কারও ওপর নজরদারি করতেন।
আল ফায়েদের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিবিসির সঙ্গে কথা বলেছে হ্যারোডসের বর্তমান কর্তৃপক্ষ। এক বিবৃতিতে তারা ওই কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে বলেছে, ১৯৮৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত হ্যারোডসের মালিক ছিলেন আল ফায়েদ। বর্তমান মালিকানায় এটি অনেক ভিন্ন একটি প্রতিষ্ঠান। এখন হ্যারোডস কর্মীদের কল্যাণে কাজ করে।
আল ফায়েদের নিপীড়নের ঘটনাগুলো আগেও সামনে এসেছে। ১৯৯৫ সালে এমনই এক চেষ্টা করেছিল মার্কিন সাময়িকী ‘ভ্যানিটি ফেয়ার’। ফায়েদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদ, কর্মীদের ওপর নজরদারি ও যৌন নিপীড়নের অভিযোগ এনে প্রবন্ধ ছাপিয়েছিল। এ ছাড়া তাঁর যৌন নিপীড়ন নিয়ে ১৯৯৭, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে বেশ কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছিল।
তবে আল ফায়েদের মৃত্যুর পর এই প্রথমবারের মতো ভুক্তভোগী অনেক নারী তাঁর যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সরাসরি কথা বলার সাহস দেখালেন। যেমন ভুক্তভোগী নারী গিমা বলছিলেন, ‘আমি বহু বছর মুখ বন্ধ করে ছিলাম। কোনো কথা বলিনি। আমি মনে করি, এখন এটা নিয়ে কথা বললে কাজে আসবে। আমাদের সবাই এখন দীর্ঘদিনের এই বেদনা থেকে মুক্ত হতে পারব।’
মোহামেদ আল ফায়েদফাইল ছবি: রয়টার্স |
No comments