অবুঝ দুই শিশু খুঁজে বেড়াচ্ছে বাবাকে by শুভ্র দেব

কবির হোসেন (৬০) তার দুই ছেলেকে নিয়ে ঢাকার কাজলা এলাকার একটি বাসায় থাকতেন। নিজে অটো চালাতেন আর দুই ছেলে মো. হাসান ও মো. বাবলু যাত্রাবাড়ীতে সবজির আড়তে দৈনিক মজুরিভিত্তিতে কাজ করতেন। হাসান (৩০) বিবাহিত। তার স্ত্রী, দুই সন্তান ও মা ইয়ানুর বেগম ভোলা জেলার লালমোহন থানা এলাকার গ্রামের বাড়িতে বসবাস করেন। কবির ও তার দুই ছেলের আয়ে মোটামুটি ভালোই চলছিল যৌথ পরিবারটি। কিন্তু ৫ই আগস্ট সরকার পতনের ৪দিন পুলিশের গুলিতে তছনছ হয়ে যায় তাদের পরিবার। ওইদিন যাত্রাবাড়ি এলাকায় ছাত্র-জনতার সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন হাসান। আন্দোলনের একপর্যায়ে পুলিশ তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে। সাতটি গুলি তার শরীরে লাগে। গুলি লাগার পরে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হয়। হাসপাতালে ১৯ দিন তিনি মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। ২৩শে আগস্ট তিনি না ফেরার দেশে চলে যান। বড় ছেলে হাসানকে হারিয়ে বাবা-মা যেমন স্তব্ধ হয়ে আছেন, ঠিক তেমনি তার স্ত্রীও স্বামীর এমন অকালে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছেন না। আর তার সাত বছর ও আড়াই বছর বয়সী অবুঝ সন্তানেরা বাবা মারা যাওয়ার বিষয়টি বুঝতে না পারলেও দিন-রাতের অধিকাংশ সময় তারা বাবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। সারাক্ষণ শুধু তারা বাবা-বাবা বলে ডাকছে।

গতকাল হাসানের বাবা কবির হোসেন ছেলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। মানবজমিনকে বলেন, অনেক বছর ধরেই আমরা ঢাকায় কাজ করি। মাঝেমধ্যে বাড়ি চলে যেতাম আবার এসে কাজ করতাম। আমি কাজলা, যাত্রাবাড়ি, ডেমরাসহ আশপাশের এলাকায় অটোরিকশা চালাতাম। আর দুই ছেলে সবজির আড়তে কাজ করতো। ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আমরা ঘুম থেকে উঠি। তখন দুই ছেলেকেই বলেছি অবস্থা ভালো না। তাই কোথাও বের হওয়ার দরকার নাই। কিছুক্ষণ পর হাসান বাসা থেকে বের হয়ে কাজলা মেইন রোডের দিকে ঘুরে আবার বাসায় আসে। কেন ওদিকে গিয়েছিল জানতে চাইলে বলে, আন্দোলনের কি অবস্থা সেটি খোঁজ নিতে গিয়েছি। তখন আমি তাকে বলেছিলাম শুনেছি আজকে পরিস্থিতি খারাপ হবে। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করতে পারেন। এ ছাড়া সেনাপ্রধান ভাষণও দিবেন। আমার কথা শোনার পর বাসায়ই ছিল। কিন্তু দুপুরের দিকে সে বাসা থেকে বের হয়ে আন্দোলনে চলে যায়। কেউ হয়তো তাকে ফোন দিয়েছিল। ফোন পেয়েই বের হয়ে যায়। দুপুরের খাবার খেয়েছে কিনা সেটাও জানতে পারিনি। সে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পর আমিও কাজলা হয়ে যাত্রাবাড়ির দিকে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি কয়েকটি লাশ নিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ গুলি করেছে। এসব দেখে আমি বিবির বাগিচার দিকে চলে যাই। প্রায় ৪টার দিকে আমার মোবাইলে একটি ফোন আসে। অপরিচিত ব্যক্তি আমাকে বলেন, হাসানের গুলি লেগেছে তাড়াতাড়ি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে আসেন। এ কথা শোনার পর আমার আর হুঁশ ছিল না। কী করবো, না করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। তখন আমার ছোট ছেলে বাবলুকে ফোন দিয়ে বলি তার ভাইয়ের গুলি লেগেছে। তখন সায়েদাবাদ এলাকায় সে আসার পর দুজন মিলে হেঁটে হেঁটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাই। সেখানে যাওয়ার পর ওই অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হয়। তিনি আমাদের ছেলের কাছে নিয়ে যান। আমাদেরকে তিনি বলেছেন, গুলি লাগার পর অনেক সময় মাটিতে পড়েছিল হাসান। কেউ সাহস করে ধরতে আসেনি। পরে আমি তাকে উদ্ধার করতে যাই। পরে আরও অনেকে আসে। ঘটনাস্থলে তার শরীর থেকে চারটি গুলি টেনে বের করা হয়। হাসপাতালে আসার পর চিকিৎসকরা আরও তিনটি গুলি বের করেন। তিনি আমাদেরকে বলেন, তিনি চেষ্টা করেছেন এতক্ষণ। এখন আমরা যাতে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। পরে তিনি আমাদেরকে কিছু টাকা দেন।

কবির বলেন, বিকাল থেকে ভোর পর্যন্ত জরুরি বিভাগেই তার চিকিৎসা চলে। ভোর ৪ টার দিকে তাকে আইসিইউতে নেয়া হয়। চিকিৎসকরা আমাদেরকে জানান, অনেকগুলো গুলি তার শরীরে লেগেছে। শ্বাসনালি, মেরুদণ্ড, মাথা সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৭ দিন আইসিইউতে তাকে রাখা হয়। পরে দেয়া হয় এইচডিইউতে। কিন্তু এইচডিইউতে আনার পরপরই তার শরীর খারাপ হয়ে যায়। তখন আমরা আবার চিকিৎসকদের বিষয়টি জানাই। পরে আবার তাকে আইসিইউতে নেয়া হয়। কিন্তু তাকে আর বাঁচানো যায়নি।

হাসানের বাবা কবির বলেন, ছেলের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে তার মায়ের শারীরিক অবস্থা খারাপ। ছেলেকে তিনি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। সবসময়  ছেলের জন্য মন খারাপ করে থাকেন। রাতে ঘুম হয় না। খাবার খেতে চান না। কিছুতেই তাকে সান্ত্ব্তনা দেয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া হাসানের স্ত্রী মালা বেগম স্বামীর মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না। একদিকে তার নিজের কষ্ট। অন্যদিকে হাসানের দুই সন্তান সারাক্ষণ বাবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। বড় ছেলে হাবিবের বয়স সাত বছর আর ছোট ছেলে হাসিবের বয়স আড়াই বছর। দু’জনই অবুঝ। অনেক কিছু  বোঝার ক্ষমতা নাই। তারা জানেও না, বুঝেও না, তাদের বাবা মারা গেছেন। বড় হয়ে হয়তো একদিন জানতে পারবে তাদের বাবা আন্দোলনে শহীদ হয়েছে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.