হাসিনাকে পালাতে কেন বাধ্য করা হয়েছিল? by ইন্তিফার চৌধুরী
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে কী ঘটছে?
বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরিদের জন্য সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ কোটার বিরুদ্ধে গত মাসে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ শুরু হয়। শিক্ষার্থীরা এই পদ্ধতিটিকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে মনে করে মেধাভিত্তিক ব্যবস্থার দাবি জানায়। প্রতিবাদ যত বাড়তে থাকে বাংলাদেশের ভুয়া গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। বিক্ষোভ দমাতে সরকার মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় , দেশব্যাপী শুট-অন-সাইট কারফিউ জারি করে এবং রাস্তায় সেনাবাহিনী ও পুলিশ মোতায়েন করে। সরকারের সহিংস প্রতিক্রিয়া দ্রুত বিক্ষোভকে একটি পূর্ণাঙ্গ ‘জনগণের অভ্যুত্থানে’ রূপান্তরিত করে, যার লক্ষ্য হাসিনা এবং তার আওয়ামী লীগ দলের পতন। ছাত্র বিক্ষোভকারী, পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষের পর সুপ্রিম কোর্ট চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা মাত্র পাঁচ শতাংশে নামিয়ে আনে ।
এই ছাড় সত্ত্বেও, বিক্ষোভকারীরা সংঘর্ষে নিহতদের জন্য জবাবদিহির দাবি অব্যাহত রাখে। হাসিনার পদত্যাগের দাবি বিরোধী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াত-ই-ইসলামী দল দ্বারা সংগঠিত হয়েছে বলে সরকার অভিযোগ তোলার চেষ্টা করেছিল।
প্রধানমন্ত্রী হাসিনা প্রতিবাদকারীদের অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের বিদ্রোহকে কঠোরভাবে মোকাবেলা করার চেষ্টা করেন। যার ফলে রাজনৈতিক আস্থার তীব্র ক্ষয় হয়। শেখ হাসিনা ৩ আগস্ট ছাত্রনেতাদের সঙ্গে দেখা করার প্রস্তাব দিলে আন্দোলনের একজন সমন্বয়কারী আন্তরিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। ৪ আগস্ট দিনটি বাংলাদেশের নাগরিক অস্থিরতার ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক দিনগুলোর একটি হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সেদিন কমপক্ষে ৯৮জন নিহত এবং শতাধিক আহত হন । সরকার বিরোধী মনোভাব দ্রুত জনমানসে ছড়িয়ে পড়ে। সরকার প্রতিবাদকারীদের ভয় দেখায়, আহতদের চিকিৎসা সেবা দিতে অস্বীকার করে এবং তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে দমন করে হাজার হাজারকে মানুষকে গ্রেপ্তার করে । অস্থিরতা বাড়ার সাথে সাথে ক্ষমতার উপর হাসিনার দখল দুর্বল হয়ে পড়ে , অবশেষে তিনি দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন।
বৈষম্য ও ক্রোধ
কোটা ব্যবস্থাকে লক্ষ্য করে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ শুরু হলেও দ্রুত জনগণের অসন্তোষ প্রকাশ পায়। দমনমূলক রাজনৈতিক পরিবেশ, দুর্বল অর্থনীতি এবং বৈষম্য, যুব বেকারত্ব এবং উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির মতো সমস্যাগুলো মোকাবেলায় সরকারের অক্ষমতার জন্য বাংলাদেশিরা দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষুব্ধ ছিলেন । ২০০৯ সালে হাসিনা ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছে যা মূলত পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ এই অঞ্চলে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটিতে পরিণত হয়েছে। গত এক দশকে মাথাপিছু আয় তিনগুণ বেড়েছে এবং গত ২০ বছরে ২৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু এই অর্থনৈতিক সাফল্যের সুফল সবার কাছে সমানভাবে পৌঁছায়নি। সবথেকে বেশি লাভবান হয়েছেন ধনীরা যারা আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে এসেছেন । জনসংখ্যার সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ দেশের আয়ের ৪১ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। যেখানে নিচের স্তরের ১০ শতাংশের কাছে পৌঁছায় আয়ের মাত্র ১.৩ শতাংশ । দেশের অর্থনৈতিক সাফল্য বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের আশা-আকাঙ্খা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। ২০২৩ সালের মধ্যে ১৫-২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ৪০ শতাংশকে "NEET" হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছিল - যার অর্থ এরা “not in employment, education or training.” অর্থাৎ এদের কোনো কর্মসংস্থান নেই। এমনকি কেউ কেউ পর্যাপ্ত শিক্ষা বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্তও নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকরা তাদের স্বল্প-শিক্ষিত সহকর্মীদের তুলনায় উচ্চ বেকারত্বের সম্মুখীন হয়েছেন। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশে পৌঁছেছে এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি এই দুর্ভোগকে আরও জটিল করে তুলেছে । সরকার এক বছরে তিনবার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ায় ইউটিলিটি খরচ বেড়ে যায় অনেকটাই । তাই কোটা আন্দোলনের থেকেও এই ক্ষোভ বিশেষভাবে রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক যুবকদের জন্য পুঞ্জীভূত হতে শুরু করেছিল । তাদের দাবি ছিল স্পষ্ট: সুষ্ঠু নির্বাচন, সরকারের জবাবদিহিতা এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতি পুনরুদ্ধার ।
গণতন্ত্রে উত্তরণ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খেয়েছে। দেশটি দুর্নীতি, বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের অধিকার হরণ এবং বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়নে জর্জরিত হয়ে পড়ে । এর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গ্রেপ্তার, গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। নির্বাচনও অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। জানুয়ারিতে অত্যন্ত বিতর্কিত একটি নির্বাচন যা হাসিনাকে টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনেছিল, প্রধান বিরোধীরা সেটি বয়কট করেছিল। কারণ নির্বাচনের আগে তাদের অনেক নেতাকে কারাগারে পাঠানো হয়। তবে সাম্প্রতিক বিক্ষোভ তলানিতে চলে যাওয়া গণতন্ত্রের উত্তরণের আশা জাগিয়েছে। তরুণরা তাদের চেতনা এবং সংহতির মাধ্যমে হাসিনার সরকারের পতন ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তারা প্রযুক্তিকেও সমানভাবে কাজে লাগিয়েছে। ইন্টারনেট এবং মোবাইল পরিষেবার ওপর সরকারি ক্র্যাকডাউন সত্ত্বেও দেশে এবং বিদেশে বিক্ষোভকারীদের একত্রিত করতে তারা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। বাংলাদেশে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য এখন প্রতিযোগীতামূলক নির্বাচন এবং একটি নতুন শাসন ব্যবস্থা প্রয়োজন। উচ্চ শিক্ষিত এবং গণতন্ত্রের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও, তরুণ বাংলাদেশিরা - বিশেষ করে নারীরা পুরুষতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামোর দ্বারা প্রান্তিক হয়ে পড়েছে। ২০২২ সালে উদাহরণস্বরূপ মাত্র ০.২৯ শতাংশ সংসদ সদস্যর বয়স ৩০বছরের কম ছিল এবং ৫.৭১ শতাংশের বয়স ছিল ৪০ বছরের কম। বর্তমানে ক্ষমতার শূন্যতা দেশের তরুণদের সামনে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়নের একটি উল্লেখযোগ্য সুযোগ উপস্থাপন করে। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যা দেশের যুব সমাজকে বিক্ষোভের দিকে পরিচালিত করে । পর্যাপ্ত রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব এবং অংশগ্রহণ ব্যতীত দেশের যুব সমাজের মধ্যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি অবিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে। যা গণতান্ত্রিক পতনের ঝুঁকিকে আরো বাড়িয়ে তুলবে। সামনের রাস্তা আরো চ্যালেঞ্জে ভরা। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের তরুণরা তাদের অধিকার এবং ভবিষ্যতের জন্য লড়াইয়ের ক্ষেত্রে নিজেদের প্রস্তুতি প্রদর্শন করেছে।
লেখক : অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডের ফ্লিন্ডার্স ইউনিভার্সিটির লেকচারার
(ডন থেকে)
No comments