ক্লাসে ক্লাসে শূন্যতা

একগুচ্ছ ফুল হয়ে ক্লাসে ফিরলো শফিক উদ্দিন আহম্মেদ আহনাফ। তবে সশরীরে নয়। স্মৃতি হয়ে। আহনাফের বসার জায়গাটা ফাঁকা রেখে বসেছে সবাই। গতকাল আহনাফের শূন্যতার ছবি ব্যাপকভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানের পোশাক পড়ে পরীক্ষা দিচ্ছেন। এরই মাঝে একটি স্থানে ফুলের তোড়া রাখা। কাগজে লেখা ‘শফিক উদ্দিন আহমেদ’।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে শতাধিক শিক্ষার্থী শহীদ হয়েছেন। আহত হয়ে বহু শিক্ষার্থী কাতরাচ্ছেন হাসপাতালের বেডে। অসুস্থ অনেকে বাসায় থাকলেও ফিরতে পারছেন না ক্লাসে।
গতকাল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে শুরু করেছে। সহপাঠীরা ক্লাসে ফিরলেও আন্দোলনে নিহত ও আহতদের শূন্যতা ভর করেছে তাদের ওপর।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সফল হয়েছে। তারা ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত রাজপথ ছাড়েনি। দাবি আদায় করেই ছেড়েছে। আন্দোলনের তোড়ে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। দীর্ঘ ছুটি শেষে বন্ধুদের সঙ্গে ক্লাসে বসা। আনন্দের মুহূর্ত, স্মরণীয় সময়। কিন্তু এবারের দৃশ্যটা একেবারেই ভিন্ন। ক্লাসে শিক্ষার্থীরা ফিরলেও রয়েছে বন্ধু হারানোর বেদনা। আশা করা যায় ক’দিন বাদে পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে আসবে পরিস্থিতি। তবে ক্লাসে ফিরবে না কয়েকশ’ শিক্ষার্থী। যারা আন্দোলনে ‘শহীদ’ হয়েছেন।

গতকাল বিএএফ শাহীন কলেজের ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের একাদশ শ্রেণির পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এই কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন আহনাফ। বয়স সবে ১৭, ছিলেন ব্যবসা শিক্ষা প্রশাসনের শিক্ষার্থী। ইচ্ছা ছিল ব্যান্ড দল গড়ে তোলার। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নিয়মিত মুখ আহনাফ। গত ৪ঠা আগস্ট রাজধানীর মিরপুরে গুলিবিদ্ধ হন। সেখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মিরপুর ১০ নম্বরে অবস্থান করছিলেন আহনাফ। তারা থাকতেন রাজধানীর মধ্য পাইকপাড়ায়। বাবা-মা বার বার আন্দোলনে যেতে নিষেধ করলেও শুনতেন না। এদিন বেলা সাড়ে ৩টার দিকে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। এরপর তার মা ফোন দেন আহনাফকে। ঘণ্টাখানেক পর আহনাফ তার মাকে জানিয়েছিলেন, মিরপুর ১০ নম্বরে আছেন। এটাই ছিল আহনাফের সঙ্গে মায়ের শেষ কথা। কিছু সময় পর একটি অচেনা নম্বর থেকে ফোন করে মিরপুরের একটি হাসপাতালে ডাকা হয়। সেখানে এক ব্যক্তি আন্দোলনে মারা যাওয়া কয়েকজনের ছবি দেখান। সেই ছবিগুলোর মধ্যে একটি ছবি ছিল আহনাফের।  এরপর আহনাফের পরিবারের সদস্যদের শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে বলা হয়। সেখানে গিয়ে মর্গে আহনাফের লাশ পান পরিবারের সদস্যরা। মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাদির কবরে আহনাফকে দাফন করা হয়।

পরিবারের বরাতে জানা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে শুরু থেকেই আহনাফ সোচ্চার ছিল। আন্দোলনে অংশ নিয়ে টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেটে আহত হয়ে সে একবার বাসায় ফিরেছিল। আহনাফ তার মা আর খালাকে বলতেন, তোমাদের মতো ভীতু মা-খালাদের জন্য ছেলেমেয়েরা আন্দোলনে যেতে পারছে না। ১৯৭১ সালে তোমাদের মতো মা-খালারা থাকলে দেশ আর স্বাধীন হতো না।
আহনাফের মা সাফাত সিদ্দিকী গণমাধ্যমকে বলেন, আন্দোলনে যেতে বাধা দিলেই আহনাফ বলতো, সে সাঈদ-মুগ্ধ ভাইদের মতো সাহসী হতে চায়। তাদের মতো কিছু হলে তারা গর্ব করে বলতে পারবেন, আমরা আহনাফের মা-খালা। শেষ পর্যন্ত আহনাফ হয়েছেও তাই।

বিএএফ শাহীন কলেজের ফাইন্যান্স বিভাগের শিক্ষক বোরহান উদ্দিন জানান, একাদশ শ্রেণির হিসাব বিজ্ঞান পরীক্ষার সময় এ উদ্যোগ নেয়া হয়। তিনি বলেন, আহনাফের জায়গা কেউ নিতে পারবে না। ও একজন বীর। আমরা ওকে বীর হিসেবেই মনে রাখবো। এ ভাবনা থেকেই আমরা আজ ওর আসনে ফুলের তোড়া রেখেছিলাম।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অধিকাংশই খোলেনি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, দীর্ঘদিন পর প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসতে শুরু করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্লাসে ফিরতে শুরু করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। যদিও শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী উপস্থিতি কিছুটা কম। তবু দীর্ঘ এক মাস পর ক্লাসে ফিরতে পেরে খুশি শিক্ষার্থীরা। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ২০টিরও অধিক বিভাগ ক্লাস কার্যক্রম শুরু করেছে। বাকি বিভাগগুলো খুব দ্রুত সময়ে ক্লাসে ফিরবেন বলেন জানান। তবে শিক্ষার্থীরা ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তায় রয়েছে। সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে শিক্ষার্থীরা আবারো পড়াশোনায় পূর্ণ মনোযোগ দেবে বলে আশা করছেন শিক্ষকরা। পড়াশোনার ক্ষতি পোষাতে বদ্ধপরিকর শিক্ষকরা। এদিকে কোটা সংস্কারের সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া ও ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। তাছাড়াও হামলার ঘটনায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ক্যম্পাসে প্রবেশ করতে পারেননি। শিক্ষার্থীরা তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করেছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রো-ভিসি (শিক্ষা) ও প্রক্টরিয়াল বডি পদত্যাগ করেছে। আবার ট্রেজারার ও প্রো-ভিসি (প্রশাসন) এর কক্ষ তালাবদ্ধ করে রেখেছে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় অভিভাবক শূন্য হয়ে আছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার জানান, অনিশ্চয়তার মধ্যেই গতকাল খুলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রক্টর, প্রভোস্টসহ প্রশাসনিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ শূন্য থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হবে এ নিয়ে কৌতূহল ছিল সবার মাঝে। প্রথম দিন কোনো বিভাগেই নিয়মিত ক্লাস অনুষ্ঠিত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। তবে মনোবিজ্ঞানসহ কিছু বিভাগে অনুষ্ঠিত হয়েছে পরীক্ষা। প্রভোস্ট না থাকায় হলগুলোর নিয়মিত কাজেও ছিল স্থবিরতা। তবে রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ে উপস্থিত ছিলেন অফিস কর্মকর্তরা। সেখানে শুরু হয়েছে নিয়মিত প্রশাসনিক কার্যক্রম।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, ভিসি, দুই প্রো-ভিসি, প্রক্টরিয়াল বডির সব সদস্য এবং হল প্রভোস্টরা পদত্যাগ করেছেন। এমতাবস্থায় সোমবার বিশ্ববিদ্যালয় খোলার কথা থাকলেও রোববার এক অফিস আদেশে এটি স্থগিত করা হয়েছে। প্রশাসন জানিয়েছে শিক্ষার্থীদের হলের আসন বরাদ্দ দিয়েই খুলবে ক্যাম্পাস। তবে প্রশাসন না থাকায় কবে নাগাদ খুলবে তা সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, রোববার থেকে সকল বিভাগে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা থাকলেও স্বাভাবিক হয়নি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রো-ভিসি, প্রক্টর, প্রাধ্যক্ষসহ পদত্যাগ করেছেন ৭৫ জন ঊর্ধ্বতন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। ফলে অভিভাবকহীন এ বিদ্যাপীঠে ক্যাম্পাস খুললেও শুরু হচ্ছে না ক্লাস-পরীক্ষা। তবে ব্যক্তি উদ্যোগে আইন, ইসলামিক স্টাডিজ, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং ফোকলোর বিভাগে একটি করে ক্লাস হয়েছে বলে জানা গেছে। বাকি সকল বিভাগের ক্লাসরুমে তালা ঝোলা অবস্থায় দেখা যায়।

No comments

Powered by Blogger.