যশোরে লাপাত্তা ১৩২৩ জনপ্রতিনিধি
ফলে জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত হলেও বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এই সেক্টরগুলো কাগুজে-কলমে কার্যকর থাকলেও বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জাতীয় সংসদের সকল সদস্য লাপাত্তার খবরে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরে তথাকথিত নির্বাচিতরা গাঢাকা দেয়। এর ফলে স্থানীয় সরকারের এ সকল দপ্তরের সেবা কার্যক্রমে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটে। সূত্র বলছে বিগত নির্বাচনী খেলার মাধ্যমে যারা জনপ্রতিনিধির তকমা গায়ে জড়িয়ে এসব চেয়ারে বসেছিলেন তাদের অধিকাংশ সমাজের খারাপ লোক হিসেবে পরিচিত। এসব জনপ্রতিনিধিদের অধিকাংশই বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড, লুটপাট, মাদক ব্যবসা, চোরাচালান, হুন্ডি ও স্বর্ণের পাচার, নারী ও শিশু পাচার, অস্ত্র চোরাচালানসহ নানা রকম সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। যার কারণে এরা দিনে দিনে জনশত্রুতে পরিণত হন। এদের অনেকেই নিজ নিজ এলাকায় দানব হিসেবে জনগণের কাছে চিহ্নিত ছিলেন। তাদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পর্যন্ত সাহস পাননি। চুন থেকে পান খসলেই এসব নামধারী জনপ্রতিনিধি ও তাদের ক্যাডারদের হাতে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বহু মানুষ। এমনকি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এই সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রেহায় পাননি। এসব ঘটনার প্রতিবাদে কেউ আইনের আশ্রয় নিতেও সাহস দেখাননি। পুলিশি ভূমিকা ছিল দলীয় ক্যাডারদের মতোই। কেউ পুলিশের কাছে কোনো নালিশ বা অভিযোগ দায়ের করার সঙ্গে সঙ্গে সেই তথ্য অভিযুক্তকে জানিয়ে দিতো পুলিশের সদস্যরা। ফলে অভিযোগকারীকে ফের হামলা, মামলা ও নির্যাতনের শিকার হতে হতো। ফলে ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের আমলে মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার বা কথা বলার কোনো স্বাধীনতা ছিল না। দীর্ঘদিন বিএনপি, জামায়াতসহ সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক দল দফায় দফায় আন্দোলন করেও এই ফ্যাসিবাদের পতন ঘটাতে না পারায় সরকারি দলের এসব নেতারা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এই পর্যায়ে জুলাই গণবিপ্লব এবং ৫ই আগস্ট মহাবিপ্লবের পর সরকারের পতন ঘটলে নামধারী এসব জনবিছিন্ন জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের প্রাণ ও জানমাল রক্ষায় গা-ঢাকা দেয়। বিশেষ করে জনপ্রতিনিধির তমকা গায়ে জড়িয়ে যারা বিগত দিনে সরকারি দলের ছত্রচ্ছায়ায় কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান তারা এলাকা ছেড়ে দেন। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, যশোর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান যুবলীগ নেতা তৌহিদ চাকলাদার ফন্টু, যশোর পৌরসভার মেয়র মুক্তিযোদ্ধা দাবিদার হায়দার গণি খান পলাশ, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুজ্জামান পিুকল, চৌগাছা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এসএম হাবিব, পৌর মেয়র আল মামুন হিমেল, ঝিকরগাছা পৌরসভার মেয়র মোস্তফা জামাল পাশা, উপজেলা চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম মনির, মণিরামপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন লাভলু, পৌর মেয়র মাহামুদুল হকসহ জেলার সকল উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বররা রাতারাতি এলাকাছাড়া হয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যশোর সদর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন, নওয়াপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তুহিন, লেবুতলার চেয়ারম্যান আলিমুজ্জামান মিলন, উপশহরের চেয়ারম্যান এহসানুর রহমান লিটু, চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দাউদ হোসেন, বারীনহরের চেয়ারম্যাান ইদ্রিস আলী, আরবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহারুল ইসলাম, দেয়াড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান আনিচ, নরেন্দ্রপুর ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রাজু আহমেদসহ সকল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বররা পালিয়ে গেছেন। ফলে দীর্ঘদিন এসব জনপ্রতিনিধিদের চেয়ারগুলো অরিক্ষত হয়ে পড়েছে।
স্থানীয় বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে জানা গেছে, যারা এলাকা ছেড়েছেন তারা প্রায় সকলেই নির্যাতনকারী, লুটপাটকারী, সন্ত্রাসী, মাদক ও অস্ত্রের চোরকারবারি ছিলেন। এদের ভয়ে জনগণ সব সময় তটস্থ থাকতেন। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে এদেরকে কেউ ধাওয়া দেয়ার আগেই নিজেদের পিঠ বাঁচাতে সরে পড়েছেন। কারণ তাদের পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তাই তাদেরকে এলাকায় কোনো জায়গা হয়নি।
এ বিষয়ে যশোর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, গত ৫ই আগস্টের পর থেকে অদ্যাবধি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বা মেম্বারগণ কেউ অফিসে আসেননি। ফলে কাজকর্মে কিছুটা গতি হারিয়েছে। যশোর সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যানরা কেহ অফিস করছেন না। ফলে বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব ঘটছে। একই ধরনের কথা বলেন যশোর পৌরসভার সিইও। যার প্রেক্ষিতে গত ১৪ই আগস্ট সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে এক প্রজ্ঞাপন জারি করে পলাতক জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতিতে স্ব স্ব স্তরের সরকারি কর্মকর্তা বিশেষ করে সিইও বা উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের কর্মক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। যার কারণে বর্তমানে কাজ চালিয়ে নেয়ার পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং রাজপথের বিরোধী সকল রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে অবিলম্বে ভোটারবিহীন স্থানীয় সরকারের এসব নির্বাচন বাতিল করে দ্রুত প্রজ্ঞাপন জারি করতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন।
এই বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে যশোরে স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক রফিকুল হাসান বলেন, বর্তমান সরকার সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত। বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধিরা অনুপস্থিত থাকায় স্থানীয় সরকারের কাজকর্মে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। এখন এই বিষয়ে সরকার যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে তা বাস্তবায়নে মাঠ প্রশাসনে আমরা যারা দায়িত্বে আছি তারা কাজ করবো।
No comments