ইতিবাচক কাজে প্রশংসায় ভাসছেন শিক্ষার্থীরা: ট্রাফিক সিগন্যাল থেকে পরিচ্ছন্নতায় তারা
ভেঙে ফেলা বিভিন্ন স্থাপনা মেরামতের কাজ করছেন ছাত্রছাত্রীরা। আগুনে ঝলসে যাওয়া স্থানের রং করছেন। আঁকছেন বিভিন্ন আলপনা। সড়ক থেকে গাছ উপড়ে ফেলা স্থানে নতুন করে রোপণ করছেন চারা। এ ছাড়া গণভবন, সংসদ ভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের লুট হওয়া মালপত্র উদ্ধারে বসানো হয়েছে বুথ। শিক্ষার্থীরা ‘লুট হওয়া মাল ফেরত দিন’ লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে এসব স্থাপনার সামনে দাঁড়িয়েছেন।
সাধারণ মানুষও শিক্ষার্থীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মালপত্র ফেরত দিচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের এসব ইতিবাচক কাজ প্রশংসা কুড়াচ্ছে সর্বমহলে।
গতকাল বুধবার রাজধানীর সংসদ ভবনের সামনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে একদল শিক্ষার্থী। কারও হাতে লাঠি আবার কারও হাতে লাল পতাকা। ছাত্রদের সঙ্গে ছাত্রীরাও প্রচণ্ড রোদ উপেক্ষা করে সড়কে রয়েছেন। সিগন্যাল না মানলে কিছুক্ষণ আটকে রেখে (শাস্তি) ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। হেলমেট না থাকলে বাইকারদের ৫ মিনিট রোদে দাঁড় করিয়ে রাখা হচ্ছে। মিরপুর, গাবতলী, বনানী, ফার্মগেট, শাহবাগসহ পুরো রাজধানীতেই এ চিত্র দেখা গেছে। সংসদ ভবন, গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ভাঙচুরের সব ক্ষত মুছে দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। সব ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে দিয়েছেন। এখন এই তিন রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তায় রয়েছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। তবে শিক্ষার্থীদেরও এসব স্থাপনার সামনে অবস্থান নিতে দেখা গেছে। সংসদ ভবনের সামনে কথা হয় ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তারা বলেন, ‘মঙ্গলবার থেকেই স্বেচ্ছায় আমরা এখানে কাজ করছি। কারও প্রতি কোনো জোর নেই। যে যার মতো যতক্ষণ খুশি কাজ করছেন।’
মিরাজ আহমেদ খান নামে এক শিক্ষার্থী কালবেলাকে বলেন, ‘আমি সকাল থেকে এখানে আছি। আমাদের ক্যাম্পাসের বড় ভাইয়েরা কিছু নির্দেশনা দিচ্ছেন। আমরা মূলত নিজেদের মতোই কাজ করছি। যতদিন না পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, ততদিন আমরা কাজ করব।’
গতকাল সকাল থেকেই ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি পরিষ্কার করে একদল শিক্ষার্থী। পরে দুপুরের দিকে সেটির নিয়ন্ত্রণ নিতে দেখা যায় সেনাসদস্যদের। রাজধানীর হলিক্রসের শিক্ষার্থী তাসফিয়া তাসনুম হিয়া বলেন, ‘দেশপ্রেমের তাড়না থেকে এখানে এসেছি। এই দেশটা আমাদের, দেশটির পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর নিরাপদ রাখার দায়িত্বও আমাদের। বৈষম্যহীন নতুন এক বাংলাদেশ গড়ার শপথ নিয়েছে এই দেশের ছাত্রসমাজ। সেই শপথ বাস্তবায়নের সহযোদ্ধা হতে এখানে এসেছি।’
ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি আগুনে ঝলসে যাওয়া স্থানে রং-তুলিতে আলপনা আঁকছেন শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া টানা কয়েকদিনের সংঘর্ষে সড়ক ও স্থাপনার বিভিন্ন ক্ষত মেরামত করতেও দেখা যায় শিক্ষার্থীদের। গতকাল দুপুরে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর আড়ং মোড়ে কথা হয় সমতট মুক্ত স্কাউট গ্রুপের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব শিক্ষার্থী হলেন আসিফ হাসান, ফারদিন সুনান, এলোন ইসলাম সিয়াম ও সামারা সাবা। তারা কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা মঙ্গলবার গণভবন পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্নতার কাজ করেছি। আজকে আমাদের স্কাউট গ্রুপ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সড়কের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে। আমরা সেটিই করছি। যতদিন না দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, আমরা ততদিন সড়ক ছেড়ে যাব না।’
সংসদের সামনে এক শিক্ষার্থীকে একটি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে হাঁটতে দেখা যায়। সেখানে লেখা রয়েছে, সংসদ ভবনের লুট হওয়া মালপত্র ফেরত দিন। শিক্ষার্থীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেকেই লুট হওয়া মালপত্র তাদের কাছে ফেরত দিচ্ছেন বলেও জানান ওই শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ‘লুট হওয়া মালপত্র উদ্ধার করে আমরা সেনাবাহিনীর কাছে ফেরত দিচ্ছি।’
এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নেমেছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল দুপুরে ক্যাম্পাসে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শতাধিক শিক্ষার্থী টিএসসি, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার এলাকা, কলাভবন, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ ভবন, অপরাজেয় বাংলা, মল চত্বর এলাকাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান পরিচ্ছন্ন করছেন।
তারা টিএসসি থেকে পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু করেন। নির্দিষ্ট স্থান পরিষ্কার শেষে ময়লাভর্তি পলিব্যাগগুলো ময়লার ডাম্পিং স্টেশনে ফেলে দিয়ে বিকেলে তাদের কাজের পরিসমাপ্তি করেন।
এ কাজে যুক্ত ছিলেন ঢাবির মার্কেটিং বিভাগের তিন শিক্ষার্থী মোহাম্মদ হাসান, ফাইজা তাসনিম তানহা ও ফারদিন খান লাজিম। তারা বলেন, আমাদের ক্যাম্পাস পরিষ্কার করার দায়িত্ব আমাদের। এক মাস ধরে নানান ঘটনায় ক্যাম্পাসের পরিবেশ স্বাভাবিক ছিল না। যার ফলে ক্যাম্পাস অনেকটা নোংরা হয়েছিল।
রায়হান নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানের বিষয়টা সবার জন্য মেসেজ। আমরা সবাই যার যার জায়গা থেকে আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেললে আসলে পরিবেশ ভালো থাকে এবং তা দেখে আমাদের ভালো লাগা অনুভব হয়। প্রতিদিন তো আসলে আমাদের আসা সম্ভব নয়। এজন্য সবাই সচেতন থাকলে সবার জন্যই ভালো।
শিক্ষার্থীদের এসব ভালো কাজে প্রশংসায় ভাসছেন তারা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি সংবলিত এসব পোস্ট করে প্রশংসা করছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তারা এ ছাত্রসমাজের হাত ধরে নতুন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছেন। তবে অনেকে বলছেন, শিক্ষার্থীদের রক্তে অর্জিত এ বাংলাদেশে ফের যেন কোনো অশুভ শক্তি আর ভর করতে না পারে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
No comments