বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে কী ভাবছে ভারত সরকার by সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

সতর্কতা গ্রহণ ও পর্যবেক্ষণ ছাড়া বাংলাদেশ নিয়ে ভারত এখনো কোনো মন্তব্য করতে রাজি নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দায়িত্ব গ্রহণ, উপদেষ্টামণ্ডলী গঠন ও নতুন ব্যবস্থার প্রতি জনসাধারণের সমর্থন কতটা সদর্থক ও ইতিবাচক হয়, ভারতের প্রাথমিক নজর এখন সেদিকেই। ভারত সতর্ক বলেই সেখানকার দূতাবাসের দুই শতাধিক কর্মীকে দেশে ফেরত আনা হয়েছে। ভিসা আবেদন গ্রহণের কেন্দ্রগুলোও আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে।

ভারতের প্রাথমিক চিন্তা ভারত বিরোধিতার বহর নিয়ে। আন্দোলনের মাঝপথে যেভাবে ভারতবিরোধী স্লোগান শোনা গেছে, তাতে দিল্লির সাউথ ব্লক গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। দেশের বিভিন্ন জেলায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি, মন্দির আক্রান্ত হয়েছে। হিন্দু ব্যবসায়ীদের দোকানপাট লুট হয়েছে। এ নিয়েও ভারত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। কয়েক দিন ধরে ভারত চেষ্টা করেছে সেনাবাহিনীর সঙ্গে কথা বলে এই প্রবণতায় রাশ টানতে। ভারতের পক্ষে স্বস্তির বিষয়, সমাজের বিভিন্ন মহল থেকে এই অপকর্ম বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করা না হলেও মোদি সরকারের ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, ভারতীয় সংস্কৃতিকেন্দ্রসহ কিছু স্থাপনা ও হিন্দুদের ওপর হামলার পেছনে জামায়াতের মতো মৌলবাদী শক্তিই জড়িত। ভারতবিদ্বেষের প্রধান শক্তিও তারা। শেখ হাসিনার জমানায় এই শক্তি সেভাবে মাথাচাড়া দিতে পারেনি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা প্রকাশ্যেই নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বঙ্গবন্ধুর মূর্তি ও নানা স্থাপত্য ভেঙে ফেলাও তাদের কাজ বলে ভারত মনে করে। নতুন সরকারে প্রধানত জামায়াতের অন্তর্ভুক্তি ও প্রভাব কতটা থাকে, সেদিকে ভারত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছে।

ভারত মনে করে, নতুন রাজনৈতিক পরিসরে জামায়াতের উত্থান প্রগতিশীল, উন্নতমনা, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের পক্ষেও চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। নতুন প্রজন্ম, যারা এই বিপ্লবের প্রধান কান্ডারি এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিষয়টি কীভাবে দেখছে ও আগামী দিনে দেখবে, ভারত তা সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ রাখছে। সাউথ ব্লক মনে করছে, আগামী দিনে দুই দেশের সম্পর্ক অনেকটা নির্ধারণ করবে এই বিষয়।

সেই কারণেই মোদির নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার নজর রাখছে, অধ্যাপক ড. ইউনূসের উপদেষ্টামণ্ডলীতে কারা আসেন তার ওপর। অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসক হিসেবে ড. ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতা ভারতকে আশ্বস্ত করেছে। যদিও প্রশাসক হিসেবে তিনি কতটা দক্ষ, তা অজানা। বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতে ইতিমধ্যেই বলা হয়েছে, উপদেষ্টামণ্ডলীর গঠন নিয়ে বিএনপি, জামায়াত, ছাত্র সমন্বয়ক ও সুশীল সমাজে মতপার্থক্য আছে। এ বিষয়ে সেনাবাহিনীর মতামতও স্পষ্ট নয়। ইউনূস দেশে ফিরে কীভাবে এর সমাধান করেন, সেদিকে দৃষ্টি থাকছে ভারতের।

এই কয়েক দিনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়েও ভারতের কোনো কোনো মহলে প্রশ্ন উঠেছে। হাসিনার দেশত্যাগের পেছনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ও উদ্যোগের কথা এখন সবার জানা। সেনাবাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর বলপ্রয়োগ করতে চায়নি। কিন্তু দাঙ্গাবাজদের রোখা, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষা কিংবা ভীতসন্ত্রস্ত পুলিশ বাহিনীকে সাহস না জোগানোর ক্ষেত্রে বাহিনী কেন নিষ্ক্রিয় থাকল, সেই ব্যাখ্যা এসব মহলে নেই। যে বাহিনী জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষার কাজে পারদর্শী, তারা কেন নিজের দেশে শান্তি রক্ষা করতে ব্যর্থ, এই প্রশ্ন উঠছে।

মোদি সরকারের কারও কারও ধারণা, ওই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী আন্দোলনকারীদের কাছে অপ্রিয় হতে চায়নি। কেউবা মনে করেন, হয়তো দীর্ঘদিনের ক্ষোভ উগরে জনতাকে শান্ত করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। কারণ যা-ই হোক, ভারত মনে করে ওই জনরোষ দেশের অনেক ক্ষতি করে দিয়েছে।

শেখ হাসিনাকে নিয়েও ভারত দোলাচলে। চিন্তায়ও। হাসিনাকে পাকাপাকি আশ্রয় দিতে ভারত চায় না। কারণ, বাংলাদেশের নতুন শক্তি তা পছন্দ করবে না এবং আগামী দিনে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর তা প্রভাব ফেলবে। আবার দীর্ঘদিনের সম্পর্কের জন্যও হাসিনাকে ভারত অনিশ্চিত জীবনের দিকে ঠেলে দিতে পারছে না।

এই কারণেই হয়তো পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর সর্বদলীয় নেতাদের বলেছেন, হাসিনা সাময়িকভাবে এ দেশে থাকবেন। স্থায়ী রাজনৈতিক আশ্রয় নির্দিষ্ট হয়ে গেলে তিনি চলে যাবেন। তা যাতে দ্রুত হয়, সেটাই ভারতের কাম্য। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইতিমধ্যেই ভারতীয় গণমাধ্যমে মন্তব্য করেছেন, হাসিনা ভারতে আশ্রয় পান, তা কাম্য নয়।

১৫ বছর ধরে চলে আসা বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের গতিপথ আগামী দিনে কেমন হবে, এখনো তা অজানা।

No comments

Powered by Blogger.