‘সরকার-শূন্যতা’ কাটছে আজ: ড. ইউনূস দুপুরে ফিরছেন, রাতে শপথ

তিন দিনের শূন্যতা কাটিয়ে আজ থেকে শুরু হচ্ছে নতুন সরকারের যাত্রা। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার নেতৃত্বে থাকছেন নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রাত ৮টায় বঙ্গভবনে শপথ নেবেন সরকারপ্রধান এবং তার পরিষদের সদস্যরা। সব মিলিয়ে এই সংখ্যা ১৫ জন হতে পারে বলে জানিয়েছেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। গতকাল বুধবার সেনা সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, বৃহস্পতিবার (আজ) দুপুরে ড. ইউনূস দেশে ফিরবেন।

জানা গেছে, ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস থেকে ইতোমধ্যেই দেশের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আজ দুপুর ২টা ১০ মিনিটে এমিরেটসের একটি ফ্লাইটে ঢাকায় পৌঁছাবেন তিনি।

গতকাল বুধবার দেশবাসীর উদ্দেশে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, ‘আমাদের কোনো প্রকার ভুলের কারণে এই বিজয় যেন হাতছাড়া হয়ে না যায়।’

এ সময় তিনি সবাইকে বর্তমান পরিস্থিতিতে শান্ত থাকতে এবং সব ধরনের সহিংসতা এবং স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ বিনষ্ট করা থেকে বিরত থাকতে আহ্বান জানিয়েছেন।

জানা গেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, বিভিন্ন দাতা সংস্থার প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের চারশ অতিথি উপস্থিত থাকবেন।

তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে কারা থাকছেন, এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম গত রাতের মধ্যেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চূড়ান্ত রূপরেখা ঘোষণা করা হবে বলে জানান। তবে রাত ১০টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো ঘোষণা আসেনি।

এর আগে গত মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৩ সমন্বয়ক, তিন বাহিনীর প্রধান ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে কিছু নাম প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানানো হয়। সেখানে রাষ্ট্রপতি একজন করে মুক্তিযোদ্ধা, সংখ্যালঘু ও আদিবাসী রাখার পরামর্শ দেন। আলোচনার মাধ্যমে সেসব নাম চূড়ান্ত করার কথা।

কোনো কিছু চূড়ান্ত না হলেও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদস্য হিসেবে বেশ কিছু নাম জোরালোভাবে আলোচনায় এসেছে। তাদের মধ্যে আছেন অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তাসনিম আরেফা সিদ্দিকী, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন, নিউএজ পত্রিকার প্রকাশক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল্লাহ খান বাদল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, মানবাধিকার সংগঠক আদিলুর রহমান খান, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রমুখ।

অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে কথা হয়েছে জানিয়ে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘উনার সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লেগেছে। আমার মনে হয়েছে উনি এই কাজটা করার জন্য খুবই আগ্রহী। আমি নিশ্চিত, উনি আমাদের সুন্দর একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নিয়ে যেতে পারবেন এবং আমরা এ থেকে উপকৃত হবো।’

সেনা সদরে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলন তিনি বলেন, ‘কেয়ারটেকার গভর্নমেন্টের প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নির্বাচন করেছি। আমরা নিজেদের মধ্যে অনেক আলোচনা করেছি। সব রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে, স্টুডেন্ট কো-অর্ডিনেটরদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আমার সঙ্গে নেভি ও এয়ার চিফ ছিলেন। আমরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা করেছি। এই আলোচনায় সর্বসম্মতভাবে সম্মত হয়ে মহামান্যের কাছে প্রস্তাব দিয়েছি, চিফ অ্যাডভাইজার ড. ইউনূস সাহেবকে করার জন্য এবং উনি এখন আমাদের চিফ অ্যাডভাইজার।’

ড. ইউনূস বৃহস্পতিবার দুপুরে দেশে পৌঁছবেন জানিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, ‘আমি উনাকে রিসিভ করতে যাব। আমরা উনাকে সর্বতোভাবে সহায়তা করব, আমি আর্মি চিফ, এয়ার চিফ, নেভি চিফ। আমি নিশ্চিত যে, তিনি সমস্ত রাজনৈতিক দল এবং স্টুডেন্ট কো-অর্ডিনেটরদের কাছ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা পাবেন। আমরা সবাই মিলে উনাকে সাহায্য করব। সবার সহযোগিতায় তিনি তার কাজ সফলভাবে সমাধা করতে সক্ষম হবেন।’

নতুন সরকারের শপথ অনুষ্ঠান সম্পর্কে সেনাপ্রধান বলেন, ‘কালকে (আজ) শপথ গ্রহণের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। বিকেলে করার একটা প্রস্তাব ছিল। বিকেলে খুব টাইট হয়ে যেতে পারে। কারণ তিনি ২টা ১০ মিনিটের দিকে এখানে আসবেন। আমরা রাত ৮টার দিকে করতে পারি। হয়তো চারশ জন লোকের উপস্থিতি সেখানে থাকবে। এই পরিসরে আমরা শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠান করব।’

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে কতজন থাকবেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা, আপাতত ১৫ জন হতে পারে। এর কম-বেশি হতে পারে। মোটামুটি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। যেহেতু ফরমালি প্রকাশ করা হয়নি, তাই আমি এখন বলছি না।’

গত জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ ও পুলিশি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশে সরকারবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলন দমাতে সরকারের ব্যাপক বলপ্রয়োগে বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়। তবে তাতেও

ছাত্র-জনতার জাগরণ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। হাসিনা সরকারকে হটাতে অসহযোগ ও ঢাকামুখী মার্চের ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত সোমবার প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেশত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সারা দেশ বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠে।

দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাসহ সার্বিক বিষয়ে ভূমিকা নেন সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধান। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবউদ্দীন।

এরপর শিক্ষার্থীদের প্রস্তাবের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম চূড়ান্ত করা হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে অন্য নামগুলো চূড়ান্ত করছেন শিক্ষার্থীরা।

No comments

Powered by Blogger.