অর্থনীতির হাল ফেরাবেন, তাই ভরসা ইউনূসে
প্যারিস থেকে এ দিনই বাংলাদেশে পৌঁছবেন ইউনূস। আর তারপরে তাঁরই হাত ধরে শুধু অর্থনীতিতে নয়, সার্বিক ভাবে দেশ ঘুরে দাঁড়াবে - এমন বিশ্বাসে বুক বাঁধছেন সেখানকার বুদ্ধিজীবীরা। শুধু বিপুল ঋণের বোঝাই নয়। সাম্প্রতিক অস্থিরতার জেরে কারখানা ও উৎপাদন বড় ধাক্কা খেয়েছে। গত মার্চ পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৯৯.৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার।
দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে হিংসা মাত্রা ছাড়িয়েছে। এমন আবহে হাল ধরতে চলেছেন ইউনূস। বাংলাদেশের স্থানীয় সময় দুপুর ২টো ১০-এ ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার কথা ইউনূসের। তার আগেই নোবেলজয়ীর আবেদন - ‘আমাদের কোনও ভুলের কারণে এই বিজয় যেন হাতছাড়া হয়ে না যায়। সবাইকে বর্তমান পরিস্থিতিতে শান্ত থাকতে এবং সব ধরনের হিংসা এবং সম্পদ নষ্ট করা থেকে বিরত থাকতে আহ্বান জানাচ্ছি।’
বাংলাদেশের ‘সাহসী’ পড়ুয়াদের অভিনন্দনও জানিয়ে বলেছেন, এঁরাই ‘দ্বিতীয় বিজয় দিবস’-এর বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশের আমজনতাকেও ‘অভিনন্দন’ জানিয়েছেন বাংলাদেশে স্মল ফিনান্সের প্রবক্তা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসাদ বিন রনি বুধবার বলেন, ‘মুহাম্মদ ইউনূস এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য চরিত্র। বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ীকেই তাই সরকারের মাথায় চেয়েছি আমরা। কারণ দেশের অর্থনীতি বেহাল। হাল ধরতে ওঁর মতো কাউকেই চাই।’
গত সোমবার পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে দিনই সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামান জানিয়েছিলেন, আপাতত অন্তর্বর্তী সরকার দেশ চালাবে। তারপরই ক্যাবিনেটের সম্ভাব্য কিছু নাম ঘুরে বেড়াতে থাকে। কিন্তু এর কোনওটিরই নিশ্চয়তা মেলেনি বুধবার সন্ধে পর্যন্ত। সেই অসমর্থিত তালিকায় ছিলেন ‘দৈনিক মানবজমিন’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীও।
তাঁর কাছে ‘এই সময়’-এর প্রশ্ন ছিল, কেন ইউনূস? তাঁর তো সে অর্থে কোন রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। মতিউর বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি বিশেষ পরিস্থিতি অতিক্রম করছে। আগে কখনও সরকারের প্রধান এ ভাবে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েননি। এমন সময়ে সরকার চালাতে ডঃ মূহাম্মদ ইউনূসের নাম আন্দোলনকারী ছাত্র নেতারা প্রস্তাব করলে প্রেসিডেন্ট তা চূড়ান্ত করেছেন। ধরে নেওয়াই যায় যে অন্যান্য মহল এবং রাজনৈতিক দলগুলিরও তাঁর প্রতি সমর্থন আছে।’
এরপরে তাঁর গলাতেও শোনা যায় রনির সুর। মতিউরের বক্তব্য, ‘প্রফেসর ইউনূস এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক ভাবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বাংলাদেশি। ইউরোপ, আমেরিকা, চিন বা ভারত - সর্বত্র তিনি তাঁর কাজের জন্য সমাদৃত। হাসিনার সরকারের দ্বারা তিনি অন্যায় ভাবে নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন বলে বিশ্বাস বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষেরই। দেশের মানুষেরও তাঁর প্রতি বিপুল সমর্থন রয়েছে।’
তা ছাড়া রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকলেও সারা জীবন ইউনূস মানুষকে নিয়েই কাজ করেছেন। এ প্রসঙ্গে গ্রামীণ ব্যাঙ্কের প্রসঙ্গও তোলেন মতিউর। কিছু দিন আগে একটি আন্তর্জাতিক ম্যাগাজ়িনকে সাক্ষাৎকারে ইউনূস বলেছিলেন, ‘রাজনীতি নিয়ে আমার ভীষণ অস্বস্তি হয়।’ সেই তিনিই ছাত্রদের দাবি মেনে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিতে রাজি। বুধবার ব্রিটেনের একটি দৈনিককে বলেছেন, ‘দেশ পুনর্গঠনে আমরা এক সঙ্গে কী ভাবে কাজ করতে পারি, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব দলের সঙ্গে কথা বলব।’
দেশে স্থিতাবস্থা ফিরলে দ্রুত নির্বাচনের চেষ্টা করবেন বলেও জানিয়েছেন। স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তরুণ সমাজের অনুরোধেই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হতে রাজি হয়েছেন। নির্বাচনী রাজনীতি তাঁর না-পসন্দ। মনোনীত কোনও পদও চান না। বাংলাদেশে এ দিনই শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় দণ্ড বাতিল হয়েছে ইউনূসের। শ্রম-আইন ভাঙার অভিযোগে জানুয়ারিতে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল বাংলাদেশের আদালত। ছ’মাসের সাজাও হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধেই আবেদন জানান ইউনূস। এ দিন নতুন রায় জানিয়েছে শ্রম আপিল ট্রাইবুনাল।
বুধবার দেশে নতুন করে কোনও হিংসা-হানাহানির খবর মেলেনি। সোনার বাংলা ধীরে ধীরে ছন্দে ফিরলেও প্রচুর মানুষের নিধন, সম্পত্তি ভাঙচুরের পরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ থাকছেই। এই পরিস্থিতিতে ইউনূসের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ কী? একই সুর রনি, মতিউর-এর গলায়। মতিউরের কথায়, ‘প্রথম চ্যালেঞ্জ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি। মানুষকে ভরসা দেওয়া। এই গণঅভ্যুত্থানে নতুন আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেটাও পূরণ করতে হবে। ছাত্রহত্যায় জড়িতদের বিচার করতে হবে। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অর্থনীতি। যেটা ইউনূসের চেয়ে ভালো আর কেই বা সামলাতে পারবেন?’
মতিউরের মতে, ইউনূস কী ভাবে দুর্নীতিতে লাগাম পরান, নজর থাকবে সে দিকেও। বাংলাদেশেরই অন্যতম অর্থনীতিবিদ এবং মন্ত্রিসভার সম্ভাব্য সদস্য দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যও ‘এই সময়’-কে বলেন, ‘একটি স্থিতিশীল, আস্থাভাজন ও কর্মক্ষম সরকার তৈরিই ইউনূসের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।’
অবশ্যম্ভাবি প্রশ্ন, ভারতের প্রতি নতুন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কী হতে পারে? বুধবারেই সাক্ষাৎকারে ইউনূস বলেছেন, ‘বাংলাদেশ স্থিতিশীল না হলে তার প্রভাব পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের সেভেন সিস্টার্স স্টেটে (উত্তর-পূর্বের সাতটি রাজ্য) পড়বে। ফলে চারপাশে অগ্নুৎপাত ঘটবে। তা কখনই একটি দেশে সীমাবদ্ধ থাকবে না।’ নির্বাচনের নামে বাংলাদেশে যে বছরের পর বছর প্রহসন হয়েছে, তা নিয়ে ভারত কোনও সমালোচনা না করায় তিনি অসন্তুষ্ট বলেও জানান।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে মতিউরের পর্যবেক্ষণ, ‘বাংলাদেশ সব সময়েই ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কে আগ্রহী। কিন্তু ভারত এক ঝুড়িতে সব আম রাখায় এ নিয়ে সঙ্কট তৈরি হয়েছে। তবে আমি দেখছি, ভারতের বিশেষজ্ঞরা এরই মধ্যে প্রফেসর ইউনূসকে স্বাগত জানিয়েছেন। আমার ধারণা, সঙ্কট কাটিয়ে দু’দেশের সম্পর্ক ঠিক পথেই এগোবে।’
সূত্র: এই সময়
No comments