দেড় দশক ধরে আক্রোশের শিকার ড. ইউনূস
সারা বিশ্বে যাকে নানাভাবে সম্মানিত করছে, গত দেড় দশকে তাকেই নিজের দেশে সইতে হয়েছে নানামুখী লাঞ্ছনা। নিজের প্রতিষ্ঠিত ব্যাংক থেকে বিতাড়িত হওয়া থেকে শুরু করে একের পর এক হয়রানিমূলক মামলা, এমনকি কারাদণ্ডের রায়ও শুনতে হয়েছে তাকে। আর নানারকম কটূক্তির তো সীমাই ছিল না। মূলত সরকারপ্রধানের চরম আক্রোশের শিকার হয়েই ড. ইউনূসকে নানা হয়রানির শিকার হতে হয়েছে বলে সর্বস্তরের মানুষের ধারণা।
বিশ্বে ড. ইউনূসকে এক নামে চিনলেও দেড় দশক ধরে নিজ দেশেই বিভিন্ন অভিযোগে বারবার দাঁড়িয়েছেন আদালতের কাঠগড়ায়; কখনো ক্ষুব্ধ হয়েছেন, কখনো হয়েছেন আবেগাপ্লুত। সর্বশেষ কয়েক বছর তার দীর্ঘ সময় কেটেছে আদালত প্রাঙ্গণে।
ঘটনার শুরু অবশ্য রাজনীতিতে তার আগ্রহ দেখানোর পরই। ড. ইউনূস শান্তিতে নোবেল জয়ের পরের বছর ২০০৭ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। এরই মধ্যে রাজনীতিতে নামতে দল গঠনের ঘোষণা দেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্মানিত ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দলের নাম দেন ‘নাগরিক শক্তি’। যদিও মাস কয়েক পরই রাজনীতি থেকে সরে যান এই অর্থনীতিবিদ। তবে তখন থেকেই ড. ইউনূস সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
সমালোচকরা বলে থাকেন, নোবেল জয় করে বিশ্বপরিমণ্ডলে বাংলাদেশের মর্যাদা উঁচু করাই কাল হলো এই অর্থনীতিবিদের। কারণ, সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার এই নোবেল জয়কে কোনোভাবেই সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে যিনি দেশ থেকে পালিয়ে এখন ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন।
জরুরি অবস্থা অবসানের পর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এরপর আক্রোশ হিসেবে বয়সজনিত কারণ দেখিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ড. ইউনূসকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সরকারের সেই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে আদালতে গেলেও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসেনি। ফলে ২০১১ সালে গ্রামীণ ব্যাংক ছাড়তে হয় ইউনূসকে।
সেখানেই শেষ নয়; বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতুর ঋণ আটকে দিলে তার জন্য শেখ হাসিনা দায়ী করেন ড. ইউনূসকে। যদিও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে শেখ হাসিনা সরকার। হাসিনা সরকারের শেষ দিন পর্যন্ত এই বিখ্যাত মানুষটির সমালোচনায় মুখর ছিলেন সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী ও নেতারা। দল ও সরকারের যে কোনো ফোরামের সভা-সমাবেশ ও আলোচনায় অপ্রাসঙ্গিকভাবেই ঘুরে ফিরে আসত ড. ইউনূসের নাম। সরকারপ্রধানসহ আওয়ামী লীগ নেতারা তাকে বারবার ‘গরিবের রক্তচোষা’, ‘ঘুষখোর’ বলে অপমানিত করেন। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ঝাড়ু মিছিল করে অসম্মানিত করার অপচেষ্টা করা হয়।
মাস কয়েক আগে ড. ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ শক্তিসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দখল করে নেয় সরকার সমর্থকরা। তার বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাৎ, শ্রম অধিকার লঙ্ঘন, এমনকি বিদেশে বক্তৃতা থেকে তিনি যে সম্মানী পান, তা সরকারের করমুক্ত সুবিধার আওতায় বৈধ চ্যানেলে দেশে আনলেও তার বিরুদ্ধে বারবার ট্যাক্স ফাঁকির অভিযোগ আনা হয়।
ড. ইউনূসের প্রতি শেখ হাসিনার বৈরিতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বারবার আলোচিত হয়। বিশ্বের প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, নোবেলজয়ী থেকে শুরু করে নানা প্রান্ত থেকে তাকে বিচারিক হয়রানি না করার আহ্বান জানানো হলেও তাতে কোনো কর্ণপাত করেননি শেখ হাসিনা।
ড. ইউনূসকে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে বলে উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন। চলমান মামলা স্থগিত করার আহ্বান জানিয়ে বিশ্বের ১৬০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খোলা চিঠি দেন।
ড. ইউনূসের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগের বিষয়ে বারবার প্রতিবাদ জানানো হয়েছে, বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, তিনি যে ৫০টির মতো প্রতিষ্ঠান গড়েছেন, সেগুলোর একটিতেও তার ১ শতাংশ মালিকানা নেই এবং এগুলো থেকে পারিশ্রমিক, ফি বা লাভ হিসেবে তিনি এক টাকাও নেন না। স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে মানুষের কল্যাণে তিনি এসব কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু এসব প্রতিবাদ কখনোই আমলে নেওয়া হয়নি। পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় প্রবীণ এই অধ্যাপককে সবসময়ই সন্দেহের চোখে দেখতেন শেখ হাসিনা।
দেড় দশক ধরে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ১৬৮টি মামলা করা হয়। এর মধ্যে ফৌজদারি আদালতে একটি, দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি এবং বাকি ১৬৬টি মামলা ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে বিচারাধীন ছিল। সর্বশেষ গত ৪ আগস্ট এক রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পাওনা হিসেবে ৬৬৬ কোটি টাকা ড. ইউনূসকে পরিশোধ করতে হবে। প্রায় ২৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০২২ সালের ৪ জুলাই গ্রামীণ টেলিকমের ৮ কর্মকর্তাসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলাটি করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ৩ মার্চ এ মামলায় আত্মসমর্পণ করে জামিন পান ড. ইউনূস।
এ বছরের ১ জানুয়ারি শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে একটি ধারায় তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড ও ৩০ হাজার টাকা জরিমানার শাস্তি দেন ঢাকার একটি শ্রম আদালত। রায়ের পর আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে ড. ইউনূস সাংবাদিকদের বলেন, ‘যে অপরাধ করিনি, সেই অপরাধের জন্য শাস্তি পেলাম।’
শ্রম আদালতের দেওয়া রায় চ্যালেঞ্জ করে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেন ড. ইউনূস। যদিও শেখ হাসিনার সরকার শ্রম আদালতকে প্রভাবিত করে তাকে এই কারাদণ্ড দিয়েছে বলে ধারণা আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টদের। যিনি সারা জীবন দরিদ্র ও বঞ্চিতদের জন্য কাজ করেছেন, তাকেই শেখ হাসিনা সরকার কারাগারে বন্দি করার পরিকল্পনা নেয়। অবশেষে গতকাল সেই রায় বাতিল করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
বিদায়ী সরকারের আমলে ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ কল্যাণসহ আটটি প্রতিষ্ঠান ‘জবরদখল’ করা হয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ কল্যাণসহ এসব প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। ঢাকার মিরপুরের চিড়িয়াখানা রোডে ‘টেলিকম ভবন’ নামে ১৩ তলা একটি ভবনে এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। সম্প্রতি ওই ভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমরা একটা ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেছি। আমরা একটা স্বপ্নের বীজতলা হিসেবে এই ভবন তৈরি করেছিলাম।’
No comments