বাংলাদেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে অংশীদারিত্ব চুক্তির আলোচনা স্থগিত করেছে ইইউ

বাংলাদেশের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি ‘অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি-পিসিএ’ নিয়ে পরবর্তী আলোচনা স্থগিত করেছে ২৭ রাষ্ট্রের ওই জোট। বাংলাদেশের বিরাজমান অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আলোচনাটি স্থগিত করা হয় বলে ইইউ’র একজন মুখপাত্র মানবজমিনকে নিশ্চিত করেছেন। আগামী সেপ্টেম্বরে ঢাকায় সেই আলোচনা হওয়ার শিডিউল ছিল। ইইউ’র মুখপাত্র বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে ইইউ’র অবস্থান জানতে গত ৩০শে জুলাই হাই-রিপ্রেজেনটেটিভ জোসেপ বোরেলের বিবৃতিকে রেফার করেন। স্মরণ করা যায়, ইইউ-বাংলাদেশ সম্পর্কের মৌলিক বিষয়গুলো অর্থাৎ গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোকে বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশের এই কঠিন সংকটে সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঘনিষ্ঠভাবে নজরদারিতে রাখবে বলে বিবৃতিতে স্পষ্ট করেছিলেন ইইউ’র উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) জোসেপ বোরেল। বিবৃতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের তরফে এই প্রত্যাশাও ব্যক্ত করা হয়েছিল যে বাংলাদেশ সরকার তার প্রতিটি পদক্ষেপে মানবাধিকারের প্রতি সম্পূর্ণভাবে সম্মান প্রদর্শন করবে। সেগুনবাগিচা এবং ব্রাসেলসের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত বছরের অক্টোবরে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভনডার লেইন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে পিসিএ সই হয়েছিল।

যার আওতায় প্রথম স্লটেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বিভিন্ন প্রকল্পে বাংলাদেশের ন্যূনতম ৪৭০ মিলিয়ন ইউরো সহযোগিতা পাওয়ার  কথা ছিল। তাছাড়া এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার পথকে আরও প্রশস্ত করতো। অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা চুক্তিটি ঢাকা ও ব্রাসেলসের মধ্যে সই হলেও জোটের সব সদস্যের জন্য এটি মেনে চলার আইনগতভাবে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গোটা ইউরোপের সমর্থন সহযোগিতা পেতে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি। সেই চুক্তির পরবর্তী আলোচনা স্থগিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে সেগুনবাগিচা এটা স্বীকার করেছে যে, বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে খুবই সমালোচনামুখর রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ মানবাধিকার সংবেদনশীল পশ্চিমা বিশ্ব। চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সৃষ্ট উত্তেজক পরিস্থিতিতে প্রকাশ্যে কোনো রকম বিবৃতি না দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি অনুরোধ করেছিল বাংলাদেশ সরকার। আন্দোলনের শুরুর দিকে তারা এ নিয়ে কোনো বিবৃতি না দিলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফে বেপরোয়া গুলি বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের লাশ পড়ে যাওয়ায় পর থেকে কাছের এবং দূরের প্রায় সব রাষ্ট্রেই প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ইউরোপের দেশগুলো জোটবদ্ধভাবে এবং ঢাকায় থাকা দেশগুলোর প্রতিনিধিরা  পশ্চিমা অন্য রাষ্ট্র, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থা-সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মিলে দফায় দফায় এ নিয়ে উদ্বেগ ব্যক্ত করে চলেছেন। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে সংঘটিত বেআইনি হত্যা ও ঘোষিত ‘শুট অন সাইট পলিসি’ বা দেখামাত্র গুলির ঘোষণায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ইইউ’র পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেপ বোরেল।

তিনি বাংলাদেশে বিক্ষোভ দমনে সরকারি বাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগের তীব্র নিন্দা জানান। বিবৃতি দেয়া ছাড়াও গত ২৭শে জুলাই লাওসে আসিয়ানের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের ফাঁকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতা সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ ব্যক্ত করেন তিনি। জোসেপ বোরেল খোলাসা করেই বলেন, প্রতিবাদকারী শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, শিশুসহ অন্যদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত বল প্রয়োগ এবং প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের প্রতিটি ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করতে হবে। দায়ীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে আন্দোলন দমনে হাজার হাজার লোকের বাছ-বিচারহীন গ্রেপ্তার বা আটকে ‘যথাযথ প্রক্রিয়া’ অনুসরণ করতে হবে। আলোচনা স্থগিত করার বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন সন্ধ্যায় গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা বিষয়টি নিয়ে ইইউ’র সঙ্গে অ্যাঙ্গেইজ থাকবো। নিশ্চয়ই তারা নতুন শিডিউল দিবে।  উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক অংশীদার ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। আমাদের রপ্তানির ২০ শতাংশের বেশি ইইউভুক্ত দেশগুলোতে পাঠানো হয়।
অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে একাধিক বৈঠক স্থগিত: এদিকে উদ্ভূত বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে অস্ট্রেলিয়াও ঢাকার সঙ্গে একাধিক বৈঠক স্থগিত করেছে। গত ২৪ ও ২৫শে জুলাই ফরেন অফিস কনসালটেশন এবং বাণিজ্য বিষয়ক একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। দুটি বৈঠকই শেষ সময়ে এসে স্থগিত করা হয় বলে জানায় সেগুনবাগিচা।

No comments

Powered by Blogger.