হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়া ইরানে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে নিহত হয়েছেন

অত্যাধুনিক গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা করা হয়েছে। সৌদি বার্তা সংস্থা আল হাদাথকে উদ্ধৃত করে এই খবর দিয়েছে অনলাইন বিবিসি। এতে বলা হয়, স্থানীয় সময় রাত দুই টার পর ইসমাইল হানিয়ার ওপর ওই হামলা চালানো হয়। ইরানের বিপ্লবী গার্ডের সাথে সম্পৃক্ত ফারস নিউজ জানিয়েছে, হানিয়া তেহরানের উত্তরাঞ্চলের একটি বাসভবনে অবস্থান করছিলেন এবং তাকে দূর থেকে লক্ষ্যবস্তু করে ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তবে এই প্রতিবেদনটি লেখা পর্যন্ত এখনও বিস্তারিত তথ্য জানা সম্ভব হয়নি।

ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের খবরে বলা হয়, ইসমাইল হানিয়া রাজধানী তেহরানে হামলায় নিহত হয়েছেন। একইসঙ্গে তার দেহরক্ষীদের একজনও নিহত হন।
ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীও হামাসের এ শীর্ষ নেতার নিহত হওয়ার খবর জানিয়েছে। তবে তিনি কীভাবে নিহত হয়েছেন, সে বিষয়ে কোনো বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে মঙ্গলবার তেহরানে গিয়েছিলেন হানিয়া। যে ভবনে তারা অবস্থান করছিলেন, সেখানে হামলা চালানো হলে হানিয়া এবং তার একজন দেহরক্ষী নিহত হন।
এর আগে গত জুনে ইসমাইল হানিয়ার পারিবারিক বাসস্থানে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বিমান হামলা চালায়। সেই হামলায় তার বোনসহ অন্তত ১০ জন নিহত হন।
গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরাইলের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে নজিরবিহীন হামলা চালায় হামাসের যোদ্ধারা, সেসময় হামাসের এই নেতা সহ সংগঠনটির অন্যান্যদেরও হত্যার হুমকি দেয় ইসরাইল। সেই সূত্রে হত্যাকারীদের বিষয়ে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ইসরাইলকেই সন্দেহের প্রথমে রাখতে চাইছে অনেকে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কে এই ইসমাইল হানিয়া। কিভাবে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে বছরের পর বছর ধরে হামাসের নেতৃত্ব দিয়েছেন।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান হিসেবে কাতারে বসবাস করতেন হানিয়া। সেখান থেকেই তিনি হামাসকে পরিচালনা করতেন। ১৯৮০ এর দশকের শেষের দিকে হামাসের র‌্যাডিক্যাল অপারেশনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি।
এছাড়া সেসময় ইসরাইলি বাহিনীর কাছে বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন হামাসের প্রভাবশালী এই নেতা। ১৯৯২ সালে জেল থেকে তাকে হামাসের অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে দক্ষিণ লেবাননের একটি জনমানবশূন্য এলাকায় নির্বাসিত করা হয়। এর এক বছর পর তিনি গাজায় ফিরে আসেন। ১৯৯৭ সালে হামাসের আধ্যাত্মিক নেতা এবং প্রতিষ্ঠাতা শেখ ইয়াসিনের অফিসের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান।

২০০৬ সালে যখন ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ পশ্চিম তীর এবং গাজায় সংসদীয় নির্বাচন করেছিল, তখন হানিয়া হামাসের সংসদীয় নেতা নির্বাচিত হন। সেসময় হামাস নির্বাচনে বিস্ময়করভাবে বিজয় অর্জন করে এবং হানিয়া ‘ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী’ নির্বাচিত হন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের দল ফাতাহ এবং হামাসের মধ্যে এ বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয় এবং তাদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ফলে ২০০৭ সালে প্রেসিডেন্ট আব্বাস হামাস সরকার ভেঙ্গে দেন। হানিয়া আব্বাসের ওই সিদ্ধান্ত না মেনে গাজা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখেন। হানিয়া ২০১৭ সালে গাজা থেকে পদত্যাগ করেন। একই বছর হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান হিসাবে কাজ শুরু করেন তিনি।
তিনি হামাসের প্রধান হওয়ার ৬ বছরের মাথায় গত বছর ইসরাইলে হামলা করে হামাস। যা ইতিহাসে নজিরবিহীন। মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম দেশগুলোর সাথে হানিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল অনেক গভীর। মূলত এ বিষয়গুলোকে আমলে নিয়ে ইসরাইল তাকে টার্গেট করে এবং গাজায় ইসরাইলের হামলায় হানিয়ার তিন ছেলে সহ পরিবারের বেশ কয়েক জনকে নিহত হন। কূটনৈতিক নীতিতে হানিয়া ছিলেন মধ্যপন্থী।

২০১৭ সালে গাজা ত্যাগ করার পর ইয়াহিয়া সিনওয়ার হানিয়ার স্থলাভিষিক্ত হন। ইয়াহিয়া একজন কট্টরপন্থী নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি দুই দশকের বেশি সময় ইসরাইলের কারাগারে বন্দী ছিলেন। ২০১১ সালে গাজায় বন্দী বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে ইয়াহিয়াকে ইসরাইলের কারাগার থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন হানিয়া। এতে তার কূটনৈতিক প্রখরতার প্রমাণ পাওয়া যায়। কাতার ইউনিভার্সিটির ফিলিস্তিন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আদিব জিয়াদেহ তার মৃত্যুর আগে বলেছিলেন, ‘হানিয়া আরব সরকারগুলোর সঙ্গে হামাসের রাজনৈতিক যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। যাতে তার কূটনৈতিক প্রজ্ঞার বিষয়টি স্পষ্ট হয়।’ হামাসের সামরিক শাখার সফলতার পিছনেও হানিয়ার কূটনৈতিক দূরদর্শীতা বেশ কার্যকর ছিল। এছাড়া হানিয়া গাজায় যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নে আরব দেশগুলোর সাথে কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছেন। ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সঙ্গে দেখা করতে নভেম্বরের শুরুতে তেহরান সফর করেন হানিয়া। এছাড়া তিনি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের সাথেও সাক্ষাৎ করেছেন।
যুবক বয়স থেকেই গাজার ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন হানিয়া। তিনি গাজার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রকর্মী ছিলেন। ১৯৮৭ সালে প্রথম ফিলিস্তিনের অভ্যুত্থান শুরু হলে তিনি হামাসে যোগ দেন। সেসময় প্রথম তিনি গ্রেপ্তার হন এবং কিছু সময়ের জন্য নির্বাসিত হন। তখন হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমাদ ইয়াসিনের একজন ঘনিষ্ঠজনে পরিণত হন। এছাড়া ইয়াসিনের পরিবারের সাথেও তার ভালো সখ্যতা গড়ে ওঠে। ১৯৯৪ সালে রয়টার্সকে হানিয়া বলেছিলেন, ইয়াসিন তরুণ ফিলিস্তিনিদের জন্য একজন মডেল ছিলেন। আমরা তার কাছ থেকে ইসলামের প্রতি ভালোবাসা এবং ইসলামের জন্য আত্মত্যাগ শিখেছি এবং দখলদার এবং স্বৈরাচারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করা শিখেছি।

২০০৩ সালে তিনি ইয়াসিনের একজন বিশ্বস্ত সহযোগী হিসেবে পরিচিতি পান। সেসময় ইয়াসিনের সঙ্গে হানিয়ার একটি ছবিও বেশ আলোচনায় এসেছিল। পরে ২০০৪ সালে হামাসের প্রতিষ্ঠাতাকে হত্যা করে ইসরাইল। হামাসের রাজনৈতিক শাখা গঠনে হানিয়ার ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। ১৯৯৪ সালে হানিয়া বলেছিলেন যে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা হামাসকে বাধা বিপত্তি মোকাবিলা করতে আরও সক্ষম করে তুলবে। প্রাথমিকভাবে হামাসের তৎকালীন নেতারা হানিয়ার এ প্রস্তাবে রাজি হননি। পরে ২০০৬ সালে ইয়াসিনের মৃত্যুর দুই বছর পর এ বিষয়ে ঐক্যমত হন হামাস নেতারা। এর এক বছর পরই ফিলিস্তিনি সংসদের নির্বাচনে জয়ী হয়ে হানিয়া ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী হন। এরপর ২০০৭ সালে পুরো গাজা দখলে নেয় হামাস। ২০১২ সালে হামাস সশস্ত্র সংগ্রাম পরিত্যাগ করেছে কিনা রয়টার্সের এক সাক্ষাৎকারে হানিয়াকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, হামাস রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামরিক সহ সকল প্রতিরোধ অব্যাহত রাখবে।

No comments

Powered by Blogger.