‘বন্দুকের গুলি রাজুকে বাসায় ফিরতে দেয়নি’ by বিল্লাল হোসেন রবিন

মোবাইলে স্ত্রীর কল, তুমি কই? আমি বাড়ির সামনেই আছি। সবাই মার্কেটের আগুন দেখতেছে। আমিও সেখানে আছি। তুমি চিন্তা করো না, আমি চলে আসতেছি। কিন্তু বন্দুকের গুলি রাজুকে আর বাসায় ফিরতে দেয়নি। ২১শে জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদী নতুন মহল্লায় ক্যানেলপাড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান মোটর মেকানিক সৈয়দ গোলাম মোস্তফা রাজু (৩৫)।

বুধবার দুপুরে কথা হয় নিহত রাজুর স্ত্রী আকলিমা আক্তারের সঙ্গে। তিনি জানান, বিকাল সাড়ে তিনটা কি পৌনে ৪টায় দুপুরের খাবার খেতে বাসায় আসে রাজু। কয়েকদিন ধরেই চিটাগাং রোডের অবস্থা ভালো না। খাবার খাওয়ার সময়ই আমাদের বাসার জানালা দিয়ে দেখা যায় একটি মার্কেটে আগুন, হইচই বিকট শব্দ। তখন রাজু খাবার শেষ করে ছাদে যায় দেখতে।
আমরা ভাড়াটিয়ারাও কয়েকবার গিয়েছি ছাদে দেখতে। পরে রাজু ছাদ থেকে দেখেন নিচে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে মার্কেটের আগুন দেখতেছে। তখন সেও আগুন দেখতে যায়। কিছুক্ষণ পরেই এলোপাতাড়ি গুলি শুরু হয়। অনেক মানুষ হতাহত হয়েছে। রাজু আহত একজনকে ধরতে গেছে। এমন সময় তার মাথায় গুলি লাগে। ধরাধরি করে তাকে প্রথমে বাসার সামনে নিয়ে আসে। এলাকার পরিস্থিতি তখন ভয়াবহ। কোনোমতে মহল্লার ভেতর দিয়ে একটি অটোরিকশাযোগে সাইনবোর্ড এলাকায় প্রো-অ্যাকটিভ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে সেখান থেকে এম্বুলেন্সযোগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ওইদিনই রাত ১১টায় তার মাথায় অস্ত্রোপচার করার পর বেডে দেয়া হয়। কিন্তু অবস্থার অবনতি ঘটলে রাত ৩টায় আইসিইউতে নেয়া হয়। পরের দিন ২১শে জুলাই রাত দেড়টায় মারা যায় রাজু।

আকলিমা জানান, গুলি খাওয়ার ৫ মিনিট আগে  মোবাইলে রাজু সঙ্গে আমার কথা হয়। আমি বলি তুমি কোথায়। বলে বাড়ির সামনে। সবাই মার্কেটের আগুন দেখতেছে। আমিও সেখানে আছি। তুমি চিন্তা করো না, চলে আসতেছি। এরপরই আমি খবর পাই রাজুর মাথায় গুলি  লেগেছে। আমাকে সামনে যেতে দেয় নাই। আমি কান্নাকাটি করলে যদি তার ক্ষতি হয়। আমার তখন হিতাহিত জ্ঞান ছিল না।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে আকলিমা বলেন, আমার স্বামী অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিল। পাইনাদী নতুন মহল্লায় এবং গ্রামের বাড়িতে দুইটা নামাজে জানাজা হয়েছে। অনেক মানুষ জানাজায় অংশ নিয়েছে। রাজু অনেক পরিশ্রম করতেন। ছোটবেলা থেকেই পরিশ্রমী ছিলেন। সব সময় কাজেকর্মে ব্যস্ত থাকতেন। পরিশ্রমকে অনেক প্রাধান্য দিতেন। বলতেন পরিশ্রম না করলে দুনিয়াতে কোনো কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। গ্রামে তার বাড়ি আর আমাদের বাড়ি পাশিপাশি ছিল। আর ভালো মানুষ দেখেই আমি ওনাকে বিয়ে করেছি। আমাদের বিয়ের ১৪ বছর চলছে। নিজের আপন মানুষ মরে গেলে জীবনে যে অন্ধকার নেমে আসে তা আমি এখন বুঝতেছি। চিন্তা করে কোনো কুলকিনারা পাচ্ছি না। কী করবো, কীভাবে দিন চলবে এই তিন ছোট ছেলে-মেয়েকে নিয়ে। মাথায় কিছু কাজ করে না। এভাবে মানুষটাকে গুলি খেয়ে মরতে হবে কোনোভাবেই মানতে পারছি না। তিন সন্তানকে নিয়ে আমি এখন কী করবো। বুঝতে পারছি না। ভাড়াবাসা তো ছাড়তে হবে। মাসে সব মিলিয়ে ১০ হাজার টাকা বাসা ভাড়া। ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া ও সংসার খরচ কোথা থেকে দিবো আমি।

নিহত রাজুর বড় মেয়ে সৈয়দা আয়শা সিদ্দিকা (১৩), মেঝ ছেলে সৈয়দ রাইয়ান আবদুল্লাহ (১১) ও ছোট ছেলে সৈয়দ আবু বকর সিদ্দিক (৫) পাইনাদী নতুন মহল্লা ও হিরাঝিল এলাকায় মাদ্রাসায় পড়ছে। চার ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট ছিল রাজু। গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জের ১নং কাঞ্চনপুর এলাকার সৈয়দ আব্দুল করিমের ছেলে সে। পাইনাদী নতুন মহল্লায় জনৈক সোরওয়ার্দীর বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ভাড়ায় বসবাস করছেন। গত ২২ বছর ধরে তিনি ওই এলাকায় থাকেন। মোটর মেকানিকের পাশপাশি পুরাতন গাড়ি ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবসা করতেন। ভালোই চলছিল তার সংসার।
আকলিমা আক্তার আরও জানান,  রাজু চলে যাওয়ায় এখন আমার পরিবার ও তার ভাইদের পরিবারও চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে। গ্রামে তার ভাইদের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। রাজু তাদেরও মাঝে মধ্যে আর্থিকভাবে সহায়তা করতেন। আমাদের দুই পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন রাজু। তার মৃত্যুতে সবাই শোকাহত। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে তার ভাইয়েরা।

আকলিমা বলেন, আমি রামগঞ্জ সরকারি ডিগ্রি কলেজ থেকে স্নাতক এবং চাঁদপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছি। আমার স্বামী আমাকে পড়িয়েছে। আমি চাকরি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে রাজি ছিল না। সে বলে আমি তোমার স্বামী। আমি থাকতে তুমি কেন চাকরি করবা। আমি কষ্ট করে হলেও তোমাদের খাওয়াবো। হেলথে আমার চাকরি হয়েছিল তখনো উনি করতে দেয় নাই। এখন আমি যদি কারও কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাই, সুযোগ পাই, আমাকে একটা চাকরি দিবে, তাহলে আমি চাকরি করে আমার ছেলে-মেয়েকে নিয়ে জীবনটা কাটাতে পারবো। হয়তো বাবা হিসেবে রাজু ছেলে-মেয়েকে যেভাবে রাখছে আমি হয়তো মা হিসেবে সেভাবে পারবো না। তবে দু-মুঠো ভাত তাদের মুখে দিতে পারবো। আমি শুধু আমার তিন সন্তানকে নিয়ে মান সম্মানের সঙ্গে বাকি জীবনটা দুইটা ডাল-ভাত খেয়ে কাটিয়ে দিতে চাই। ওদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।

No comments

Powered by Blogger.