বিশৃঙ্খলাকারীরা শ্রীলঙ্কার মতো তাণ্ডব সৃষ্টি করতে চেয়েছিল: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীরা দেশে শ্রীলঙ্কা টাইপ তাণ্ডব সৃষ্টির চেষ্টা করতে চেয়েছিল এবং তারা সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা করেছিল। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা গতকাল প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একথা বলেন। সাক্ষাৎ শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব মো. নাঈমুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। শেখ হাসিনা বলেন, কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক আন্দোলন মোটেও স্বাভাবিক আন্দোলন নয়, বরং এক পর্যায়ে তা প্রায় সন্ত্রাসী হামলায় পরিণত হয়। এটা কোনো সাধারণ আন্দোলন ছিল না। এটা এক পর্যায়ে প্রায় সন্ত্রাসী আক্রমণের মতো হয়ে যায়। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান, অ্যাম্বাসেডর অ্যাট-লার্জ মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন এবং মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক সহিংসতায় জীবন ও সম্পদহানির কথা দুঃখের সঙ্গে উল্লেখ করেন জানিয়ে প্রেস সচিব বলেন, এ সময় ভারতের হাইকমিশনার বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সহিংসতায় জীবন ও সম্পদহানির ঘটনায় শোক জানান। ধারাবাহিকভাবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসাকে স্বাগত জানান প্রণয় ভার্মা। ভারতের হাইকমিশনার বলেন, ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসেবে ভারত সব সময় বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের ভিশন, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধিকে সমর্থন করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফর প্রসঙ্গে প্রণয় ভার্মা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক সফল সফর অর্থবহ ফলাফল অর্জন করেছে এবং যা অতীতের অর্জনকে সুসংহত করেছে এবং ভবিষ্যতে সহযোগিতার একটা ব্লু-প্রিন্ট সৃষ্টি করেছে। হাইকমিশনার বলেন, দুই দেশের যে জাতীয় ডেভেলপমেন্ট ভিশন- ‘বাংলাদেশের ২০৪১ এবং ভারতের ২০৪৭’ ভিশনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সহযোগিতার একটা নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। ডিজিটাল ও গ্রিন অংশীদারিত্ব, স্যাটেলাইটের যৌথ উন্নয়ন, ব্লু ইকোনমি, ওশানোগ্রাফি, ফিনটেকসহ  নতুন নতুন ক্ষেত্রে সহযোগিতা হবে। আঞ্চলিক কানেকটিভিটি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, চার দেশের (বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া, নেপাল ও ভুটান) মধ্যে কানেকটিভিটি জোরালো করার জন্য আমার সব দরজা খোলা।


জানি না অপরাধটা কী ছিল আমার?

এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী সহিংসতার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করতে জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা জাতিসংঘের কাছেও আবেদন করেছি, আন্তর্জাতিকভাবেও বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে দেশে-বিদেশে তাদের কাছেও আমরা সহযোগিতা চাই যে, এই ঘটনার যথাযথ সুষ্ঠু তদন্ত হোক এবং যারা এতে দোষী তাদের সাজার ব্যবস্থা হোক। কারণ, আমি জানি এতে আমার কোনো ঘাটতি ছিল না। গতকাল  রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ-২০২৪’-এর উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন। কোটা বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রাণহানির ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই ঘটনার তদন্তে আমরা ইতিমধ্যেই বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছি। কারণ, দাবির অপেক্ষা আমি রাখিনি। তার আগেই বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করে দিয়েছি। শেখ হাসিনা বলেন, আগে একজন বিচারপতি দিয়ে তদন্ত কমিটি করে দিয়েছিলাম। এখন আরও দু’জন লোকবল বৃদ্ধি করে তাদের তদন্তের পরিধি আরও বাড়ানোর জন্য তার নির্দেশ প্রদানের কথাও জানান তিনি। বলেন, সেই সঙ্গে আমরা জাতিসংঘের কাছেও আবেদন করেছি, আন্তর্জাতিকভাবেও বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে দেশে-বিদেশে তাদের কাছেও আমরা সহযোগিতা চাই যে, এই ঘটনার যথাযথ সুষ্ঠু তদন্ত হোক এবং যারা এতে দোষী তাদের সাজার ব্যবস্থা হোক। কারণ আমি জানি এতে আমার কোনো ঘাটতি ছিল না। শেখ হাসিনা বলেন, যারা আলোচনায় বসেছিল (আন্দোলনকারী) তাদের সঙ্গে বার বার আলোচনা করেছি এবং তাদের দাবি মেনে নিয়েছি। দাবি মানবো কী যেটা আমিই বাতিল করে দিয়েছি। এটা তো আমারই (কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন) ইস্যু করা। আপিল করা হয় আপিল বিভাগে এবং সেখানে হাইকোর্টের রায় (কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন বাতিল) স্থগিত করে দিয়ে আপিল বিভাগ পূর্ণাঙ্গ শুনানির তারিখ নির্দিষ্ট করে দেয়। কাজেই কোটা না থাকায় আমার জারি করা প্রজ্ঞাপনটাই আবার কার্যকর হয়। পরে আপিল বিভাগ থেকে সেটার রায়ও দিয়ে দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই আন্দোলনের নামে যে সমস্ত ঘটনা ঘটেছে, ধ্বংসাত্মক কাজ করা হয়েছে তাতে অনেকগুলো তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। তিনি বলেন, জানি না অপরাধটা কী ছিল আমার? যে ইস্যুটা নেই সেটা নিয়ে আন্দোলনের নামে এই ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ করে দেশের অর্জনকে নষ্ট করা, আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করাতে কে কী অর্জন করলো সেটাই আমার প্রশ্ন? সরকার প্রধান বলেন, তার কাছে ক্ষমতা কোনো ভোগের বস্তু নয়, তিনি তো আরাম আয়েশ করার জন্য ক্ষমতায় আসেন নি। দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন দেশকে একটু উন্নত করতে। যেটা তিনি সফলভাবে করতে পেরেছিলেন। আজকে বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। সেই মর্যাদাকে কেন নষ্ট করা হলো?’ সে প্রশ্ন উত্থাপন করে এর বিচারের ভার তিনি দেশবাসীর কাছে দিয়ে দেন। শেখ হাসিনা দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বলেন, একটা ঘটনা ঘটিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করে দেশকে পেছনে টেনে নেয়ার এই চক্রান্তে যারা জড়িত সেটা আপনাদের খুঁজে বের করা উচিত। তিনি বলেন, ঐ ’৭১-এ যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর ছিল তাদের চক্রান্ত বারবার আমাদের দেশকে পিছিয়ে নিয়ে গেছে। এটা হচ্ছে সব থেকে কষ্টের, সবচেয়ে দুঃখের। জাতির পিতার কন্যা বাকরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, আমি যেহেতু স্বজন হারিয়েছি। স্বজন হারাবার বেদনা আমি বুঝি। তাই যারা আপনজন হারিয়েছেন তাদের প্রতি আমার সহমর্মিতা জানাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস করেছে। স্থাপনা যে ধ্বংস করেছে সেগুলো তো পুনর্গঠন করা যাবে কিন্তু যে প্রাণগুলো ঝরে গেল সেগুলো তো আমরা আর ফিরে পাবো না। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ৭টি ক্যাটাগরিতে ২২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মাঝে ‘জাতীয় মৎস্য পদক-২০২৪’ প্রদান করেন। পুরস্কার হিসেবে ৬টি স্বর্ণ, ৮টি রৌপ্য ও ৮টি ব্রোঞ্জপদক, সম্মাননা স্মারক এবং পুরস্কারের অর্থ প্রদান করা হয়। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে জেলেদের মধ্যে স্মার্ট আইডি কার্ডও বিতরণ করেন। ২২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি মৎস্য চাষে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য প্রধানমন্ত্রীকেও অনুষ্ঠানে স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়। দেশের মৎস্য খাতের উন্নয়নের ওপর একটি প্রামাণ্য চিত্র অনুষ্ঠানে প্রদর্শন করা হয়। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার স্বাগত বক্তৃতা করেন। মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ আলমগীর পুরস্কার প্রদান পর্বটি সঞ্চালনা করেন।

কুর্মিটোলা হাসপাতালে প্রধানমন্ত্রী: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশব্যাপী সাম্প্রতিক সহিংসতায় আহতদের দেখতে গতকাল কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। প্রধানমন্ত্রী বিকাল ৫টার পর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে যান। তিনি সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে হামলার শিকার হয়ে সেখানে চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের অবস্থার খোঁজখবর নেন। আহতদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেন। আঘাতের তীব্রতা দেখে ও হামলার নৃশংসতার কথা শুনে প্রধানমন্ত্রী আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তিনি এ সময় তার চোখের পানি সংবরণ করতে পারেননি। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল পরিদর্শনকালে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইদুর রহমান আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন। এরপরে তিনি মহাখালীস্থ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজিজেস অব দ্য চেস্ট অ্যান্ড হসপিটালে আহতদের দেখতে যান। মঙ্গলবার বিকালে সহিংসতায় আহতদের দেখতে শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। এর আগে, গত কয়েকদিনে প্রধানমন্ত্রী সহিংসতার শিকার অন্যদের দেখতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ট্রমাটোলজি অ্যান্ড অর্থোপেডিক রিহ্যাবিলিটেশন (নিটোর) পরিদর্শন করেন। তিনি আহতদের যথাযথ চিকিৎসার আশ্বাস দেন এবং তাদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন। এ ছাড়াও, প্রধানমন্ত্রী মিরপুর ১০-এ ভাঙচুর হওয়া মেট্রোরেল স্টেশন, বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ভবন, সেতু ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ ভবন এবং মহাখালীতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা পরিদর্শন করেন।

No comments

Powered by Blogger.