কূলভূষণ যাদবের পুনঃবিচার: ভবিষ্যৎ ভারতের হাতে by এম কে ভদ্রকুমার

কূলভূষণ যাদববিষয়ক আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রায় নিয়ে গত ১৮ জুলাই পার্লামেন্টে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের ‘এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা’ হিসেবে অভিহিত করে দেয়া বিবৃতিটি চিন্তার পরিমিতি ও ভাষার সংযমের দিক থেকে মূল্যবান।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রায়টি কেবল ভারত ও শ্রী যাদবের বক্তব্যকে যথার্থ বলে প্রতিপন্ন করেনি, সেইসাথে আইনের শাসন ও আন্তর্জাতিক কনভেনশনগুলোর পবিত্রতায় বিশ্বাসীদের বক্তব্যও প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি এই যুগান্তকারী রায়কে স্বাগত জানান। আইনের শাসনের প্রতি গুরুত্বারোপ করে দুই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ইমরান খান যে বক্তব্য দিয়েছেন, জয়শঙ্করও মূলত তাই বলেছেন।
ভারত যে যাদবকে দায়ী করে পাকিস্তানের সামরিক আদালতের রায়কে বাতিল করতে চেয়েছিল, তাকে মুক্তি দিয়ে ভারতে ফেরত দেয়ার দাবি করেছিল, সে সব বিষয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এড়িয়ে গেছেন। আন্তর্জাতিক আদালত যে ভারতের এসব আর্জি খারিজ করে দিয়েছে, তিনি তা সামনে আনেননি।
এর বদলে এই মামলায় আন্তর্জাতিক আদালতের এখতিয়ার থাকার জোরালো ঘোষণা ও পাকিস্তান যথাযথভাবে বিচার না করার আইসিজের বক্তব্যকেই সামনে এনেছেন। আইসিজের নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর ওপর তিনি আলোকপাত করেছেন
  • যাদবের প্রকৃত আটকের সময়টি ভারতকে অবহিত না করে পাকিস্তান ভিয়েনা কনভেনশনের ধারা লঙ্ঘন করেছ।
  • যাদবের ভারতীয় কনস্যুলার এক্সেস প্রত্যাখ্যান করেছে পাকিস্তান।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আইসিজের রায়ের কিছু দিক তুলে ধরেন:
  • আর বিলম্ব না করে যাদবকে তার অধিকার, তার কাছে ভারতের কনস্যুলার এক্সসেস প্রদান করার বিষয়টি পালন করার বাধবাধকতা রয়েছে পাকিস্তানের।
  • যাদবের রায়টি পুনঃবিবেচনা করতে হবে পাকিস্তানকে, তবে তারা কিভাবে তা করবে তা তাদের ব্যাপার।
  • দণ্ডাদেশ পুনঃবিবেচনার বিষয়টি কার্যকর করতে হবে।
  • এর আগে পর্যন্ত যাদবের মৃত্যুদণ্ডাদেশ স্থগিত থাকবে।
পাকিস্তান তার পক্ষ থেকে দ্রুততার সাথে যেসব কাজ করেছে তা হলো:
  • যাদবকে কনস্যুলার এক্সেস দেবে। তবে কিভাবে তা করা হবে তা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।
  • কনস্যুলার নিয়ে ভিয়েনা কনভেনশনের আওতায় কী কী সুবিধা পাওয়া যাবে, তা যাদবকে জানানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীরাও রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টুইটে বলেন, আমরা রায়কে স্বাগত জানাই। সত্য ও ন্যায়বিচারের জয় হয়েছে। ব্যাপক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে রায় দেয়ায় আইসিজেকে অভিনন্দন। আমি নিশ্চিত কূলভূষণ ন্যায়বিচার পাবে। আমাদের সরকার সবসময়ই প্রতিটি ভারতীয়ের নিরাপত্তা ও কল্যাণের জন্য কাজ করবে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পরদিন বলেন, কমান্ডার কূলভূষণ যাদবকে নির্দোষ হিসেবে ঘোষণা করে তাকে মুক্তি দিয়ে ভারতের কাছে হস্তান্তর না করার রায় দেয়ার আইসিজের রায় প্রশংসাযোগ্য। যাদব পাকস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপরাধে অপরাধী। পাকিস্তান আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
ভারত সরকারের পরোক্ষ মদতপুষ্ট ভারতীয় মিডিয়া যেভাবে হেগের রায়কে জয় হিসেবে তুলে ধরেছে তা নির্বুদ্ধিতা মনে হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরং ইঙ্গিত দিয়েছেন, সামনে অনেক জটিলতা রয়ে গেছে, যাদবের দ্রুত মুক্ত করে ভারতে ফিরিয়ে আনতে হলে দ্বিপক্ষীয় চ্যানেলকে ব্যবহারও করতে হবে।
পাকিস্তানের সামনে যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা হলো তাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা সামরিক আদালতে না বেসামরিক আদালতে বিচার করবে যাদবের। খুব সম্ভবত পাকিস্তান বেসামরিক আদালতেই বিচারকাজ করবে।
সবশেষে বলতে হবে, এটি একটি রাজনৈতিক বিষয়। দুই দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় চ্যানেল বন্ধ থাকায় ভারত আইসিজের দ্বারস্থ হয়। তাছাড়া সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে কথিত গোয়েন্দাদের মামলাগুলো সামাল দিত, নিজেদের মধ্যে তেমন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি ভারত ও পাকিস্তান।
এখন পাকিস্তান যাদবের ফাঁসি কার্যকর করে ফেলতে পারে, এমন ফালতু কল্পনা করা ঠিক হবে না। আসল বিষয় হলো, কিভাবে যাদবের মুক্তি কিংবা পাকিস্তানের কারাগারে জীবনের সবচেয়ে ভালো সময় যাদব কাটাতে পারেন, তা নিশ্চিত করাই আসল বিষয়। আর তা অনেকটাই নির্ভর করছে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ওপর।
সীমান্তে বন্দুকের ব্যবহার হ্রাস পাওয়া, আন্তঃসীমান্তে অনুপ্রবেশ ব্যাপকভাবে কমে যাওয়া, কর্তারপুর সাহিব তীর্থযাত্রা নিয়ে ভারতের দাবি পূরণ করা, ভারতীয় বিমান চলাচল আবার শুরু করা, বাগাড়ম্বড়তা কমে যাওয়ার মতো সাম্প্রতি ঘটনাগুলোর দিকে নজর দিলে বোঝা যাবে যে যাদবের ব্যাপারে ইতিবাচক সময় আসতে চলেছে।
স্পষ্টভাবেই বলা যায়, অচলাবস্থা অব্যাহত থাকলে ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্টে কিছু অস্বস্তি থাকতে পারে। তবে আমি নিশ্চিতভাবেই বিশ্বাস করি, যাদব তার বাড়িতে তার পরিবারের কাছে ফিরতে পারবেন। আশা করি, আসলে কী ঘটেছিল, তা তার বক্তব্য থেকে জানতে পারব।
যাদব সত্যিই কি দেরাদুনের এলিট আইএমএতে ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চৌকষ অফিসার ছিলেন? তিনি যদি তাই হবেন তবে কিভাবে পাকিস্তান সীমান্তের কাছাকাছি থাকা ইরানি বন্দর চাহাবারে গেলেন? তিনি সেখানে কী করছিলেন?
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমরা কি ভারতের কাউকে এই কাজের জন্য দায়ী করে তার বেসামরিক বিচারের ব্যবস্থা করব? উইলিয়াম শেক্সপিয়রের হ্যামলেটে বলা হয়েছে: মানুষের কল্যাণেই কাজ করেন ঈশ্বর।… ঈশ্বরই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন- এমনকি চড়াই পাখির মৃত্যুর মতো তুচ্ছ বিষয়ও।

No comments

Powered by Blogger.