মহাপ্লাবনে তছনছ উত্তরাঞ্চল

উত্তরাঞ্চলের বন্যাকে মহাপ্লাবন বলেছেন অনেকেই। ১৯৮৮ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যাকেও হার মানিয়েছে এবারের বন্যা। ফলে দুর্যোগ চরম আকার ধারণ করেছে। যমুনা, ব্রহ্মপুত্রের পানি ধীর গতিতে কমতে শুরু করলেও এখনো বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নতুন করে আবারো পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে তিস্তা এবং বাঙ্গালী নদীতে। ফলে বাঁধে আশ্রয় নেয়া বন্যার্তরা সহসাই নিজ বাড়িতে ফিরতে পারছে না।
এদিকে চলমান বন্যায় বাঁধ এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে চরম কষ্টে আছে আশ্রিতরা। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে।
উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন বন্যাদুর্গত এলাকা ঘুরে এসব চিত্রই চোখে পড়ছে।
দেশের চলমান বন্যায় উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ জেলাগুলো এখনো পানিতে ভাসছে। বন্যা পরিস্থিতি সব চেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা, ধুনট উপজেলা এবং গাইবান্ধার সাঘাটা, ফুলছড়ি উপজেলায়। এসব এলাকায় বন্যার পানি প্রবেশ করেনি এমন গ্রাম নেই বললেই চলে। বাসস্থান পানিতে তলিয়ে যাওয়া লোকজন বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র এবং উঁচু বাঁধে আশ্রয় নিয়ে গাদাগাদি করে আছে। বানভাসিদের সঙ্গে যোগ হয়েছে গবাদি পশু। মানুষ আর পশু এখন এক সঙ্গে বসবাস করছে। ফলে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে বানভাসিদের জীবন। বিশেষ করে নারী এবং শিশুদের অবস্থা খুব করুণ হয়ে উঠেছে।
এদিকে বন্যা পরবর্তী পানি বাহিত রোগ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে। এসব রোগে বেশির ভাগ আক্রান্ত হতে পারে শিশুরা। যদিও জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া বন্যার্ত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী বিতরণের সময় বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন হলেও রোগ মোকাবেলার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি আছে সরকারের।
তবে বন্যার্ত এসব মানুষদের অভিযোগ সরকারের পক্ষ থেকে মেডিকেল টিম গঠনের কথা বলা হলেও সব জায়গায় এই টিমের উপস্থিতি নেই। অনেকের কাছে গোটা বন্যায় একবারো কোনো ডাক্তার আসেনি। পায়নি ওষুধও।
নারী এবং শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে আছে: জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বন্যা মোকাবেলা করছে উত্তরজনপদের লাখ লাখ মানুষ। তাদের সঙ্গে আরো বেশি জীবনের ঝুঁকিতে আছে শিশুরা। বানভাসি মানুষদের সরজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বগুড়ার বন্যাদুর্গত ইউনিয়ন সারিয়াকান্দির কুতুবপুর, কামালপুর, চন্দনবাইশা, কর্ণিবাড়ি, সোনাতলা উপজেলার মধুপর, তেকানি চুকাইনগর, পাকুল্লা, ধুনটের ভাণ্ডারবাড়ী, গোসাইবাড়ী ইউনিয়ন, গাইবান্ধার সাঘাটা, ফুলছড়ি, গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, সাদুল্ল্যাপুর, পলাশবাড়ী, গোবিগঞ্জের একাংশের কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি জীবন কাটাচ্ছে। এদের একটি বড় অংশ বাঁধ এবং উঁচু অঞ্চলগুলোতে অবস্থান নিয়েছে। এসব বানভাসি মানুষের সবাই কমবেশি মানবেতর জীবন কাটালেও নারী এবং শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে আছে। এদের খাদ্য সমস্যার পাশাপাশি স্বাস্থ্য ঝুঁকি চরম আকার ধারণ করছে। শিশু খাদ্য এবং নিরাপদ পানি না থাকার ফলে সহজেই আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। অপর দিকে সবদিকে অথৈ পানি থাকার ফলে প্রতিনিয়তই এসব এলাকায় পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে।
ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে বন্যার্তরা: চলমান বন্যায় বাঁধে আশ্রয় নেয়া লাখ লাখ অসহায় মানুষ ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে। সরকারি ভাবে যে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে তা সবার কাছে পৌঁছাচ্ছে না। এমন অভিযোগ করছে বন্যার্ত মানুষ।
উত্তরাঞ্চলের বন্যাকে মহাপ্লাবন বলেছে অনেকেই। এই বন্যায় দুর্যোগ চরম আকার ধারণ করেছে পুরো উত্তরাঞ্চলে। পানি ধীর গতিতে কমতে শুরু করলেও এখনো বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে প্রত্যেক নদীর পানি। ফলে বাঁধে আশ্রয় নেয়া বন্যার্তরা সহসাই নিজ বাড়িতে ফিরতে পারছে না। উত্তরাঞ্চলে বাঁধে বিভিন্ন পয়েন্টে আটকে থাকা এসব বানভাসি মানুষ এখন ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে। চলমান বন্যায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের কথা বলা হলেও বগুড়ার প্রত্যন্ত চরের পানিবন্দি মানুষের অভিযোগ, তাদের কাছে কোনো ধরনের ত্রাণসামগ্রী পৌঁছায়নি। বাঁধের আশেপাশে বসবাসকারী বন্যার্ত মানুষের কাছে ত্রাণের প্যাকেট যাচ্ছে। সেই পরিমাণও কম। বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার প্রত্যন্তচরের বানভাসি মানুষের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, ত্রাণের কথা শোনা যায় কিন্তু সেই ত্রাণগুলো কাদের দিচ্ছে সেই কথা তারা জানেন না। কথা হয় সারিয়াকান্দি উপজেলার কামালপুর ইউনিয়নের ঘুঘুমারী গ্রামের জান্নাতুল ফেরদৌসের সঙ্গে। তার ঘরের চাল পর্যন্ত পানি ঠেকেছে। কোনো রকমে বাঁধে একটি ছাপরা ঘর তুলে মাথাগুঁজে আছে। তিনি এখন পর্যন্ত সরকারি বেসরকারি কারো কাছেই ত্রাণ পাননি।
এদিকে যমুনায় অব্যাহত পানি বৃদ্ধির কারণে বগুড়ার নদী তীরবর্তী সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ৩০ হাজার পরিবারের লক্ষাধিক মানুষ। বন্যায় আক্রান্ত এই পরিবারগুলোর মধ্যে ৩ হাজার পরিবার আশ্রয় নিয়েছে বিভিন্ন নিরাপদ স্থানে। এ ছাড়াও সাঘাটার জুমারবাড়ি, ডাকবাংলা, কচুয়া, উল্লাভরতখালি, উদয়খালি, বাদিয়াখালি এলাকার বাঁধগুলোতে আশ্রয় নেয়া বন্যার্তদের বেশির ভাগ মানুষ ত্রাণ পায়নি বলে অভিযোগ করেছে। অপরিচিত কোনো ভদ্রমানুষ এসব এলাকায় প্রবেশ করলেই ত্রাণের আশায় তাদের কাছে ছুটে যাচ্ছে বানভাসিরা।
যদিও গাইবান্ধার বিভিন্ন দুর্গত এলাকা পরিদর্শন কালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেছেন, সরকারের হাতে পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী মজুত রয়েছে। যতদিন প্রয়োজন ত্রাণ দেয়া হবে।
প্রস্তুত ছিল না উঁচু অঞ্চলের মানুষ: সারা দেশের দৃষ্টি এখন গাইবান্ধার দিকে। দেড় সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলমান বন্যায় কয়েকটি সড়ক এবং সেতু ভেঙে গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা, গোবিন্দগঞ্জ ও সাদুল্ল্যাপুর উপজেলায় বন্যা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এই জেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় আট লাখ মানুষ। সেখানকার বন্যা পরিস্থিতি সম্পর্কে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী জাহিদ খন্দকার জানান, বাঁধ ভাঙার ফলে বোনারপাড়া, পদুমশহর, পশ্চিম কচুয়া, পূর্ব কচুয়া, শ্যামপুর, ঘুড়িদহ, কামালেরপাড়া, জুমারবাড়ি, বারকোনা, বটতলা বাজার, মথরপাড়া এলাকায় হঠাৎ করেই বন্যার পানি প্রবেশ করে। মূলত এসব উঁচু এলাকায় সহজে বন্যার পানি প্রবেশ করে না। ফলে এসব এলাকার মানুষ বন্যা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত ছিল না। ভরতখালি এলাকায় বাঁধ ভাঙার ফলে মূলত এসব এলাকায় পানি প্রবেশ করেছে। আর পানি এতো বেশি যে, রাস্তাঘাট, স্কুল কলেজ এবং ঘরবাড়ি সব কিছু পানির নিচে। এতে পুরো গাইবান্ধার সঙ্গে অন্যা জেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এদিকে নতুন করে বাঙ্গালী নদীর পানি বগুড়া পয়েন্টে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সোনাতলা উপজেলার পশ্চিম অংশে পানি প্রবেশ করছে। উপজেলার সবগুলো সড়কপথ পানির নিচে চলে গেছে।
বিশুদ্ধ পানি এবং পয়ঃনিষ্কাশন সমস্যা: দিন যাচ্ছে বন্যার্ত মানুষের আর্তনাদও বাড়ছে। পর্যাপ্ত খাবার, ওষুধ এবং জ্বালানি সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে। চরম সংকট দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির। বন্যাদুর্গত এসব এলাকার সবগুলো টিউবওয়েল পানির নিচে তলে যাওয়ায় এই সংকট দেখা দিয়েছে। অপর দিকে পয়ঃনিষ্কাশনের কষ্ট বানভাসিদের বেশি পীড়া দিচ্ছে। থাকার জায়গা সংকুলান হচ্ছে না সেখানে টয়লেট স্থাপনের সুযোগ একেবারেই কম। সরকারিভাবেও কোথাও চোখে পড়েনি বন্যার্তদের জন্য টয়লেট স্থাপন।

No comments

Powered by Blogger.