মার্কিন-আফগান যুদ্ধে মারাত্মক ক্ষতি স্বীকার করেছে পাকিস্তান by ড. জাফর নওয়াজ জসপাল

আফগানিস্তানের পরিস্থিতি জটিল ও সহিংস। যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানদের মধ্যে যে শান্তি আলোচনা চলছে, সেটা অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া নিয়ে ঘানি সরকার হতাশ এবং তারা বিকল্পের সন্ধান করছে। পাকিস্তান আফগানিস্তানের সাথে তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়ন করতে হিমশিম খাচ্ছে এবং একই সাথে তারা দেশটির শান্তি প্রক্রিয়াকে সমর্থন দিচ্ছে। আফগান তালেবানদের সাথে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর যোগাযোগের কারণে তারা বৈধতা পেয়েছে এবং সে কারণে তারা প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির নেতৃত্বাধীন ঐক্য সরকারকে তেমন পাত্তা দিচ্ছে না।
দেশের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার কারণে ভারতসহ আঞ্চলিক শক্তিগুলোরও ভূমিকা রয়েছে। তাছাড়া, আফগানরা যুদ্ধের কারণে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েলেও সংলাপ প্রক্রিয়ার ব্যাপারে তাদের অতটা আকর্ষণ নেই। অস্ত্রবিরতির ব্যপারে তালেবানদের অনীহা রয়েছে এবং প্রেসিডেন্ট ঘানি সরকারের সাথে আলোচনার ব্যাপারেও তাদের আগ্রহ নেই। এমনকি সম্প্রতি লয়া জিরগায় যে শান্তি আলোচনা হয়েছে, সেটাও আফগানিস্তানের পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারেনি।
২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে অর্ধেক সেনা ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এতে করে যুদ্ধের সমাপ্তির ব্যাপারে সতর্ক আশাবাদ তৈরি হয়েছে। যদিও সবাই আফগান-কর্তৃত্বাধীন ও তাদের নেতৃত্বাধীন সমঝোতা প্রক্রিয়াকে সমর্থন দিচ্ছে, এরপরও আফগান তালেবানরা প্রেসিডেন্ট ঘানি সরকারের সাথে সরাসরি আলোচনার ব্যাপারে আগ্রহী নয়।
আমেরিকানরা এটুকু বুঝতে পেরেছে যে তালেবানদের আলোচনায় না আনলে আফগানিস্তানে শান্তি অসম্ভব। সে কারণে ট্রাম্প প্রশাসন দীর্ঘদিনের মার্কিন নীতিকে একেবারে উল্টে দিয়েছেন। অর্থাৎ, আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে যে কোন আলোচনা হতে হবে তালেবান ও আফগান সরকারের মধ্যে – এই নীতিটি এখন বদলে গেছে। একই সাথে তারা আফগান তালেবানদের দাবিও মেনে নিয়েছে।
আফগানিস্তানে ১৮ বছরের যুদ্ধের সমাপ্তি টানার জন্য তারা এখন তালেবানদের সাথে সরাসরি আলোচনা করছে এবং আফগান সরকারকে সেখানে তারা জড়ায়নি। আবু ধাবি এবং দোহাতে যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানদের মধ্যে যে সরাসরি আলোচনা হয়েছে, তার মাধ্যমে আফগানিস্তানের ন্যাশনাল ইউনিটি সরকারের শক্তিহীনতার বিষয়টি প্রকাশিত হয়ে গেছে।
আফগান শান্তি প্রক্রিয়া
আফগানিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন বিশেষ দূত জালমাই খালিলজাদ তালেবানদের সাথে সাত দফা আলোচনা করেছেন কিন্তু তাদেরকে অস্ত্রবিরতি রাজি করাতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে আলোচনা চলছে, সেখানে আফগানিস্তানের নির্বাচিত সরকারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। শান্তি প্রক্রিয়ায় আমেরিকা কার্যত প্রেসিডেন্ট ঘানিকে দূরে সরিয়ে রেখেছে।
২৯ এপ্রিল তিনি চার দিনের পার্লামেন্টের শান্তি অধিবেশন ডেকেছিলেন। সেখানে তিনি চলমান শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন এবং শান্তি আলোচনায় নিজেকে আফগানিস্তানের বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, “এটা আমার জন্য একটা গর্বের মুহূর্ত কারণ পুরো দেশ থেকে প্রতিনিধিদের এখানে পেয়েছি আমি, এবং আজ আমরা জড়ো হয়েছি শান্তি নিয়ে আলোচনার জন্য”।
এই জিরগাকে খুব একটা গুরুত্বের সাথে দেখছেন না আফগানিস্তান বিষয়ক পর্যবেক্ষকরা কারণ তালেবানরা এতে অংশগ্রহণের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে এবং অন্যদেরকেও তারা এটা বয়কট করতে বলেছে। তালেবান মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেছেন, “জিরগার নামে শত্রুর ষড়যন্ত্রে অংশ নিবেন না, বরং কাবুলের নড়বড়ে প্রশাসনকে দূরে সরিয়ে রাখার উপায় খুঁজে বের করুন”।
উপরন্তু, সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইসহ বিরোধী রাজনীতিবিদ ও সরকারের সমালোচকরা জিরগা বয়কট করেছেন। আফগানিস্তানে যে অসম যুদ্ধ চলছে সেটা পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর। ঐতিহাসিকভাবে ২০০১ সালে তালেবান সরকারের পতনের পর আল কায়েদার নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট পাকিস্তানের ফেডারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইবাল এরিয়া এবং শহুরে এলাকাগুলোতে নিরাপদ ঘাঁটি গাড়ার সুযোগ পায়।
তারা পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়েছে এবং গত ১৭ বছরে ৭৫০০০ নিরপরাধ নাগরিক ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যকে হত্যা করেছে। পাকিস্তানের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে গেছে এবং আন্তর্জাতিকভাবে তাদের ইমেজ ক্ষুণ্ন হয়েছে। সে কারণে ইসলামাবাদ আফগানিস্তানের বর্তমান বিশৃঙ্খলা এবং ওয়াশিংটনের সেনা প্রত্যাহারের পরিকল্পার ব্যাপারে যথেষ্ট সজাগ।
১১ জুন আফগান ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইদ্রিস জামান ইসলামাবাদ সফর করেন এবং প্রথমবারের মতো আফগানিস্তান-পাকিস্তান অ্যাকশান প্ল্যান ফর পিস অ্যান্ড সলিডারিটি (এপিএপিপিএস) চুক্তির পর্যালোচনা করেন। ৪ জুন প্রেসিডেন্ট ঘানি ঘোষণা দেন যে ২৭ জুন তিনি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়নের জন্য পাকিস্তান সফর করবেন। আর এটা সত্য যে, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে বর্তমান উচ্চ পর্যায়ের বিনিময় দুই দেশের সম্পর্কের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
>>>ড. জাফর নওয়াজ জসপাল ইসলামাবাদের কায়েদে আজম ইউনিভার্সিটির স্কুল অব পলিটিক্যাল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রিলেশান্সের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর

No comments

Powered by Blogger.