দেশজুড়ে খ্যাতি কুড়াচ্ছে ঘোড়াশালের আনারস

ঘোড়াশালে আনারসের এবার বাম্পার ফলন হয়েছে। স্বাদ ও গুণগত মানের কারণে সারা দেশে খ্যাতি কুড়াচ্ছে নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ঘোড়াশালের আনারস। নরসিংদীর একটি প্রবাদ আছে, ঘোড়াশালের রাবানের আনারস রসে টস টস। আনারস উৎপাদনের দিক থেকে  ঘোড়াশাল বাংলাদেশের প্রসিদ্ধতম স্থান হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। ঘোড়াশাল পৌর এলাকার সিংহভাগ ও জিনারদী ইউনিয়নের প্রায় তিন চতুর্থাংশ জমি আবহাওয়ার দিক থেকে আনারস চাষের উপযোগী। এ এলাকার কৃষকদের প্রধান অর্থকরী ফসল হচ্ছে আনারস। আনারস অন্যতম প্রধান রসাল, সুস্বাদু ও সুমিষ্ট ফল। এসব এলাকার অধিকাংশ মানুষের জীবিকা নির্বাহ ও অর্থকরী ফসল হচ্ছে একমাত্র আনারস চাষ।
প্রায় ১৫০ বছর আগে ঘোড়াশালে দেশীয় জাতের আনারসের চাষ হতো। ঘোড়াশালে চাষকৃত আগের দেশীয় প্রজাতির আনারস তেমন মিষ্টি ও সুস্বাদু ছিল না। দেশীয় প্রজাতির আনারস ঘোড়াশালে প্রায় ১৫০ বছর যাবৎ চাষাবাদের ফলে ধীরে ধীরে এ জাতটির গুণগতমান ও গঠনগত আকৃতি লোপ পায়। ঘোড়াশালের জনৈক ব্যক্তি সিলেটে বেড়াতে গেলে সেখান থেকে একটি আনারসের চারা রোপণ করে ঘোড়াশালের ব্যাপক প্রসার ঘটান। পরবর্তীতে ঘোড়াশালে দেশীয় প্রজাতির আনারসের জাতটির বিলুপ্ত ঘটে। সিলেট চাষকৃত আনারসের জাতটি সিলেটের আবহাওয়ায় তেমন খাপ খেতে পারেনি। ফলে আবহাওয়ার কারণে সিলেটে চাষকৃত আনারসটি তেমন সুস্বাদু ও মিষ্টি ছিল না। সিলেটের আনারসের এই জাতটি ঘোড়াশালের আবহাওয়া ও মাটির সঙ্গে খাপ খেলে এবং আনারস চাষে অনুকূল আবহাওয়া থাকায় গঠনগত স্বাদের দিক দিয়ে আনারসটির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। প্রায় ৪০ বছর আগে সিলেটের আনারসের এ জাতটি ঘোড়াশালে আসে। ঘোড়াশালে আনারস চাষের জন্য আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ৪০ বছরে এ জাতটি ঘোড়াশালে ব্যাপক সফলতা লাভ করে এবং এর ব্যাপক প্রসার ঘটে। ঘোড়াশালে চাষকৃত সিলেটের এ প্রজাতির আনারসের জাতটি ঘোড়াশালে জলডুগি আনারস নামে সর্বমহলে পরিচিতি লাভ করে। এর বৈজ্ঞানিক নাম হলো হানিকুইন। টেঙ্গর এলাকার জমিতে আনারস চাষে ভালো ফলন হয়ে থাকে। এক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়- প্রতি একর জমিতে প্রায় ১৮ হাজার আনারসের চারা রোপণ করা হয়। এই এলাকায় ১৫০ হেক্টর জমিতে আনারসের চাষ হয়। আনারস চাষের এলাকাগুলো হচ্ছে- রাবান, কুড়াইতলী, বড়িবাড়ি,  কাটাবের, বরাব, ধলাদিয়া, গোবরিয়াপাড়া, লেবুপাড়া, সাতটিকা,  ও চরনগরদী। আনারস চাষি রাখাল চন্দ্র দাস ৬ বিঘা জমিতে ও বিমল সেন ৮ বিঘা জমিতে আনারস চাষ করেন। তাদের সাথে আলাপ করে জানা যায়- তারা প্রায় ৩২ বছর ধরে আনারসের চাষ করে আসছে। তারা জানায়, প্রতি বিঘা জমিতে আনারস চাষে ১৫ হাজার টাকা খরচ হলে আনারসের ফলন ভালো হলে প্রতি বিঘার আনারসে বিক্রি হয় প্রায় ৬৫/৭০ হাজার টাকা। এতে দেখা যায় লাভ হয় বহু গুণ। অনেক লোক আনারস চাষ করে বহু সম্পদের মালিক হয়েছেন।  ঘোড়াশালের আনারস চাষ দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। আনারসের ফলন ভাল হলে প্রতি বছর আনারসে ঘোড়াশাল আয় হয় প্রায় ১২ কোটি টাকা। প্রতি একর জমিতে প্রায় ১৮ হাজার আনারসের চারা রোপণ করা হয়। ঘোড়াশালে পর্যাপ্ত পরিমাণ আনারস উৎপন্ন হয়। কৃষকরা জানায়, আনারস পচনশীল ফল হিসেবে এর সংরক্ষণ ব্যবস্থা থাকা দরকার। আনারস সংরক্ষণের জন্য ঘোড়াশালে কোনো হিমাগার আজও পর্যন্ত তৈরি হয়নি। কৃষকরা আনারস সংরক্ষণের জন্য একটি হিমাগার স্থাপনের জন্য সংশিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট দাবি জানান। ঘোড়াশালে আনারস চাষে চাষিদের মনোবল রয়েছে পর্যাপ্ত। আধুনিক সভ্যতার যুগে এখনও ঘোড়াশালে সনাতন পদ্ধতির মাধ্যমেই আনারসের চাষ হচ্ছে। আনারস চাষিরা জানান, আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আনারস চাষ করলে আরও অধিক ফলন হতো এবং দেশও অর্থনৈতিকভাবে একটু লাভবান হতো। এ ব্যাপারে পলাশ উপজেলা কৃষি অফিসার মো. আমিরুল ইসলাম জানান, এ বছর পলাশে ১৫০ হেক্টর জমিতে আনারস চাষ হয়েছে। গত বছর অতি খরায়  আনারসের আকার ছোট ছিল। কিন্তু এবার বৃষ্টি হওয়াতে আনারসের আকার বড় হয়েছে। প্রতি হেক্টরে ২০ টন আনারসের ফলন হয়েছে। ৮শ’ গ্রাম থেকে দেড় কেজি পর্ষন্ত একটা আনারসের ওজন হওয়ায় কৃষকরা এ বছর অধিক লাভের মুখ দেখতে পাবে। এ বছর ১৫৯৫ মে.টন আনারস উৎপাদন হয়েছে পলাশে।  ঘোড়াশালের আনারস দেশের মধ্যে সুস্বাদু আনারস হিসেবে পরিচিত বলে এর চাহিদা ব্যাপক। সারা দেশে এ আনারসের নাম ঘোড়াশাল আনারস হিসেবে সবাই চিনে বলে কৃষি অফিসার জানান। তিনি আরো জানান অল্প সময়ে অধিক ফলন ও ব্যাপক লাভবান হওয়ায় মানুষ এ আনারস ফলনের দিকে আগ্রহ দেখাচ্ছে। আগামী বছর থেকে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আমরা জাইকার অর্থায়নে কৃষকদের আরো উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবো।

No comments

Powered by Blogger.