দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বাস্তবায়নে জোর- চীন, রাশিয়া, ভারত ও জাপানের ভূমিকা চায় বাংলাদেশ

বর্বর নির্যাতন করে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দেয়ার কারণে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদের শক্ত পদক্ষেপ চেয়েছিল ঢাকা। এ নিয়ে জোরালো আহ্বান ছিল পরিষদ প্রতিনিধি দলের সমন্বিত এবং নজিরবিহীন ঢাকা সফরে। কিন্তু সফরকারী দূতরা কাঙিক্ষত সেই পদক্ষেপের ‘সুনির্দিষ্ট’ অঙ্গীকার ছাড়াই ঢাকা ছেড়েছেন। গতকাল সকালে মিয়ানমারের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগে বিমানবন্দরে সমাপনী তবে সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে প্রতিনিধিদল সংকট সমাধানে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়নেই জোর দিয়েছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্পাদিত ওই প্রত্যাবাসন চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়নই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বললেন- রোহিঙ্গা ইস্যুটি জাতিসংঘের অগ্রাধিকারে রয়েছে। এটি থাকবে। মিয়ানমার সফর করে নিউ ইয়র্কে ফিরে তারা এ সংকট সমাধানে একটি কার্যকর পথ খুঁজবেন। এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিনিধিদল জানায়- রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে সব সদস্য রাষ্ট্র একমত। এ ইস্যুতে চীন-রাশিয়ার পক্ষ থেকেও কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। প্রতিনিধিদলটি ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে। গণভবনের ওই বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীন, রাশিয়া, ভারত ও জাপানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রত্যাশা করেন প্রধানমন্ত্রী। গত শনিবার প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশে আসে। তিন দিনের সফরে দলটির সদস্যরা কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলাস্থ কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেন। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির কোনারপাড়ায় শূন্যরেখায় যান। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তারা কথা বলেন।
নিরাপত্তা পরিষদের বাংলাদেশ সফরকে ইতিবাচক অগ্রগতি আখ্যা দিলেও ঢাকা মনে করে- পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য একমত হতে না পারায় এখনই মিয়ানমারের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে না তারা। তবে এ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে কীভাবে সহযোগিতা করা যায়, সে জন্য জোরালো চেষ্টা থাকবে পরিষদের।
বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে যা বললেন প্রতিনিধিরা: ৩ দিনের বাংলাদেশ সফরের কর্মসূচি শেষে বিমানে ওঠার আগে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিরা। সেখানে জাতিসংঘে নিযুক্ত কুয়েতের স্থায়ী প্রতিনিধি মনসুর আয়াদ আল-ওতাইবি বলেন, সংকটটি গুরুতর। এটির সমাধান করতেই হবে। এটি জাতিসংঘের অন্যতম অগ্রাধিকারের বিষয় হিসেবে আমাদের আলোচ্য সূচিতে রয়েছে এবং থাকবে। তার ভাষায়- “যে বার্তা আমরা মিয়ানমার, রোহিঙ্গা শরণার্থী আর পুরো বিশ্বকে দিতে চাই, তা হলো এই সংকটের অবসান ঘটাতে এবং সমাধানের একটি পথ খুঁজে বের করতে আমরা বদ্ধপরিকর। এ বিষয়ে আমরা চুপ থাকতে পারি না। নিউ ইয়র্কে ফিরে গিয়ে আমরা বসবো। শরণার্থীদের স্বেচ্ছায়, সসম্মানে, নিরাপদে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে, তার বাস্তবায়ন কীভাবে দ্রুত করা যায় তা আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করব। আপাতত এই বার্তাই আমরা দিতে চাই। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সরজমিন দেখতে নিরাপত্তা পরিষদের বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফরের অন্যতম আয়োজক কুয়েতের স্থায়ী প্রতিনিধি মনসুর আয়াদ আল-ওতাইবি। তিনি সংকটের দ্রুত সমাধানের কোনো আশা দেখাতে পারেননি। বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত মনসুর বলেন- “আমরা এখানে বাস্তুচ্যুতদের যে অবস্থা দেখেছি তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এ সংকটের একটা সমাধান আমরা দেখতে চাই।
এই সমাধান খুব দ্রুত আসবে না। সেজন্য সময় প্রয়োজন। আমরা আশা করি, দ্বিপক্ষীয় চুক্তিটি দ্রুত বাস্তবায়িত হবে।” তিনি এ-ও বলেন ‘আমি চীন ও রাশিয়ার পক্ষ থেকে কোনো প্রতিবন্ধকতা দেখছি না। তারা আমাদের সঙ্গে আছেন। তারাও একটি সমাধান দেখতে চান।’ এক প্রশ্নের জবাবে এটি একটি মানবিক সংকট এবং মানবাধিকারের বিষয় উল্লেখ করে কুয়েতের দূত বলেন, কেউ কাউকে (মিয়ানমার) রক্ষা করছে না। তারা শুধু আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার বাস্তবায়ন দেখতে চাইছেন। যত দ্রুত সম্ভব সংকটটির সমাধানের সব পক্ষকে অবশ্যই অঙ্গীকার প্রদর্শন হবে। বাংলাদেশের উদারতার ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি বলেন, প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার জন্য বাংলাদেশের জনগণ তাদের দরজা এবং হৃদয় খুলে দিয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘে পেরুর রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধিদলের নেতা গুস্তাভো অ্যাডোলফো মেজা কুয়াদ্রা বেলাসকেজ এবং জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধি কারেন পিয়ার্স বক্তব্য রাখেন। সংকট সমাধানের ধীরগতির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা প্রায় অভিন্ন সুরে বলেন, “এ বিষয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন। আমাদের মহাসচিব ইতিমধ্যে একজন বিশেষ দূত নিয়োগ করেছেন। আলোচনা শুরু হয়েছে এবং এই আলোচনা অব্যাহত থাকবে।” সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা শেষে প্রতিনিধিদলটি মিয়ানমারের রাজধানীর উদ্দেশে যাত্রা করেন। সেখানে তারা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা এবং রাখাইন রাজ্য সফর করবেন। ২রা মে সফর শেষে নিউ ইয়র্কে ফিরে গিয়ে তারা তাদের প্রতিবেদন জমা দেবেন। এর আগে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ প্রতিনিধিদলটি শনিবার বাংলাদেশ আসেন এবং রোববার কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় রোহিঙ্গারা তাদের অধিকার ও নিজ দেশ মিয়ানমারে নিরাপদে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রতিনিধিদলের কাছে আবেগপূর্ণ আবেদন জানান।
চীন রাশিয়া ভারত জাপানের বড় ভূমিকা চান প্রধানমন্ত্রী: এদিকে গণভবনে নিরাপত্তা পরিষদ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন- রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীন, রাশিয়া, ভারত ও জাপানের কাছ থেকে বড় ভূমিকা আশা করছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের সবচেয়ে ক্ষমতাধর পর্ষদ হিসেবে বিবেচিত নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ দেশের প্রতিনিধিসহ ৪০ সদস্যের এই প্রতিনিধি দলের সদস্যরা রোববার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে দেখে সোমবার বিদায় নেয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন। তাদের এই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে রয়েছেন নিরাপত্তা পরিষদের চলতি মাসের সভাপতি গুস্তাভো আদোলফো মেসা কুয়াদ্রা ভেলাসকাস। রোহিঙ্গা সংকটের গভীরতা বুঝতে বাংলাদেশ থেকে সোমবার তারা মিয়ানমারে যাচ্ছেন। গণভবনের বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। বলেন, “প্রধানমন্ত্রী নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদের বলেছেন, ‘চীন, রাশিয়া, ভারত ও জাপান এই সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেই প্রত্যাশা করে বাংলাদেশ। এ সমস্যার সমাধানে চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, লাওসসহ মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনার কথাও বৈঠকে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। প্রেস সচিব বলেন, “প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর জোরালো চাপ সৃষ্টির জন্যও আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার যে চুক্তি করেছে সে অনুযায়ী মিয়ানমারের কাজ করা উচিত বলেও বৈঠকে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা। গত বছরের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সেনা অভিযান শুরুর পর দলে দলে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে বাংলাদেশ সীমান্তে। মানবিক কারণে সীমান্ত খুলে দিয়ে তাদের আশ্রয় দেয় বাংলাদেশ সরকার। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মুখে মিয়ানমারের সৈন্যদের বিরুদ্ধে নির্বিচারে হত্যা, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া ও ধর্ষণের অভিযোগ উঠে আসে। জাতিসংঘ কর্মকর্তারা একে জাতিগত দমন অভিযান হিসেবে বর্ণনা করেন। আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের সমালোচনার মুখে মিয়ানমার সরকার এই শরণার্থীদের ফেরত নিতে গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও তাতে কোনো অগ্রগতি নেই। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা এবং তাদের কাছে জরুরি সহায়তা পৌঁছে দিতে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় যে ভূমিকা রেখেছে বৈঠকে তার প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের উপ-স্থায়ী প্রতিনিধি কেলি কারি বৈঠকে বলেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার মাধ্যমে মানবিক দিক থেকে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের জন্য নতুন একটি নজির বেঁধে দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। চীনের প্রতিনিধি উ হাইতাও বলেন, তার দেশ এই সংকটের সমাধানে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে। রাশিয়ার প্রতিনিধি দিমিত্রি পোলিয়ানস্কি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনের কথা উল্লেখ করে রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধানেও বাংলাদেশকে সমর্থন অব্যাহত রাখার আশ্বাস দেন। প্রেস সচিব বলেন, “প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ সংঘাত চায় না এবং এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা করছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মিয়ানমার সফর এবং মিয়ানমানের সমাজকল্যাণমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের কথা তিনি বৈঠকে তুলে ধরেন এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হওয়ার ওপর জোর দেন। নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আওতায় আনার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার চাপে কক্সবাজারে স্থানীয়রা ভোগান্তিতে পড়েছে; পরিবেশ ও বনভূমির ক্ষতি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বর্ষায় আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা রোহিঙ্গাদের দুর্দশা বাড়ার আশঙ্কার কথা নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদের সামনে তুলে ধরেন এবং ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তোলার কথা তাদের বলেন। নিরাপত্তা পরিষদ প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর পাশে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী, প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান, পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.