এবারও বন্যার আশঙ্কা, সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ by শফিকুল ইসলাম

এ বছরও বন্যার আশঙ্কা করছে সরকার। এর আগে দেশের ২০ থেকে ২২টি জেলায় বন্যায় প্লাবিত হলেও এবার আরও বেশি জেলায় বন্যা হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ বছর বর্ষা মৌসুমে দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৩৭ জেলায় বন্যার আশঙ্কা রয়েছে বলে আবহাওয়া অধিদফতর পূর্বাভাস দিয়েছে। অতি বৃষ্টি ও ভারী বৃষ্টির কারণে এ সব জেলায় বন্যার সৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। এ পূর্ব প্রস্তুতির অংশ হিসেবে গত সপ্তাহের পাঁচ দিনই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ্ কামাল। ওই বৈঠকে সেনা বাহিনী ও নৌ বাহিনীর কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। মঙ্গলবারও (১ মে) বৈঠক করে  ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। বৈঠকে বন্যাসহ যেকোনও দুর্যোগ মোকাবিলায় সেনাবাহিনী ও নৌ-বাহিনীকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জরুরি বার্তা দেওয়া হয়েছে দেশের ৬৪ জেলা প্রশাসককের কাছে। তাদের বন্যাসহ যেকোনও দুর্যোগ মোকাবিলায় সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সচিব বাংলা ট্রিবিউনকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
বন্যার সময় জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব জেলার ডিসির ত্রাণ ভাণ্ডারে দুই লাখ টন চাল, নগদ ৫ লাখ টাকা ও দুই বান্ডিল ঢেউটিন দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে শীতের কম্বল দেওয়া হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থা অধিদফতরে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। জেলা উপজেলার স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসার ভবনগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখার জন্য বলা হয়েছে, যেন বন্যা দেখা দেওয়া মাত্রই বন্যাকবলিত মানুষ জনকে আশ্রয় দেওয়া যায়।
এ বছর বর্ষা মৌসুম আসার আগেই দেশব্যাপী অতিবর্ষণ ও ভারীবর্ষণ শুরু হয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে,  আগামী ৪ থেকে ৭ মে—এই চারদিন দেশের বিভিন্ন জেলায় ভারী বর্ষণের আশঙ্কা রয়েছে। অতিবর্ষণে পাহাড়ধসেরও আশঙ্কা রয়েছে। গতবছর পাহাড়ধসে পার্বত্য অঞ্চলে ১৬৬ জন মারা গেছেন। অতি বর্ষণ ও ভারী বর্ষণে এ বছরও পাহাড় ধসের আশঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম,  রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এই পাঁচ জেলায় জরুরি সভা করে  গত ২২ এপ্রিল থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত এই পাঁচ দিন টানা বৈঠক করে জরুরি করণীয় নির্ধারণ করেছেন।
এদিকে গত ২৯ ও ৩০ এপ্রিল—এই দুই দিনে ঢাকায় ১৪৬ মিলিমিটার, সন্দ্বীপে ৯৯ মিলিমিটার, টাঙ্গাইলে ১০৭ মিলিমিটার, সীতাকুণ্ডে ১১২ মিলিমিটার, রাঙামাটিতে ১১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বৃষ্টিপাতের এই প্রবণতা স্বাভাবিক নয় বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। এ কারণে অধিক বৃষ্টিপ্রবণ জেলাগুলোর ডিসিদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ইতোমধ্যেই অতি বৃষ্টির ফলে নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ ও সুনামগঞ্জসহ হাওর অঞ্চলে বন্যার আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় ওই সব অঞ্চলের মাঠের ফসল কেটে ঘরে তোলার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কৃষকরা যেন মাঠের ফসল জরুরি কেটে ঘরে তুলে আনেন, সেজন্য জেলা প্রশাসকের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে জেলাপ্রশাসকদের তত্ত্বাবাধানে মাইকিং করা হয়েছে। তাই এসব জেলার কৃষকরা ক্ষেতের ধান কেটে ঘরে তুলে এনেছেন।
এসব জেলার ডিসি অফিসের বরাত দিয়ে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যেই হাওর অঞ্চলের ৮৮ শতাংশ মাঠের ফসল কেটে নেওয়া হয়েছে। এবছর এ সব জেলায় বাম্পার ফলন হয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, অতি বর্ষণ ও ভারী বর্ষণের সঙ্গে রয়েছে অতিরিক্ত শিলা বৃষ্টি। আগে বৃষ্টির সঙ্গে মার্বেল সাইজের শিলা বর্ষিত হলেও এবছর অনেক বড় সাইজের শিলাও বর্ষিত হয়েছে। এতে টিনের ঘরের চাল ছিদ্র হয়ে মানুষের গায়ে পড়েছে। মানুষ আহত হওয়ার সংবাদও পাওয়া গেছে। এর সঙ্গে নতুন করে দুর্যোগ হিসেবে যুক্ত হয়েছে বজ্রপাত। আবহমান কাল ধরেই বজ্রপাত একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বর্তমানে বজ্রপাতের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। সরকার ২০১৫ সালে বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে। তালগাছসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে লম্বাগাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বজ্রপাতের পরিমাণ বাড়ছে বলে মনে করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়।  একই সঙ্গে আকাশে গভীর ঘনকালো মেঘের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াও বজ্রপাতের  কারণ বলে মনে করে মন্ত্রণালয়।
সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে দেশে বজ্রাঘাতে ৩০৭ জন, ২০১৬ সালে ৩৮০ জন মানুষ বজ্রাঘাতে নিহত হয়েছে। ২০১৬ সালের মে মাসে ৪দিনে বজ্রাঘাতে নিহত হয়েছেন ৮১জন মানুষ। ২০১৮ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে বজ্রাঘাতে কেউ নিহত হননি। একই বছরের মার্চ ও এপ্রিল এই দুই মাসে ৭০ জন মানুষ বজ্রঘাতে নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ২৯ এপ্রিল ১৬জন ও ৩০ এপ্রিল ১৩ জন মানুষ বজ্রাঘাতে নিহত হয়েছেন। বজ্রাঘাতে নিহত ৭০ জন হলেন ময়মনসিংহ, বরগুনা, কুমিল্লা, রাঙামাটি, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, রাজবাড়ি, যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুড়া, গাজীপুর, জামালপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাতক্ষীরা, সুনামগঞ্জ, নবাবগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, রংপুর ও সিলেট জেলার বাসিন্দা।
বজ্রপাতসৃষ্ট দুর্ঘটনা এড়াতে জনসাধারণকে লম্বাগাছ, বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তার, ধাতব খুঁটি, মোবাইলের টাওয়ার থেকে দুরে থাকার পরামর্শ দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর। এছাড়া বৃষ্টির মধ্যে শিশুদের মাঠে যেকোনও খেলা ও সাগর বা নদীতে জেলেদের মাছ ধরা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছে অধিদফতর। একইসঙ্গে আকাশে গভীর ও উলম্ব মেঘ দেখা দিলে ঘরের ভেতরে অবস্থান করারও পরামর্শ দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর। 
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘বজ্রপাত, ভারী বর্ষণ ও অতি বর্ষণের ফলে সৃষ্ট বন্যাসহ যেকোনও দুর্যোগ মোকাবিলার পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে প্রতি জেলার ডিসিকে ২০০ টন চাল ও পাঁচ লাখ নগদ টাকাসহ দুইশ’ বান্ডিল ঢেউটিন আপদকালীন মুজদ হিসেবে দেওয়া হয়েছে। এ সব জেলার স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা ভবনগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বন্যা হলে ও পরিস্থিতি খারাপ হলে বন্যাদুর্গতরা যেন সেখানে আশ্রয় নিতে পারে।  যেকোনও ধরনের দুর্যোগের জন্য আমরা আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ—এবার যেন একজন মানুষও মারা না যান।’ তিনি বলেন, ‘আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস পাওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে আমরা আগাম প্রস্ততি নিয়েছি। আমাদের প্রস্তুতি শেষ। প্রস্তুতি কাজে তাৎক্ষণিকভাবে সেনাবাহিনী ও নৌ-বাহিনীকেও প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। সোমবার (৩০ এপ্রিল) বিকেলে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত প্রস্তুতিমূলক সভায় সেনা ও নৌ বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ বজ্রপাতে বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এ কারণে ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ, পঞ্চগড়ের তেতুলিয়া, সাতক্ষীরার কয়রা, পটিুয়াখালি, নওগাঁর বদলগাছিসহ দেশের আটটি জেলায় বজ্রপাত শনাক্তকরণ মেশিন বসানো হয়েছে।’
জানতে চাইলে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সচিব শাহ্ কামাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১১ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে দুই লাখ পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে আছে। এ কারণে তাদের কুতুপালং ও বালুখালির মাঝখানে একটি নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা হচ্ছে। ৫০ হাজার পরিবারের এই ২ লাখ সদস্যের মধ্যে প্রায় ২৫ হাজার পরিবারের এক লাখ রোহিঙ্গা সদস্যকে ইতোমধ্যেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বাকিদেরও সরিয়ে নেওয়া হবে।’ তিনি  বলেন, ‘যেকোনও দুর্যোগেই সেনা ও নৌবাহিনী আস্থা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করে। যেকোনও দুর্যোগেই সেনাবাহিনী ও নৌ-বাহিনী জীবন বাজি রেখে জনগণের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। তাই এ বছরও আমরা আগাম বন্যা ও দুর্যোগের আশঙ্কা করায় সেনা ও নৌ-বাহিনীকে প্রস্তুত থাকতে বলেছি।’
মঙ্গলবার (০১ মে) মহান মে দিবসের সরকারি ছুটির দিনেও সচিবালয়ের দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সভা কক্ষে আবহাওয়া অধিদফতরের পূর্বাভাস অনুযায়ী বর্তমানে দেশে বিরাজমান দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবিলায় করণীয় বিষয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায়  আরও উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. জাফর আহমেদ খান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মঈন আবদুল্লাহ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বিভগের সচিব ফয়েজ আহমেদ, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণায়ের সচিব রইসুল আলম মণ্ডল, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব জিল্লার রহমান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভগের সচিব মো. আলগীর হোসেন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী হোসেন, দুর্যোগ ব্যাবস্থাপনা অধিদফতরের মহা-পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ ও আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক শামছুদ্দিন আহমেদ প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.