ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভীষিকাময় এক রাত

দফায় দফায় সংঘর্ষ। টিয়ার শেল-জলকামান নিক্ষেপ। ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ। পুলিশ-ছাত্রলীগের অ্যাকশনে রোববার রাতটা বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যম্পাসে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের   দমাতে পুলিশের মারমুখী ভূমিকায় এমন ভয়ানক অবস্থা হয়। হামলা-সংঘর্ষ চলাকালে নজিরবিহীনভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবনে হামলা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। আগের দিন দুপুর থেকে চলা কোটা সংস্কারের কর্মসূচি রাতে রূপ নেয় দাঙ্গা পরিস্থিতিতে।
দফায় দফায় পুলিশের টিয়ার শেল, ফাঁকা গুলি, ছররাগুলি, রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস, জলকামান ও লাঠিচার্জ এবং ছাত্রলীগের হামলায় আহত হয়েছেন আড়াই শতাধিক শিক্ষার্থী। ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে পুলিশি হামলার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ভিসি চত্বরে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে। এ সময় কতিপয় দুর্বৃত্ত হামলা চালিয়ে লণ্ডভণ্ড করে ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের বাস ভবন। তবে এ হামলার সঙ্গে আন্দোলনকারীরা জড়িত নয় বলে দাবি করে তারা বলছে ‘আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে অনুপ্রবেশকারীরা ভিসির বাস ভবনে এই হামলা চালিয়েছে।
এর আগে গত সোমবার বিকেল ৩টা থেকে ছাত্র পদযাত্রা শেষে শাহবাগের মোড়ে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। কয়েক দফায় সরে যেতে অনুরোধ করেও আন্দোলনকারীদের রাস্তা থেকে সরাতে না পেরে এক পর্যায়ে রাত ৭টা ৫০ মিনিট পুলিশ আন্দোলনকারীদের সরাতে অ্যাকশনে নামে। এ সময় পুলিশ আন্দোলনকারীদের টিয়ার শেল, রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস ও জলকামান ছোড়ে। আন্দোলনকারীরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার সামনে অবস্থান নিয়ে পুলিশের দিকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। থেমে থেমে সংঘর্ষ চলে রাত আড়াইটা পর্যন্ত।
পুলিশের অ্যাকশনে গুরুতর আহত হয়েছেন শতাধিক আন্দোলনকারী। আটক করা হয় প্রায় ৩০ জনের মতো। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে দু’জন পুলিশ সদস্যও। রাত সোয়া ৮টার দিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান নিলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্স, কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক সাইফ বাবু, আইন বিষয়ক সম্পাদক আল নাহিয়ান খান জয়ের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের একটি অংশ অবস্থান নেয়। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া খেয়ে এলাকা ত্যাগ করে তারা। রাত সাড়ে ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানীর নেতৃত্বে শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধিদল শাহবাগে ঘটনাস্থলে যান। এ সময় প্রক্টর পুলিশকে অ্যাকশন বন্ধ করে পিছনে সরে যেতে বলেন। আর শিক্ষার্থীদের নিবৃত্ত করতে সামনে এগোলে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ অব্যাহত রাখেন। প্রক্টর যখন আন্দোলনকারীদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন ঠিক তখনই পুলিশ উল্টো টিয়ার গ্যাস ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। তাতে আরো ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন আন্দোলনকারীরা।
কয়েক দফা চেষ্টা করেও প্রক্টর তাদের ঘটনাস্থল থেকে সরাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ সময় আন্দোলনকারীরা প্রশাসনের অনুমতি বিহীন ক্যাম্পাসে পুলিশি হামলার প্রতিবাদ জানান। রাত সাড়ে ১১টা থেকে কয়েকবার কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইনের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের একটি প্রতিনিধি দল আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলতে চান। কিন্তু পুলিশের টিয়ার শেল ও আন্দোলনকারীদের প্রতিবাদের মুখে সে চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। এদিকে রাত ১টার পর আন্দোলনকারীদের ওপর দফায় দফায় হামলার খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলগুলো থেকে গেট ভেঙে ও টপকে ছাত্রীরাও রাস্তায় বের হয়ে আন্দোলনে যোগ দেন। রাত সোয়া ১টার দিকে পুলিশ আবারো অ্যাকশনে যায়। কয়েকজনকে আটক করে মারধর করতে করতে থানায় নিয়ে যাওয়ার পথে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের সভাপতি মেহেদী পুলিশের সঙ্গে আটকদের মারধর করতে থাকেন।
এক পর্যায়ে সাংবাদিকরা তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের সভাপতি দাবি করে সাংবাদিকদের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এরপর পুলিশ মেহেদীকে শাহবাগ থানায় নিয়ে যায়। এক পর্যায়ে রাত ২টার দিকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক ছাত্রলীগের নেতাদের নিয়ে ঘটনাস্থলে যান। এ সময় শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, কোটা পদ্ধতি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। যেহেতু কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছে, তাই সরকার তাদের দাবির ব্যাপারে আলোচনায় বসতে চায়। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে অবহিত হয়েছেন। তিনি বিষয়টি সুরাহার ব্যাপারে আলোচনার জন্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে দায়িত্ব দিয়েছেন। দলীয় সাধারণ সম্পাদক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে  সোমবার বেলা ১১টায় আলোচনায় বসবেন।
এদিকে নানক যখন আলোচনার প্রস্তাব নিয়ে কর্মসূচি স্থলে, ঠিক তখনও আন্দোলনকারীদের ওপর মারমুখী ভূমিকায় থাকে পুলিশ। এ পর্যায়ে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে ভিসি চত্বরে অবস্থান নেয়। এ সময় কতিপয় ‘অনুপ্রবেশকারী’ ভিসির বাস ভবনে হামলা চালিয়েছে। লণ্ডভণ্ড করেছে বাস ভবনের আসবাবপত্র। তাণ্ডবলীলায় অক্ষত ছিল না ভবনটির কোনো ঐতিহ্যের স্মারকও। আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় ভিসির ব্যবহৃত দুটি গাড়ি। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কয়েক কোটি টাকার সম্পদ। বিধ্বস্ত অবস্থায় ভিসি ও তার পরিবারকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসেন ক্যাম্পাসে কর্তব্যরত সাংবাদিকরা। খবর পেয়ে ছাত্রলীগ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ভিসির বাস ভবন অভিমুখে এগুতে থাকে। কিন্তু আন্দোলনকারীদের ধাওয়ায় কিছুটা পিছু হটে। এক পর্যায়ে ভিসির বাস ভবন এলাকা ছাত্রলীগ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। মারধর করা হয় অনেক আন্দোলনকারীকে।
আহত অবস্থায় সবাইকে ডিএমসিতে চিকিৎসা দেয়া হয়। এরপর ভিসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বাস ভবনে আসেন জাহাঙ্গীর কবির নানক। এরপর ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। নিউমার্কেট এলাকা দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে বিপুল পরিমাণ র‌্যাব-পুলিশ এর বিশাল বহর। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে ভিসি ভবনে আসেন ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়াসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তারা ভিসি চত্বর থেকে টিয়ার শেল, ফাঁকাগুলি, রাবার বুলেট, ছররা গুলি মেরে টিএসসি থেকে আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেয়। এতে যোগ দেয় ছাত্রলীগও। তারা ইটপাটকেল ও গুলি ছুড়েছে বলে অভিযোগ করেছেন আন্দোলনকারীরা। ধাওয়া খেয়ে টিএসসির ভেতরে আটকা পড়ে প্রায় হাজার খানেক ছাত্রী। আর কার্জন হলের ভেতরে আটকা পড়েন প্রায় তিন হাজার আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রী। এ সময় আহত হয়েছেন প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জন। তবে কার্জন হল থেকে আন্দোলনকারীদের সরাতে গিয়ে পুলিশ ও ছাত্রলীগ ধাওয়া খেয়েছে কয়েকবার। এখানেও আহত হয়েছেন অনেকে।
ভোর সাড়ে ৫টার দিকে পুলিশ ও ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল ও শহীদুল্লাহ হলে আবারো অ্যাকশন শুরু করে। ছত্রভঙ্গ হয়ে যান শিক্ষার্থীরা। এখানেও আন্দোলনকারীদের ধাওয়া খেয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয় ছাত্রলীগ ও পুলিশ। সকাল ৯টায় পর্যন্ত তারা সেখানে বিক্ষোভ করেছেন। অন্যদিকে টিএসসিতে আটকা পড়াদের নিরাপদে হলে ফিরিয়ে নিতে ঘটনাস্থলে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামালের নেতৃত্বে সিনিয়র শিক্ষক, প্রভোস্ট ও হাউজটিউটরা। রাত ৪টা থেকে বেশ কয়েক দফা চেষ্টা চালিয়েও ছাত্রীদের হলে ফিরিয়ে নিতে ব্যর্থ হন শিক্ষকরা। এ সময় আন্দোলনকারীরা ক্যাম্পাসে পুলিশের হামলার প্রতিবাদ, ক্যাম্পাস থেকে পুলিশ সরিয়ে নেয়া ও কোটা সংস্কার চেয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। কয়েক দফায় চেষ্টার পর সকাল সোয়া ৬টার দিকে শিক্ষকরা ছাত্রীদের সেখান থেকে সরিয়ে নেন।
সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, যারা এখানে হামলা করেছে তারা মুখোশধারী সন্ত্রাসী, এরা কেউ আমাদের শিক্ষার্থী হতে পারে না। হামলাকারীরা বহিরাগত। তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, তার প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে এ হামলা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.