নিকৃষ্টতম কালো আইন by ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

সন্দেহ নেই সরকার আতঙ্কগ্রস্ত, ভীতসন্ত্রস্ত। তারা চার দিকে কেবলই ঘাতক দেখছে, যারা উদ্যত ছোরা হাতে সরকারের ওপর আঘাত হানার জন্য সদা প্রস্তুত। সরকার কোন দিক থেকে নিজেকে রক্ষা করবে, দিশা করতে পারছে না। ফলে সরকার ডাইনে বামে সামনে পেছনে কেবলই চরকির মতো তরবারি ঘোরাচ্ছে। আর তারই ফল হিসেবে আসছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। আওয়ামী লীগ সরকারের স্বাধীনতাপরবর্তী আমলেও এমনটি ঘটেছিল। দেশব্যাপী ভয়াবহ অরাজকতা, গুম, খুন, নিরাপত্তাহীনতা, সীমাহীন দুর্নীতি ও চোরাচালানে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন নাগরিকেরা। এর ওপর গণতন্ত্রহীনতার কারণে এই জনপদে নেমে এসেছিল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। না খেয়ে প্রাণ গিয়েছিল আট লাখ মানুষের। ঠিক সেই সময় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকার দেশে জারি করেছিলেন ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪’।
সেও এক ভয়াবহ আইন। তখন দেশে সাইবার বা ডিজিটাল প্রযুক্তি চালু ছিল না। যদিও বলা হয়েছিল, এই আইন চোরাচালানি ও মজুদদারদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। কিন্তু এর প্রায় সব ধারাই ছিল সংবাদপত্রে মত প্রকাশ নিয়ন্ত্রণের জন্য। এবং সত্যি সত্যিই দৈনিক গণকণ্ঠ, সাপ্তাহিক হলিডেসহ বহু সংবাদপত্র এই আইনবলে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কারণ, সংবাদপত্রের মাধ্যমে দেশের সাধারণ মানুষ সরকারের অপকীর্তি ও দুর্নীতির খবর জেনে যাচ্ছিল। অতঃপর সরকার যখন জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তখন তারা মাত্র চারটি সংবাদপত্র নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে অন্য সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীকালে কোনো সরকারই এই কালাকানুন বাতিল করার উদ্যোগ তো নেয়নিই, বরং আরো শক্তভাবে প্রয়োগ করেছে। এখন সময় বদলেছে। শুধু সংবাদপত্র নয়, যোগাযোগমাধ্যমের বহুবিধ বিস্তৃতি ঘটেছে। পৃথিবীতে তথ্যপ্রযুক্তি এক বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। এর খারাপ দিক থাকলেও ভালো দিকই বেশি। ফেসবুকসহ বিভিন্ন যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, তা পৃথিবীতে নতুন যুগের সূচনা করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া বহুলপ্রচলিত ও ব্যবহৃত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন আমরা তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে যেকোনো খবর পেতে পারি। এটাকে তো অবশ্যই ভালো খবর বলতে হবে। কিন্তু যখন কেউ কোনো তরুণী ধর্ষণের ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করে তখন তা অবশ্যই গর্হিত অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হবে। সরকার বলতে চাইছে, এই অপরাধ দমনের জন্য তারা সম্প্রতি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করছে। কার্যত এ সরকারের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হবে মানুষের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের একটি নির্লজ্জ অপপ্রয়াস। তথ্যপ্রযুক্তি আইন নামে এর আগের আইনে কুখ্যাত ৫৭ ধারা সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বিশেষ করে সাংবাদিক সমাজ এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন। সরকারের তরফ খেকে বারবার বলা হচ্ছিল, এই আইন সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু আইনের কোথাও তেমন কথা উল্লেখ ছিল না। ফলে দেখা গেল, এই আইনেই ডজন ডজন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হলেন। তার অপপ্রয়োগ ব্যাপকভাবে চলতে থাকল।
তখন সরকারের মন্ত্রীরাও স্বীকার করলেন, এই আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে। ৫৭ ধারায় পরিবর্তন আনা হবে। এক হিসাবে দেখা গেছে, ৮৫ ভাগ ক্ষেত্রেই ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ হয়েছে। তখন সরকারের তরফ থেকে বলা হলো, ৫৭ ধারা বিলুপ্ত করা হবে। এখন ৫৭ ধারা নেই বটে, তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৫৭ ধারার শাস্তিগুলোকে চারটি ধারায় ভাগ করে দেয়া হয়েছে। নতুন আইনে মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা, ধর্ম অবমাননা, মানহানির মতো সাইবার অপরাধের বিভিন্ন মেয়াদে সাজার বিধান রাখা হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে এই সরকার যা করছে তা যে শেখ মুজিবের প্রতি অসম্মান, সেটি সরকার উপলব্ধি করতে পারছে না। যদি শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে কোনো কথাই না বলা যায়, তাহলে শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কীর্তির চর্চা কিভাবে হবে? কেউ যদি মনে করেন, তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর গবেষণা গ্রন্থ রচনা করবেন। তাহলে তাকে দশবার ভাবতে হবে, এ কাজটি তিনি করবেন কি না? সে কাজ করতে গেলে তার আমলে জারি করা কালাকানুনের প্রশ্ন আসবে। গণতন্ত্রহীনতার কারণে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের প্রশ্ন আসবে। বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রসঙ্গ আসবে। আর তিনি যেসব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় বাকশাল কায়েম করেছিলেন, সে কথাও আসবে। আসবে সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়ার প্রসঙ্গও। ওই গবেষক কিংবা তার সুপারভাইজারকে গবেষণাপত্র তৈরির ক্ষেত্রে সব সময় মাথায় রাখতে হবে যে, কোথায় শেখ মুজিবুর রহমানের অবমাননা বা অসম্মান হলো। তাতে গবেষক তো শাস্তি পাবেনই, সেই সাথে গবেষণাপত্র তৈরিতে প্ররোচনা দেয়ার জন্য সুপারভাইজারও কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হবেন। সে পরিপ্রেক্ষিতে শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনভিত্তিক গবেষণা কেউই করতে চাইবেন না। ভয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নামও কেউ নেবে না। এভাবে তিনি ইতিহাসের বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাবেন। কার্যত এ ধরনের আইন শেখ মুজিবুর রহমানের নাম মুছে ফেলার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
তার নাম উচ্চকিত হবে না। এই আইনের ধারাগুলো সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে বাধ্য। আইনানুযায়ী কোনো সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে কোনোরূপ অনুসন্ধানমূলক রিপোর্ট প্রকাশ করা সম্ভব হবে না। কেননা এতে বলা হয়েছে, গোপনে এ ধরনের কোনো অফিস থেকে কোনো তথ্য সংগ্রহ করা যাবে না। গোপনে ভিডিও ক্যামেরার মাধ্যমে কোনো অপরাধীর দৃশ্য ধারণ করা যাবে না। গোপনে কারো কোনো কথা রেকর্ড করা যাবে না। অথচ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মূল ভিত্তি হচ্ছে এগুলো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব খবর বা ছবি দ্রুত চলে আসে, সেগুলো সংবাদপত্রগুলোর হাতে এতে পৌঁছতে আরো সময় লাগে। এভাবে তথ্যপ্রযুক্তি বিস্তৃত হয়েছে। সরকার ফেসবুক বন্ধ করছে না বটে, তবে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের হাত-পা বেঁধে দিয়েছে। এ রকম পরিস্থিতি আধুনিক পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে সংঘটিত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। সাংবাদিকেরা বলছেন, এর ফলে সাংবাদিকতা করা খুবই কঠিন হবে। অনেক টেলিভিশন চ্যানেলে এমন অনুষ্ঠানও প্রচার করা হয়, যা গোপন ভিডিওতে ধারণ করা। সেগুলো মারাত্মক ধরনের অপরাধ। কিন্তু এসব অপরাধমূলক অনুসন্ধানী রিপোর্ট এই আইন পাস হলে আর করা যাবে বলে মনে হয় না। বস্তুত সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মুখ থুবড়ে পড়বে। উদাহরণ হিসেবে নারায়ণগঞ্জের নিয়াজুলের কথা উল্লেখ করা যায়। দেশের সব মিডিয়ায় অস্ত্র হাতে নিয়াজুলের ছবি ছাপা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী দাবি করেছেন, তাকে হত্যার জন্য নিয়াজুলসহ আরো ৯ জন গুলি চালিয়েছিল। এখন নিয়াজুল আত্মগোপনে আছেন। কিন্তু নিয়াজুলের প্রশ্রয় দানকারী শামীম ওসমান এমপি জোরগলায় বলেছেন, নিয়াজুল কোনো গুলিটুলি করেনি, বরং তার অস্ত্রটি খোয়া গেছে। তিনি অসুস্থ ও চিকিৎসাধীন আছেন। পুলিশও নিয়াজুলের অস্ত্রটি খুঁজে পেয়েছে বটে, কিন্তু তাকে ধরতে পারেনি কিংবা ধরার চেষ্টা থেকে বিরত আছে। শামীম ওসমান হুমকি দিয়েছেন, নিয়াজুলের কিছু হলে নারায়ণগঞ্জে আগুন জ্বলবে। আর প্রধানমন্ত্রী ইতঃপূর্বে জাতীয় সংসদে ঘোষণা দিয়েছিলেন, শামীম ওসমান পরিবারের যেকোনো বিপদে তিনি তাদের পাশে থাকবেন। এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনানুযায়ী নিয়াজুল সব মিডিয়ার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়ের করতে পারেন। কেননা, তার সশস্ত্র ছবিটি তার অনুমতি ছাড়াই মিডিয়া ধারণ করেছিল। সর্বত্র পরিস্থিতি এমনই দাঁড়াবে। যেমন বলা হয়েছে, বেআইনিভাবে যদি কোনো ব্যক্তি কোনো কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম থেকে কোনো উপাত্ত, উপাত্তভাণ্ডার, তথ্য বা উদ্ধৃত অংশ সংগ্রহ করেন বা কোনো উপাত্তের অনুলিপি সংগ্রহ করেন; তবে তার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে সাত বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা ১০ লাখ টাকা। তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার খবরটি কী দাঁড়াবে। এই ঘটনা নিয়ে সংবাদপত্রগুলো অনেক অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেছে। এর ফলে ধারণা করা যায়, সত্যের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী কাকে যেন আড়াল করতে চাইছেন।
সে কারণে সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছেন, যত দিন রিজার্ভ চুরির টাকা ফেরত না আসবে, তত দিন তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে না। কিন্তু মিডিয়া গোয়েন্দা সূত্রের উল্লেখ করে সেই তদন্ত রিপোর্টের অনেকাংশই ইতোমধ্যে প্রকাশ করেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হলে আর কোনো দিন এ সম্পর্কে মিডিয়া টুঁ-শব্দ পর্যন্ত করতে পারবে না। তেমনিভাবে উদাহরণ দেয়া যায় র‌্যাব সদস্যদের হাতে সাত খুনের বিষয়টি। সংবাদপত্রগুলোর অনুসন্ধানী রিপোর্টের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে, সংশ্লিষ্ট র‌্যাব সদস্যরা কিভাবে ওই সাতজনকে খুন করে। যে বস্তায় বেঁধে তাদের ফেলা হয়েছিল সেসব চালের বস্তা কোথাকার, চালগুলো কাদের সরবরাহ করা হয় সব কিছু খুঁটিয়ে বের করে নিয়ে আসেন সাংবাদিকেরা। ফলে দোষী র‌্যাব সদস্যদের বিচারকাজ সহজতর হয়েছে। সর্বশেষ যে প্রসঙ্গ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগে এ ধরনের একটি আইন পাস করার প্রয়োজন কেন সরকার বোধ করল। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যে একদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যেভাবে ভোট জালিয়াতি ও কারচুপি করা হয়েছিল, বর্তমান দুনিয়ায় তা বিরল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে ইলেট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া ছবি ও খবর প্রকাশ করে দেখিয়ে দিয়েছেল, কিভাবে ভোট জালিয়াতি ও কারচুপি হয়েছিল। বুথগুলো শূন্য, কুকুরে রোদ পোহাচ্ছে। প্রিজাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসাররা দুই হাতে সিল মারছেন, ব্যালট বাক্স ছিনতাই হচ্ছে, আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা হয়েছে। ধারণা করা যায়, এবারো সম্ভবত সরকার সে পথেই নির্বাচন সম্পন্ন করার চেষ্টা করবে। আর তার কোনো কিছুই যাতে ইলেট্রনিক, প্রিন্ট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হতে না পারে, সেজন্যই এমন শক্ত আয়োজন। তবে ইতিহাস সাক্ষী, সব সময় একই কাজে একই ফল পাওয়া যায় না।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.