ইউরোপ কি মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়াকে বাঁচাতে পারবে? by মোস্তফা বারকুইতি

মধ্যপ্রাচ্যে একজন বিশ্বাসযোগ্য মার্কিন নেতার অনুপস্থিতিতে ওই অঞ্চলে শান্তির একমাত্র আশা, দুই রাষ্ট্র সমাধানকে রক্ষা করার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে পবিত্র নগরী জেরুসালেমকে ট্রাম্পের জঘন্য ও একতরফা স্বীকৃতি প্রদান বাস্তবে ওয়াশিংটনকে মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘ দিনের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা থেকে ছুড়ে ফেলেছে। নিজের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রেসিডন্ট ট্রাম্প তার দেশের ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাকে নিছক সন্দেহজনক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। এই প্রক্রিয়ায় তিনি গোটা আরব এবং মুসলিম বিশ্বে তার অবস্থানকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। ইউরোপের জন্য মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে তৎপর হওয়ার এখনই সঠিক সময়। ১৯৯৩ সালে ওয়াশিংটনে ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) এবং ইসরাইলি সরকারের মধ্যে অসলো শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে এ পর্যন্ত শান্তি প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতির কারণে এই মুহূর্তে ইইউর ওই স্থান দখল করা প্রয়োজন। এই চুক্তিতে ইচ্ছাকৃতভাবে জেরুসালেমের মর্যাদাসংক্রান্ত বিষয়টি ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনিদের পরস্পরের সম্মতির মাধ্যমে কেবল একটি চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। জেরুসালেম নিয়ে ট্রাম্পের আকস্মিক ও বিপজ্জনক ঘোষণা ‘স্টেকহোল্ডার’ এবং ইইউ’র প্রতিও গুরুতর ও নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন নিয়ে ‘দুই রাষ্ট্র’ সমাধানকে বাঁচিয়ে রাখতে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে ইইউ ভূমিকা পালন করতে পারে। ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেন ও ইতালিসহ ইইউর বহু দেশই এখন নানা সঙ্কটে আছে। ঐতিহাসিকভাবে এই চরম সঙ্কটপূর্ণ অবস্থায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন কোনো হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত নিলে- তা তাদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এতে ওই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা অব্যাহত থাকবে। সম্প্রতি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ব্রাসেলসে ইউরোপীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এক বৈঠকে প্রচন্ড ধমক দেয়া হয় তথা শক্তভাবে প্রতিরোধ করা হয়।
(নেতানিয়াহু ইইউ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের, জেরুসালেমের ব্যাপারে ট্রাম্পের উদাহরণ অনুসরণ করার আহ্বান জানালে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল।) বিস্ময়করভাবে, ইসরাইলের অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র চেক প্রজাতন্ত্রসহ গোটা ইউরোপ এর বিরোধিতা করেছে। গত ২২ বছরের মধ্যে ক্ষমতাসীন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেতানিয়াহু প্রথম সরকারিভাবে ইউরোপ সফর করেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা সর্বসম্মতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পদক্ষেপকে ‘শান্তি প্রচেষ্টার জন্য খারাপ’ বলে সমালোচনা করেন। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া গোটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এককণ্ঠে সুস্পষ্টভাবে ঐক্যবদ্ধ। তারা ঐক্যবদ্ধভাবে জানিয়ে দিয়েছে, ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে যেকোনো অর্থপূর্ণ আলাপ-আলোচনা পুনরুজ্জীবনের আশাবাদের ক্ষেত্রে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে জেরুসালেমকে স্বীকৃতিদান হচ্ছে ‘মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি’ প্রচার করার মতোই। ট্রাম্পের ঘোষণা কেবল পূর্ব জেরুসালেম ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ফিলিস্তিনিদের আশা ও দাবির পরিসমাপ্তি ঘটানোর লক্ষ্যেই নয়; বরং এতে সহিংস কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির দরজাও খুলে যাবে। ইসরাইলের বর্তমান কোয়ালিশন সরকার হচ্ছে চরম ডানপন্থী। ট্রাম্পের ঘোষণায় এই সরকার সম্পূর্ণ রোমাঞ্চিত। প্রকৃতপক্ষে, ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে পূর্ব জেরুসালেম দখল করার পর থেকে এ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ইসরাইলি সরকারগুলো অবৈধভাবে জেরুসালেমকে তাদের ‘চিরস্থায়ী এবং অবিভক্ত’ রাজধানী হিসেবে দাবি করে আসছে। সুতরাং মার্কিন প্রেসিডেন্টের ঘোষণা সাম্প্রতিক ইতিহাসে অত্যন্ত কলঙ্কিত দখলদারদের জন্য পুরস্কার হিসেবে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘোষণাকে প্রায় চার লাখ ইহুদি উপনিবেশবাদী ‘বাস্তবতার স্বীকৃতি’ হিসেবে স্বাগত জানিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেছে। ট্রাম্পের এই সর্বনাশা ঘোষণার বহু আগেই অধিকৃত ভূখণ্ডে ইসরাইলের সম্প্রসারণবাদী নীতি দুই রাষ্ট্র সমাধানের ভিত্তিকে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ভৌগোলিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে দ্রুত কলোনি নির্মাণ ইউরোপের অধিকাংশ লোককে নিরাশ করেছে মৌলিকভাবে। তাই শান্তিচুক্তিতে উপনীত হওয়ার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হতাশ হয়েছে। সুতরাং ট্রাম্পের তৎপরতা বা কর্মকাণ্ড একটি অর্থপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরের পথে এগিয়ে যাওয়ার পথকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, আমেরিকার সর্বশেষ কর্মকাণ্ড ট্রাম্প প্রশাসনকে দুই রাষ্ট্র ফর্মুলা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে এবং উভয় পক্ষকে সম্পূর্ণ একটি নতুন বাস্তবতা তথা ‘একরাষ্ট্র সমাধানে’র দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই পথ দিয়ে অগ্রসর হলে কার্যকরভাবে শান্তি প্রক্রিয়ার অবসান ঘটবে। এক রাষ্ট্রভিত্তিক বাস্তবতার পরিণাম হলো, পুরনো দক্ষিণ আফ্রিকার মতোই একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটা। সেখানে সমঅধিকার থাকবে না এবং ফিলিস্তিনিদের অনন্তকাল ধরে দখলদারিত্বের অধীনে বসবাস করতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি এবং মূল্যবোধের ওপর এর মারাত্মক প্রভাবের ব্যাপারে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। উল্লেখ করা প্রয়োজন, মূল্যবোধ ব্যবস্থা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের পর থেকে এ পর্যন্ত আটলান্টিকের এপার থেকে ওপারে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। ট্রাম্পের প্রতিদিনের টুইট ভীতিকর উপদ্রবে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন মিডিয়া কর্তৃপক্ষ, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, সরকারি কর্মকর্তা এবং ইইউর মধ্যকার সিভিল সোসাইটিগুলোকে হোয়াইট হাউজ থেকে আসা অবাধ ও মাঝে মাঝে হঠকারী, টুইটের ব্যাপারে অব্যাহতভাবে সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে। ইউরোপ মনে করে, আামেরিকা সবাইকে বিভ্রান্ত করছে। তারা ওয়াশিংটনের সর্বশেষ অবস্থানের ব্যাপারে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ইইউ দেশগুলো গত সাত দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে আসছে। কিন্তু তারা মনে করে, এখন তারা ফিলিস্তিন ইস্যু, পররাণু অস্ত্র এবং জলবায়ু পরিবর্তনসহ পররাষ্ট্রনীতির প্রতিটি প্রধান প্রধান ক্ষেত্রে চূড়ান্তভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বেরিয়ে এসেছে। নেতানিয়াহুর নীতির পক্ষে ট্রাম্প পরিপূর্ণভাবে অবস্থান নিয়েছেন। ইউরোপ কি শূন্যস্থান পূরণ করে বিশ্বের অত্যন্ত জটিল সঙ্ঘাত নিরসনের জন্য শান্তি প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবে? ইউরোপ কি মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়াকে বাঁচাতে পারবে?
লেখক : একজন কলামিস্ট ও লন্ডনের ফরেন প্রেস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট
গালফ নিউজ থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার

No comments

Powered by Blogger.