শিশু হত্যা ও ধর্ষণের নেপথ্যে সিরিয়াল কিলার : উত্তাল পাকিস্তান

পাকিস্তানে জয়নব আনসারী নামে ৬ বছরের একটি মেয়েকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে সারা দেশ জুড়ে। এ নিয়ে দাঙ্গা-সহিংসতায় দু জন নিহতও হয়েছে। কিন্তু পুলিশের নথিপত্র থেকেই এখন জানা যাচ্ছে, শুধু পাঞ্জাবের কসুর শহরেই ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে একই ধরণের ঘটনা ঘটেছে অন্তত ১০টি। গত ৪ঠা জানুয়ারি কোরান শিক্ষার ক্লাসে যাবার পথে নিখোঁজ হয় জয়নব আনসারি। কয়েক দিন পর তার মৃতদেহ পাওয়া যায় শহরের একটি আবর্জনা ফেলার জায়গায়। বলা হয়, তাকে ধর্ষণের পর গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশের ওই দিনের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে জয়নবকে শেষবার জীবিত অবস্থায় দেখা গেছে। তাতে দেখা যায় একজন অচেনা লোকের হাত ধরে জয়নব হেঁটে যাচ্ছে। বিবিসির সিকান্দার কিরমানি কসুর থেকে জানাচ্ছেন, তদন্তকারীরা গত এক বছরের মধ্যে ঠিক এই রকম ১০টি ঘটনা চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে ৬টি নিহত মেয়ের দেহে একই ব্যক্তির ডিএনএ পেয়েছেন তদন্তকারীরা। স্থানীয় লোকেরা সন্দেহ করছেন, আক্রমণকারী একই ব্যক্তি এবং সে কাছাকাছি এলাকাতেই থাকে। এই নিহতরা সবাই অল্পবয়েসী মেয়ে, এবং তারা সবাই তাদের বাড়ির খুব কাছাকাছি এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়। ছয় জন মেয়ের সবার মৃতদেহই একই ভাবে আবর্জনার স্তুপ, বা পরিত্যক্ত বাড়িতে ফেলে দেয়া অবস্থায় পাওয়া যায়। সব ক্ষেত্রেই তাদের পরিবারের বাস দু'মাইল এলাকার ভেতরে। প্রথম দিকে ধর্ষিত ও নিহতদের একজন পাঁচ বছরের আয়েশা বিবি। সে নিখোঁজ হয় ২০১৭-র জানুয়ারির ৭ তারিখ। সেদিন ছিল তার পিতা আসিফ বাবার জন্মদিন। তিনি মেয়েকে সেদিন যে টেডি বেয়ার উপহার দিয়েছিলেন, সেটি এবং তার অন্য পুতুল ও স্বুলে যাবার পোশাক এখনো রেখে দিয়েছেন। আসিফ বলছেন,‘আমার বাড়ি এখন কবরখানা হয়ে গেছে। আর জয়নবের ঘটনাটি জানার পর আমার মনে হচ্ছে আমিই যেন আরেকবার আমার মেয়েকে হারিয়েছি। অন্য আরো কয়েকটি মেয়ে - যাদের একইভাবে মারা হয়েছে - তাদের সময়ও আমার একই রকম লেগেছিল। আমার অনুভুতি বর্ণনা করার জন্য ক্রোধ শব্দটি যথেষ্ট নয়।’ তিনি জানাচ্ছেন, পুরো কসুর শহরে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। ’বাচ্চারা এখন বাথরুমে যেতেও ভয় পায়, দরজা বন্ধ করে না। মা-কে বলে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে’ - বলছিলেন আসিফ বাবা।  একইভাবে নভেম্বর সাসে নিখোঁজ হয় ৬ বছর বয়েসের কাইনাত। সে তার বাড়ির কাছেই দোকান থেকে দই কিনতে গিয়েছিল। তার চাচা ইরফান আলি বিবিসিকে জানান, এর পর নিকটবর্তী একটি কবরখানায় তাকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। সে তখনও বেঁচে ছিল। এসব ঘটনা থেকে একমাত্র কাইনাতই বেঁচে ফিরতে পেরেছে। তবে সে এখনো হাসপাতালে, তবে সে এখন সম্পূর্ণ পঙ্গু, কথা বলতে পারে না, কাউকে চিনতে পারে না।
ইরফান আলি বলেন, তিনি নিশ্চিত যে এই আক্রমণকারী স্থানীয় কোন লোক। তবে এতগুলো ঘটনা সত্বেও জয়নবের ধর্ষণ ও হত্যা কেন এতটা জনরোষ তৈরি করেছে - তা খুব একটা স্পষ্ট নয়। কাইনাতের চাচা বিবিসিকে বলছিলেন, জয়নবের পরিবার বড়লোক, এবং তাদের রাজনৈতিক যোগাযোগ আছে। বাকিরা সবাই গরিব, তাদেরকাছে কোন রাজনীতিবিদ আসে না। তাদের কি হলো তাতে কারো কিছু আসে যায় না। বিবিসির সংবাদদাতা বলছেন, মনে হয় বিরোধী দলের রাজনীতিবিদরা এ ঘটনাটিকে নওয়াজ শরিফের মুসলিমে লিগের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছেন, কারণ তাদের ঘাঁটি হচ্ছে এই পাঞ্জাব প্রদেশ - কসুর যার অংশ। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ - তিনি নওয়াজ শরিফের ভাই এবং যাকে মনে করা হয় ভাবী প্রধানমন্ত্রী - তিনি জয়নবের বাবার সাথে দেখা করে আশ্বাস দিয়েছেন যে তিনি ন্যায়বিচার পাবেন। আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এতে জয়নবের হাসিমাথা মুখের ছবি, এবং আবর্জনার স্তুপে পড়ে থাকা তার মৃতদেহের ছবি অনলাইনে 'ভাইরাল' হয়, এবং জনগণের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টিতে বিরাট ভুমিকা রেখেছে। আরো একটি বড় কারণ হলো গত এক বছরে এতগুলো হুবহু একই রকম ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু পুলিশ কিছুই করতে পারে নি, খুনিকে ধরতে পারে নি। আসিফ বাবা বলছিলেন, পুলিশ কয়েকবার বিভিন্ লোককে ধরে এনে বলেছে এরাই খুনি, ওই লোকেরাও স্বীকার করেছে। কিন্তু আমরা এসব কথা বিশ্বাস করি না। ‘কারণ পুলিশের হাতে আক্রমণকারীর ডিএনএ আছে। ডিএনএ রিপোর্ট পাবার পর দেখা গেছে তাদের সাথে এগুলো মিলছে না’। বাবা বলছিলেন, পুলিশ এরকম শত শত লোককে আটক করেছে, কিন্তু তাদের সন্দেহ পুলিশ আসল খুনিকে ধরার পরিবর্তে ঘুষ নেবার ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী। তবে এখন পুলিশ বলছে, তারা খুনিকে থরার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। কাইনাতের চাচা বলছিলেন, আমরা চাই না আরো একটি মেয়ের ভাগ্যে এমনটা ঘটুক।

No comments

Powered by Blogger.