আশা-নিরাশার দোলাচলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন by মিজানুর রহমান

জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপানসহ মানবাধিকার সংবেদনশীল সংস্থা ও রাষ্ট্রগুলোর উদ্বেগ-আশঙ্কার মধ্যেই বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের রাখাইনে  ফেরানোর আয়োজন চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। আগামীকাল নেপি’ডতে প্রত্যাবাসন বিষয়ক জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম বৈঠক এবং এ সংক্রান্ত ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট বা মাঠপর্যায়ের কাজের (চূড়ান্ত) চুক্তি সই হওয়ার কথা রয়েছে। মিয়ানমার সরকার আগেই জানিয়েছে, আসন্ন ২২শে জানুয়ারি বাস্তুচ্যুত ৪৫০ হিন্দু শরণার্থীকে গ্রহণের মধ্যদিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করতে চায় তারা। বাংলাদেশও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ক দ্বিপক্ষীয় চুক্তির (বাইলেটারাল অ্যারেঞ্জমেন্ট) বাধ্যবাধকতা মানতে চায়। কর্মকর্তারা বলছে, গত ২৩শে নভেম্বর সই হওয়া ওই চুক্তি মতে, দুই মাসের মধ্যেই (২২শে জানুয়ারি) বাস্তুুচ্যুতদের রাখাইনে ফেরানোর কাজ শুরুর প্রস্তুতি রয়েছে ঢাকার। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়া একতরফাভাবে বাস্তুচ্যুত হিন্দু সমপ্রদায়ের লোকজনকে গ্রহণে মিয়ানমারের আগাম ঘোষণা নতুন জটিলতার আশঙ্কা তৈরি করেছে।
গত কয়েক মাস ধরে দেশটির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় যেসব বৈঠকাদি হয়েছে তার কোথাও আলাদাভাবে হিন্দু সমপ্রদায়ের লোকজনকে ফিরিয়ে নেয়ার আলোচনা হয়নি। বরং ২০১৬ সালের পর বাস্তুচ্যুত রাখাইনের হিন্দু-মুসলিম সব নারী-পুরুষ ও শিশুদের ফেরানোর আলোচনাই হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ১ লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে জানিয়ে এক কর্মকর্তা সম্প্রতি মানবজমিনকে বলেন, ২০১৬ সালের পর প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাছাড়া আগে থেকে এখানে রয়েছে প্রায় ৩ লাখ মিয়ানমার নাগরিক। এ পর্যন্ত ৯ লাখের বেশি রোহিঙ্গার নিবন্ধন সম্ভব হয়েছে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, এর মধ্য থেকে ২০১৬ সালের পরে আসা ১ লাখ রোহিঙ্গার তালিকা দেয়া হবে নেপি’ডকে। তবে গতকাল এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সেই ১ লাখ রোহিঙ্গার তালিকা চূড়ান্ত হয়েছে মর্মে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। উদূ্ভত পরিস্থিতিতে ওই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারাই নির্ধারিত ডেটলাইনের মধ্যে প্রত্যাবাসন কাজ শুরু হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। তাছাড়া নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনে রাখাইন এখনও প্রস্তুত না হওয়ায় গভীর উদ্বেগ রয়েছে ঢাকা এবং আন্তর্জাতিক মহলের। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থা-সংগঠনগুলোর রিপোর্ট মতে, এখনও রাখাইনে আগুন জ্বলছে। প্রাণে বাঁচতে রোহিঙ্গারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বাস্তুচ্যুতরা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রতিদিনই বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে। রোহিঙ্গা স্রোত কমলেও তাদের সীমান্ত পাড়ি দেয়া থেমে নেই। তাছাড়া রাখাইনে ফেলে আসা রোহিঙ্গাদের বসতবাড়ি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সেনা অভিযানে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত ৮শ’ গ্রামের অর্ধেকের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২৮৮ গ্রাম একেবারে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া হয়েছে। ঢাকার কর্মকর্তারা বলছেন, পুরো রাখাইন পরিস্থিতি মিয়ানমার কখনও স্বীকার করে না। তারা এ নিয়ে বরাবরই ব্লেমগেম করছে। ক’দিন আগে রাখাইন থেকে ‘রহস্যজনক’ একটি সন্ত্রাসী হামলার খবর বেরিয়েছে। অবশ্য আশার দিক হচ্ছে মিয়ানমার সেনা প্রধান রাখাইনে গণহত্যার স্বীকারোক্তি দিতে দিতে শুরু করেছেন। আর দেশটির কার্যকর নেতা অং সান সু চি আরও এ ধাপ এগিয়ে সেই স্বীকারোক্তিকে ‘ইতিবাচক পদক্ষেপ’ বলে মন্তব্য করেছেন। গত শুক্রবার নেপি’ড সফরকারী জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে সুচি এসব কথা বলেন। সুচির সঙ্গে বৈঠকে জাপানের মন্ত্রী নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি সেটি নিশ্চিত করতে সুচি সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নিরাপত্তা এবং তাদের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিয়ে ফেরাতে হবে জানিয়ে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ প্রক্রিয়ায় তার দেশের তরফে ৩ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেয়ারও অঙ্গীকার করেছেন। যখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আশা-নিরাশার দোলাচলে দোল খাচ্ছে তখনই দেশটি সফরে গেছেন এ সংক্রান্ত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বাংলাদেশ পক্ষের সদস্যরা। গতকাল বিকালে ইয়াংগুন পৌঁছেছেন পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের নেতৃত্বাধীন ওই দলের ১৪ সদস্য। সেখানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত প্রতিনিধিদলের সঙ্গে যুক্ত হবেন। এরপর আগামীদিনে নেপি’ডতে দেশটির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে বসবে বাংলাদেশ দল। সেখানেই চূড়ান্ত হবে রোহিঙ্গাদের ফেরানোর মাঠ পর্যাযের কার্যক্রমের ফর্মুলা। উল্লেখ্য, রেডিও ফ্রি এশিয়া সমপ্রতি এক রিপোর্টে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে অনিশ্চয়তা প্রকাশ করেছে এবং এ নিয়ে মিয়ানমারের এক মন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে ঢাকাকে ‘দোষারোপ’ করেছে। সেখানে জানানো হয়েছে- মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী উইন মিয়াত আয়া জানিয়েছেন, ২২শে জানুয়ারি বাস্তুচ্যুত রাখাইনের বাসিন্দাদের গ্রহণে প্রস্তুত মিয়ানমার। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দ্রুততর করতে তারা বাংলাদেশের কাছে অনেক আগেই যাচাই-বাছাইয়ের ফরম পাঠিয়েছেন। কাগজপত্রহীন লোকজন ওই ফরম পূরণ করবে, যা মিয়ানমার সরকার তার নিজস্ব ভেরিফিকেশন সিস্টেমে যাচাই-বাছাই করবে। কিন্তু এখনও পূরণ হওয়া কোনো ফরম তারা ফেরত পায়নি। রিপোর্টে আরও বলা হয়- মিয়ানমারের দাবি প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বা এর পরিকল্পনায় কোনো সমস্যা নেই। মিয়ানমারের বাসিন্দা হিসেবে প্রমাণপত্র দেখালেই তাদের গ্রহণ করা হবে। যাদের কাগজপত্র নেই তারা মিয়ানমার সরকার নির্ধারিত ফরম পূরণ করবে, সেখানে তাদের ছবি, নাম, জন্ম-তারিখ এবং পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা দিতে হবে। ওই তথ্যগুলো দিয়ে পূর্ণ করা ফরম ধরেই তাদের যাচাই-বাছাই হবে। বাংলাদেশ সরকার সেই ফরমগুলো ফেরত পাঠালেই যাচাই-বাছাই শুরু করবে মিয়ানমার। ঢাকার কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, বাস্তুচ্যুতদের নিজ ভূমে নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে পুনর্বাসনে জোর দিচ্ছেন তারা। রোহিঙ্গা সংকটের একটি স্থায়ী সমাধান সব সময় চেয়ে আসছে বাংলাদেশ। কোনো প্রতীকী বা যেনতেন উপায়ে প্রত্যাবাসন নয়। আর এ কারণেই মিয়ানমার সরকার আন্তর্জাতিক চাপ হালকার জন্য প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় তড়িঘড়ি বা হিন্দুদের আগে ফেরানোর কৌশল নিয়েছে কিনা? সেটি নিশ্চিত হতে চায় ঢাকা। দ্বিপক্ষীয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা জোর দিয়েই বলছেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনটি টেকসই করতেই তাদের সব প্রচেষ্টা। বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ উদ্বিগ্ন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সুপারিশগুলোও বিবেচনায় রেখেই দ্বিপক্ষীয় কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছে। এতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি দেরি হলেও এটি স্বচ্ছ এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণের বিষয়টি নিশ্চিত হতে চায় বাংলাদেশ। তাছাড়া পুরো প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে ইউএনএইচসিআরকেও সম্পৃক্ত রাখার চেষ্টা রয়েছে ঢাকার।

No comments

Powered by Blogger.