আইনি জটিলতা দূর হবে কীভাবে?

নির্বাচন কমিশন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচন এবং নতুন সংযোজিত ১৮টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। একই সঙ্গে ঘোষণা করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নতুন সংযোজিত ১৮টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে নির্বাচন। এ ছাড়া একই সময়ে অনুষ্ঠিত হবে দুই করপোরেশনের ৬টি করে ১২টি সংরক্ষিত মহিলা আসনের নির্বাচন। কমিশনের ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ১৮ জানুয়ারি, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮। ঢাকা সিটি করপোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক ও আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সংবিধানের ৫৯ (১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।’ অর্থাৎ আমাদের সংবিধান অনুযায়ী, বাংলাদেশ নামক প্রজাতন্ত্রের প্রতিটি প্রশাসনিক একাংশের বা স্তরের শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্ব থাকবে সেখানকার আইনানুযায়ী নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর। অন্যভাবে বলতে গেলে, নির্বাচিত জেলা পরিষদ জেলার, নির্বাচিত উপজেলা পরিষদ উপজেলার, নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদ ইউনিয়নের, নির্বাচিত সিটি করপোরেশনের সদস্যরা (মেয়র ও কাউন্সিলর) সিটি করপোরেশনের এবং নির্বাচিত পৌরসভার সদস্যরা পৌরসভার শাসনকার্য পরিচালনা করবেন। তাই দুই সিটি করপোরেশনে নতুনভাবে সংযোজিত ৩৬টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর নির্বাচন করতে সরকারের ওপর সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ বাধ্যবাধকতাই স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯-এর ৫ ধারায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাতে নির্বাচিত মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর নিয়ে সিটি করপোরেশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। প্রসঙ্গত, জাতীয় নির্বাচন ও রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত মূলত নির্বাচন কমিশনের হলেও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব সরকার তথা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। একইভাবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের শূন্য পদে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানেরও সাংবিধানিক ও আইনি বাধ্যবাধকতা আছে। ঢাকা উত্তরের ভারপ্রাপ্ত মেয়র মো. ওসমান গনি মেয়র পদের জন্য নির্বাচিত হননি। কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হয়ে তিনি নির্বাচিত মেয়রের অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে সাময়িকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনানুগভাবে নির্বাচিত মেয়র নন। তাই তাঁর স্থলে মেয়র নির্বাচন করতে সরকার সাংবিধানিকভাবে বাধ্য। এ বাধ্যবাধকতার কারণেই সিটি করপোরেশন আইনে ১৬ ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আইনের এই ধারা অনুযায়ী, মৃত্যু বা অপসারণের কারণে আকস্মিকভাবে ‘সিটি কর্পোরেশনে মেয়াদ শেষ হইবার একশত আশি দিন পূর্বে মেয়র বা কাউন্সিলরের পদ শূন্য হইলে পদটি শূন্য হইবার নব্বই দিনের মধ্যে ইহা পূরণ করিতে হইবে এবং যিনি উক্ত পদে নির্বাচিত হইবেন, তিনি সিটি কর্পোরেশনের অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য উক্ত পদে বহাল থাকিবেন।’ যেহেতু ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়াদ এখনো ১৮০ দিনের বেশি অবশিষ্ট রয়েছে, তাই মেয়র পদে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকার বাধ্য। আর আইনের এই ধারা পূরণকল্পেই ৯ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করেছে। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার সময় নির্বাচন কমিশন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত কাউন্সিলরদের মেয়াদ বিদ্যমান সিটি করপোরেশনের অবশিষ্ট মেয়াদের সমপরিমাণ হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। যদিও কমিশনের এ সিদ্ধান্তের পেছনে যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে, তবু এর কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। অর্থাৎ মেয়রের শূন্য পদে অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য নির্বাচন করার কথা আইনে স্পষ্টভাবে বলা থাকলেও, সিটি করপোরেশনে নতুন কোনো এলাকা সংযোজনের কারণে কাউন্সিলর পদে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে, নবনির্বাচিত কাউন্সিলরদের মেয়াদ কত দিন হবে, তা আইনে স্পষ্ট করা নেই।
এই অস্পষ্টতার সুযোগে কোনো স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আদালতের শরণাপন্ন হয়ে কমিশনের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করতেই পারেন। তাঁরা প্রশ্ন তুলতেই পারেন, কেন নতুন কাউন্সিলরদের মেয়াদ আইনের ৬ ধারা অনুযায়ী পুরো পাঁচ বছর হবে না। তাঁদের এই প্রশ্ন হবে যৌক্তিক। কারণ, এ ব্যাপারে আইনে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। আইনের এমন অস্পষ্টতার কারণে আদালত তাঁদের যুক্তি গ্রহণ করে বিষয়টি সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনের ওপর স্থগিতাদেশ দিলে নির্বাচনটি ভন্ডুল হয়ে যেতে পারে। তবে এই আইনি জটিলতাটি অতি সহজেই দূর করা সম্ভব। সরকার আইনে একটি সামান্য সংশোধনী এনেই তা করতে পারে। তারা সিটি করপোরেশনের মেয়াদ-সংক্রান্ত আইনের ৬ ধারায় একটি উপধারা যোগ করে দিতে পারে এই মর্মে যে, আইনের ৪ ধারা ক্রমে কোনো এলাকা কোনো সিটি করপোরেশনে সংযোজিত হবার কারণে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে, নবনির্বাচিত ওয়ার্ড কাউন্সিলরের মেয়াদ সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনের অবশিষ্ট মেয়াদের সমপরিমাণ হবে। আইনে এই সংশোধনীর সুপারিশ করার দায়িত্ব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এবং এটি পাস করার এখতিয়ার জাতীয় সংসদের। জাতীয় সংসদের অধিবেশন এখন চলছে এবং এ অধিবেশনেই আইনে এই ছোট সংশোধনীটি পাস করানো সম্ভব এবং আবশ্যক। এভাবে নবনির্বাচিত কাউন্সিলরদের মেয়াদ-সম্পর্কিত আইনি জটিলতা সহজেই দূর হবে। আমরা বিস্মিত যে এই আইনি জটিলতা দূর না করে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করেছে। আমি নিজে এবং অন্যরাও এ আইনি জটিলতার কথা বেশ কিছু দিন ধরেই বলে আসছি। কেন নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার আগে সরকারকে নতুন ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মেয়াদের বিষয়টি স্পষ্ট করতে বলল না, তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। আরও বোধগম্য নয়, কেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নির্বাচন করার সুপারিশ কমিশনে পাঠানোর আগে আইনি এই জটিলতা দূর করল না। তাই ঢাকা সিটি করপোরেশনের, বিশেষ করে উত্তরের মেয়র পদে উপনির্বাচন যথাসময়ে করার ব্যাপারে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন করা অযৌক্তিক হবে না, যা নিয়ে চারদিকে অনেক দিন থেকেই অনেক জল্পনা-কল্পনা চলে আসছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সরকারের আন্তরিকতার প্রশ্নটি আরও ঘনীভূত হয়েছে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সমন্বয়কারী ফারুক খানের আইনে ওয়ার্ড কমিশনারদের মেয়াদের বিষয়টি স্পষ্টকরণ সম্পর্কে এক প্রশ্নের সাম্প্রতিক জবাব থেকে। তিনি প্রথম আলোকে (১০ জানুয়ারি ২০১৮) বলেন, ‘এটা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। এটা দেখার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের।’ তবে এখনো সময় আছে আইনি এই জটিলতা দূর করার। সরকার যদি দ্রুততার সঙ্গে সিটি করপোরেশন আইনে উপরোল্লিখিত সংশোধনীটি সংসদে উত্থাপন করে পাস করিয়ে নেয়, তাহলে আশু নির্বাচনটি ভন্ডুলের চেষ্টা রোধ করা যাবে। আশা করি, সরকার নির্বাচনটি যথাসময়ে অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সদিচ্ছা প্রদর্শন করবে এবং আইনটি দ্রুততার সঙ্গে সংশোধনের উদ্যোগ নেবে। এ ব্যাপারে আদালতও সহযোগিতার হাত বাড়াতে পারেন। কেউ যদি নবনির্বাচিত ওয়ার্ড কাউন্সিলরের মেয়াদ-সম্পর্কিত আইনি অস্পষ্টতার বিষয়টি নিয়ে আদালতের আশ্রয় নেন, তাহলে আদালত যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে সরকারকে দ্রুততার সঙ্গে আইনে সংশোধন এনে মেয়াদের বিষয়টি স্পষ্ট করার নির্দেশ দিতে পারেন। এ ছাড়া যেহেতু ঢাকা উত্তরের মেয়র উপনির্বাচন নিয়ে আইনি জটিলতা নেই, তাই আদালত মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকতে পারেন। আইনের অস্পষ্টতা দূরীকরণে আদালতের নির্দেশ দেওয়ার দৃষ্টান্ত আমাদের দেশে রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কুদরত-ই-ইলাহি পনির বনাম বাংলাদেশ মামলার রায়ে [৪৪ ডিএলআর (এসি) (১৯৯২) ] বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কিছু কিছু স্থানীয় সরকার আইনে সংশোধন এনে বিভিন্ন প্রশাসনিক স্তরকে ‘প্রশাসনিক একাংশ’ ঘোষণার নির্দেশ দেন, যাতে আইনের অসম্পন্নতাটি দূরীভূত হয়। প্রসঙ্গত, উপজেলা পরিষদ আইনে উপজেলাকে প্রশাসনিক একাংশ হিসেবে ঘোষণা না করার ত্রুটির কারণে আদালত উপজেলা আইনটিকে ১৯৯২ সালে অসাংবিধানিক বলে রায় দেন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)৷

No comments

Powered by Blogger.