ঐতিহ্যবাহী ‘হুমঘুটি’তে মত্ত হাজারো মানুষ

প্রতিবছরের মতো এবারো পৌষের শেষ বিকেলে হাজারো মানুষের অংশ গ্রহণে ফুলবাড়ীয়ায় অনুষ্ঠিত হলো ‘তালুক-পরগণা’র ঐতিহ্যবাহী ‘হুমঘুটি’ খেলা। শনিবার বিকেল চারটায় ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার লক্ষীপুরের বড়ইআটায় তালুক-পরগনার সীমানায় হুমঘুটি খেলা শুরু হয়। ঢাক-ঢোলের তালে তালে নেচে গেয়ে ‘হুমগুটি স্মৃতি সংসদ’র সভাপতি আবু বক্কর সিদ্দিক পিতলের তৈরি ২২ কেজি ওজনের ঘুটি তালুক-পরগনার সীমানার কেন্দ্রস্থলে আনার পরই ঘুটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাজারো মানুষ। কনকনে শীতের মাঝেই শুরু হয় ঘুটি নিয়ে কাড়াকাড়ি আর দৌড়ঝাঁপ। পিতলের ঘুটি লুকানোর প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে আবাল বৃদ্ধবণিতার দল। কাদা পানিতে পিতলের গুটি নিয়ে উত্তর, দক্ষিন, পূর্ব ও পশ্চিমের খেলোয়ারদের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা চলছে। সন্ধ্যা নাগাদ ঘুটি লুকানোর প্রতিযোগিতা চললেও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। খেলাটি কখন শেষ হবে কারো জানা নেই। গভীর রাত অবধি খেলার প্রস্তুতি নিয়ে এরই মধ্যে টর্চ লাইেটের আলো ছাড়াও নানা রঙের নিশানা নিয়ে পথ প্রর্দশক হিসেবে মাঠে উপস্থিত হয়েছেন অনেকেই। শতাধিক বছরের ঐতিহ্যবাহী হুমঘুটি খেলাকে কেন্দ্র করে ফুলবাড়ীয়ার পল্লীতে এখন উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। এ খেলাকে কেন্দ্র করে লক্ষ্মীপুর, বড়ইআটা, ভাটিপাড়া, বালাশ্বর, শুভরিয়া, কালীবাজাইল, তেলিগ্রাম, সারুটিয়া, গড়বাজাইল, বাসনা, দেওখোলা, কুকরাইল, বরুকা, আন্ধারিয়াপাড়া, দাসবাড়ী, কাতলাসেনসহ আশে পাশের আরো ১০/১২টি গ্রামে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে।
খেলতে খেলতে যখনই ঘুটিটি লুকানো হবে তখনই হুমঘুটি খেলার পরিসমাপ্তি ঘটবে। স্থানীয় সাংবাদিক আবুল কালাম জানান, পৌষ মাসের শেষদিনকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় ‘পহুরা’। ফুলবাড়ীয়া উপজেলার লক্ষ্মীপুর ও দশ মাইলের মাঝামাঝি বড়ইআটা ময়দানে খেলা শুরু হয়। বড়ইআটায় তালুক-পরগণার সীমানায় পিতলের ঘুটিটি ছেড়ে দেয়ার পরই ঘুটি ‘গুম’ করার প্রতিযোগিতা চলে। ছেলে থেকে বুড়ো সব বয়সের মানুষ ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে খেলায় অংশগ্রহণ করে। আশপাশের গ্রামজুড়েও উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। সকাল থেকেই ফুলবাড়ীয়া ছাড়াও ময়মনসিংহ শহর, ত্রিশাল ও মুক্তাগাছা উপজেলার উৎসুক মানুষ খেলা উপভোগ করতে লক্ষ্মীপুরে জড়ো হন। ফুলবাড়ীয়া উপজেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে খেলা শুরুর আগেই ময়মনসিংহ-ফুলবাড়ীয়া সড়কের অদূরে ভাটিপাড়া, বালাশ্বর, তেলিগ্রামের সংযোগস্থল বড়ইআটার সড়কটি লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। প্রবীণদের মতে, মুক্তাগাছার জমিদার রাজা শশীকান্তের সাথে ত্রিশালের বৈলরের জমিদার হেম চন্দ্র রায়ের মধ্যে জমির পরিমাপ নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। জমিদার আমলের শুরু থেকেই তালুকের প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল ১০ শতাংশে আর পরগণার প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল সাড়ে ৬ শতাংশে। একই জমিদারের ভূখণ্ডে দুই নীতির বিরুদ্ধে জনমনে প্রতিবাদের জড় উঠলে জমির পরিমাপ নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ মীমাংসার জন্য লক্ষ্মীপুর গ্রামের বড়ইআটা নামকস্থানে শক্তি পরীক্ষার মধ্যদিয়ে ‘হুমঘুটি’ খেলার আয়োজন করা হয়। খেলার শর্ত ছিল, লক্ষ্মীপুর গ্রামের বড়ইআটায় ‘ঘুটি’ ছেড়ে দেয়ার পর যে দিকে ঘুটি নিয়ে যাওয়া হবে, সেই দিকেরই বিজয় হবে এবং সেই দিকেই হবে ‘তালুক’ অর্থাৎ সেই দিকের জমির পরিমাপ হবে দশ শতাংশ হিসেবে। আর যে দিকের মানুষ পরাজিত হবে সেই দিকের নাম হবে ‘পরগনা’। অর্থাৎ পরগণার জমির পরিমাপ হবে সাড়ে ছয় শতাংশ হিসেবে। জমিদার আমলের ওই ঘুটি খেলায় মুক্তাগাছা জমিদারের প্রজারা বিজয়ী হয়েছিল। সেই থেকেই তালুক-পরগণার সীমান্তের ‘জিরো’ পয়েন্টে শক্তি পরীক্ষার জন্য জমিদারদের ওই ‘পাতানো’ খেলা চলছে বছরের পর বছর ধরে।

No comments

Powered by Blogger.